গাড়ি
টনার আকস্মিকতায় কমলেশের তখন কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থা। খানিক পরে বুঝতে পারল, সে এখন বড় রাস্তার ঠিক মাঝখানে পড়ে রয়েছে। রাত প্রায় সাড়ে এগারোটা, শুনশান এলাকা।

বর্তমান ওয়েবডেস্ক
এপ্রিল ২২, ২০২৫
স্মরজিৎ শূর রায়: টনার আকস্মিকতায় কমলেশের তখন কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থা। খানিক পরে বুঝতে পারল, সে এখন বড় রাস্তার ঠিক মাঝখানে পড়ে রয়েছে। রাত প্রায় সাড়ে এগারোটা, শুনশান এলাকা। তাড়াতাড়ি উঠে চলে যেতে না পারলে, যেকোনও গাড়ি তার ওপর দিয়েই চলে যাবে। কেউ জানতেও পারবে না।
উঠতে গিয়ে বুঝতে পারল কোমর, হাঁটুতে খুব লেগেছে। ডান কনুইটা জ্বলছে, আধো অন্ধকারেও বুঝতে পারল— ছড়ে গিয়েছে। পা দুটো থরথর করে কাঁপছে।
কোনওমতে উঠে ফুটপাতে এসে জামাপ্যান্টের ধুলো ঝাড়ল কমলেশ। দুটো পকেটে হাত ঢুকিয়ে বুঝতে পারল ফাঁকা! মোবাইল ফোনটা নেই! বুকটা ধক করে কেঁপে উঠেই ছন্দ হারাল। গাড়িটার কী হল? ছিনতাই করে নিয়ে পালিয়ে গেল? কী করবে এখন? কোথায় যাবে? বাড়িতে কীভাবে জানাবে? সেও তো অনেক দূরে। বুকের মধ্যে চিনচিন করে পুরনো এনজাইনার ব্যথাটা হচ্ছে। মনে হচ্ছে হৃদস্পন্দনটা ছন্দহীন হয়ে যাচ্ছে। বুকটা খালি খালি লাগছে। সর্বিট্রেট ওষুধটাও নেই, মানিব্যাগে থাকে। সেটা নিয়ে বের হয়নি। কে ভেবেছিল এই অবস্থায় পড়তে হবে?
কাজটা যে খুবই অনুচিত হয়েছে, বুঝতে পারল। এত রাতে এইভাবে হুটহাট করে বেরিয়ে পড়া ঠিক হয়নি। কীভাবে খবর দেবে বাড়িতে? স্ত্রী মণিদীপা, ছেলে, বউমা না জানি কত দুশ্চিন্তা করছে।
কমলেশ ঠিক করল, প্রথমে থানায় যাবে। যেভাবে খোঁড়াচ্ছে তাতে আধঘণ্টা লাগবেই। তাও তাকে থানাতেই যেতে হবে। নইলে তার প্রিয় গাড়িটাকে আর পাবে না।
রাত তখন বারোটা কুড়ি। থানা ও হাসপাতাল বুঝি কখনও ঘুমায় না। ঢুকতেই ডিউটি অফিসার বসতে দিলেন। ফার্স্ট এইড করে দিলেন। ঘটনাটা শুনে বয়ানটা লিখতে বললেন। নিজেও কী সব লিখছিলেন। কমলেশের তখন হাত কাঁপছে। কাঁপা হাতেই লিখল ঘটনাটা।
ওই থানা থেকে তখন ওয়্যারলেস মারফত বিভিন্ন থানায় জানিয়ে দিচ্ছে— একটা গাড়ি ছিনতাইয়ের ঘটনা। গাড়ির নম্বর ডব্লু বি বারো এ দুই শূন্য...। রং হেনা গ্রিন। রাতে কালচে সবুজ লাগে। চারচাকা পুরনো গাড়ি।
দুই
উনিশশো নিরানব্বই সালে কেনা। তখন বাজারে চারচাকার একমাত্র নামী ব্র্যান্ড। দাম পড়েছিল দুই লাখ পনেরো হাজার টাকা। একটা চারচাকা গাড়ির শখ ছিল বহুদিনের। কেনার আগে ড্রাইভিং লাইসেন্স হল। তার জন্য একমাস ধরে ভোরবেলায় গাড়ি চালানো শেখার স্কুলে ট্রেনিং নিল। তারপর যেদিন বাড়িতে গাড়ি এল পরিবেশটাই পাল্টে গেল। ছেলের তখন আঠারো, কমলেশ পঞ্চান্ন। ছেলে বাবা মিলে গাড়িটাকে কী যত্নটাই না করত। মুখ টিপে হাসত স্ত্রী মণিদীপা, কপট রাগ দেখাত।
গাড়ি নিয়ে কোথাও গিয়ে ফিরে এসেই ধুলো সাফ হয়ে যেত। দিনের আলোয় হোস পাইপের জল দিয়ে সাফ হতো মাডগার্ড, চাকা, এক্সেল, আন্ডার সারফেস। ছেলে যখন বেঙ্গালুরুতে পড়তে গেল— কমলেশ তখন একা হাতে সব কাজ করত। গাড়ির ঢাকনা দিয়ে ঢেকে রাখত, যাতে ধুলো না লাগে। কেনার সময় শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত নিতে পারেনি। সামর্থ্য ছিল না। পরে আলাদা করে লাগিয়ে নিয়েছিল। চাকরি থেকে অবসরের পর স্ত্রী মণিদীপাকে পাশে বসিয়ে, ঠান্ডা হাওয়ায়, কার পারফিউমের মাতাল করা সুবাস ছড়িয়ে এদিক-ওদিক ঘুরত। প্রাণ জুড়িয়ে যেত। কমলেশ গাড়ির নাম রেখেছিল লিটল এঞ্জেল। গাড়ি ছিল এ বাড়ির চতুর্থ সদস্য। সময় থামেনি। থামেও না। গাড়িও চলল দশ, বিশ ক্রমশ পঞ্চাশ হাজার কিলোমিটার। উৎসব হল বাড়িতে। তারপর একদিন কুলেন্টের পাইপ ফেটে সবুজরঙা কুলেন্ট ঝরঝর করে মাটিতে পড়ল। আর একদিন গিয়ার বক্স বসে গেল। বরাবর যে অনুমোদিত সংস্থায় গাড়ির সার্ভিস করত— তারা হাত তুলে দিল। বলল— এ গাড়ি ইনটেনসিভ কেয়ারে ঢুকে গিয়েছে, আর কিছু লাভ নেই। ঝেড়ে দিন, এখনও দাম পাবেন। পরে কিন্তু পস্তাবেন।
কমলেশ মানতে চাইল না। সবে তো পনেরো বছর হল। সিএফ করানো হয়েছে আরও পাঁচ বছরের জন্য লাইফ টাইম রোড ট্যাক্স দিয়েছে। এরমধ্যে তিনবার ব্যাটারি পরিবর্তন হয়েছে, চলতে চলতে বহুবার টায়ার পাংচার হয়েছে, ফ্যান বেল্ট ছিঁড়েছে— সব ঠিকঠাক করে নিয়েছে কমলেশ। এবার অন্য সংস্থায় গিয়ে গিয়ার বক্সও ঠিক করে নিল।
কমলেশ স্থির সিদ্ধান্ত নিল, গাড়ি সে কিছুতেই বিক্রি করবে না। একেই ঠিকঠাক করে নিয়ে চালাবে। অবসর জীবনে টাকা কোথায় আরেকটা গাড়ি কেনার?
কুড়ি বছর ছুঁইছুঁই যখন হল, তখন ধোঁয়া পরীক্ষাতে সফল হচ্ছিল না। অনেক খুঁজে একটা পরীক্ষা কেন্দ্র পেল— যারা উতরে দেয়। ততদিনে বিভিন্ন কোম্পানির গাড়ি বাজারে এসে গিয়েছে। বাড়িতে লিটল এঞ্জেলকে নিয়ে অসন্তোষ শুরু হয়ে গিয়েছে। ছেলে ও বউমার চোখে আরেকটা ঝিংচ্যাক গাড়ির হাতছানি। যে গাড়িতে থাকবে — বিল্ড ইন এসি, স্টিরিও, পাওয়ার উইন্ডো। সম্ভব হলে জিপিএস টাচ স্ক্রিন। এক্সচেঞ্জ করতে বলেছিল ছেলে। কমলেশ পাত্তা দেয়নি। গাড়ি অন্তপ্রাণ কমলেশের যত্নের ছেদ পড়েনি।
তারপর একদিন ক্লাচ প্লেটও ভেঙে গেল। ভাঙা ক্লাচ, ভাঙা গিয়ারকে সুরে তালে মেশানো যাবে না বলে দিল কোম্পানি। কমলেশও অনুমোদিত গ্যারেজ ছাড়া গাড়ির কাজ করাবে না। তার গাড়িতে সব জেনুইন যন্ত্রাংশ। ফলে গ্যারেজেই পড়ে রইল লিটল এঞ্জেল। টায়ারগুলো গেল বসে।
এরপর এল সরকারি নির্দেশ— পুরনো সব গাড়ি বাতিল করতে হবে। দুঃখে বুক ভরে গেল কমলেশের। এতদিন ধরে এত ঝঞ্ঝাট সামলানো প্রিয় বন্ধুকে বিক্রি করে দিতে হবে?
অবশেষে রাজি হল কমলেশ। বহুদিন পরম মমতায় গাড়ির গায়ে হাত বোলাল। স্টিয়ারিংয়ে মাথা রেখে নিঃশব্দে কাঁদল। একদিন দালাল এল ঘরে। লিটল এঞ্জেল চলে যাবে অনেক দূরে। যেখানে এত কড়াকড়ি নেই। সে চলবে ফিরবে আপন মনে। সুস্থ থাকবে। রফা হল চল্লিশে, দালাল ও ড্রাইভার নেবে পাঁচ শতাংশ। ড্রাইভার এসে নতুন ক্রেতাকে বলবে— এ গাড়ি তোফা গাড়ি। ব্যস, কমলেশ হাতে পাবে আটত্রিশ।
সইসাবুদ হল। ডেলিভারি নোট, ঊনত্রিশ নম্বর ফর্ম, মানি রিসিট— সব সম্পূর্ণ হল। অগ্রিম নেওয়া হয়েছে দশ হাজার। রাত পোহালেই চলে যাবে লিটল এঞ্জেল।
ইদানীং খুব ভালো চলছে সে। কোনও গড়বড় নেই, থেমে পড়া নেই। তার যেন এখন খুব অভিমান কমলেশদের প্রতি। কে বলেছে সে অসুস্থ? বুড়ো হয়ে গিয়েছে? মাইলেজ তার বরাবরই ভালো। এখনও সে পনেরো দেয়। তবে? এই কি তার প্রতিদান? বয়স হলে কি সবাইকেই বিক্রি হয়ে যেতে হয় অন্যের কাছে? কত বিপদ-আপদ, অসুখ-বিসুখ, ঝড়-জল, উৎসব, ছেলের বিয়ের কাজে কখনও কি সে বেইমানি করেছে? মালিকের কোনও আদেশ কি অমান্য করেছে? তবে?
অনেক স্মৃতি জমাট বাঁধছিল, আজ রাতেই তার শেষ থাকা। রাতের খাবার পর কমলেশ ভাবল— যাই একবার দেখে আসি ওকে। মণিদীপা তখন রান্নাঘরে, ছেলে কম্পিউটারে, বউমা সিরিয়ালে। চুপিচুপি গাড়ির চাবিটা আর মোবাইল ফোনটা নিয়ে গ্যারেজে এল কমলেশ। হঠাৎ মনে হল গাড়িটাতে ধুলো লেগেছে। ঝাড়ন দিয়ে সাফ করে দিল। তারপর সাধের ড্রাইভার সিটটায় বসল একটু।
দশই জুলাই, ঊনিশশো নিরানব্বই— তারিখটা এখনও মনে আছে। লিটল এঞ্জেল এ বাড়িতে এসেছিল। দুই দশকেরও বেশি। কাল থেকে আর কোনও গাড়ি থাকবে না এ বাড়িতে। আবার কবে ছেলে গাড়ি কিনবে— সেই গাড়ি কি বাবাকে চালাতে দেবে? এই বয়সে ড্রাইভিং লাইসেন্সও আর রিনিউ হবে না। গাড়িটা চালাতে এক অদম্য ইচ্ছা হল, বেরিয়ে পড়ল কমলেশ। রাস্তা এখন ফাঁকা, বসন্তের ঠান্ডা বাতাস বইছে। শুনশান রাস্তায় শুধু কুকুর শুয়ে আছে। মাঝে মাঝে দুরন্ত বাইক আইনের তোয়াক্কা না করে গতি তুলছে। এই সময় ট্রাফিক সিগন্যালও একনাগাড়ে বেশিক্ষণ জ্বলে না। অনেক দূর চলে এল কমলেশ। হঠাৎ মনে হল, পিছনের চাকা থেকে একটা শব্দ আসছে।
এটা একটা তার রোগ, মাঝেমাঝেই গাড়ি থামিয়ে নেমে পড়ে। দেখে সব ঠিক আছে তো? মণিদীপা বলে, ম্যানিয়া। আজ ও গাড়িটাকে সাইড করে, নেমে চারটে চাকা ঠিক আছে কি না দেখে নিল। হঠাৎ উদয় হল তিনটে ছেলে। একজন বলল— তার পেটে খুব ব্যথা হচ্ছে। হাসপাতালে একটু পৌঁছে দিতে। মুখ দেখে মনে হল না কোনও ব্যথা আছে। একটু যেন মদের গন্ধও পেল। কমলেশ বলল— সরি, মাফ করবেন।
বলা মাত্র তার মুখ চেপে ধরল একজন। আরেকজন একনাগাড়ে ঘাড়ে, পেটে ঘুষি মারতে লাগল। তারপর লাথি মেরে রাস্তায় ফেলে দিল। প্রথমজন ততক্ষণে গাড়িটা স্টার্ট করেছে, বাকি দু’জন গাড়িতে উঠতেই, লিটল এঞ্জেলকে নিয়ে হুস করে চলে গেল।
তিন
রাত তখন প্রায় একটা। কমলেশকে খুঁজতে ছেলে এল থানায়। দেড়টা নাগাদ বাড়ি এল কমলেশ। বাড়ি আসামাত্র ছেলে, স্ত্রী মণিদীপা অনেক কিছু বলল। মাথা নিচু করে বসেছিল কমলেশ। নিজের হঠকারিতার জন্য মাটিতে মিশে যাচ্ছিল। মাথাটা তখন ভারী, ঘাড়ে অসহ্য ব্যথা। বুকের ব্যথাটা ক্রমশ বেড়েই চলেছে। মাথাটা ঘুরছে। বউমা ক্ষতস্থান ধুয়ে দিয়ে, অ্যান্টিসেপটিক মলম লাগিয়ে দিল। ছেলে এনে দিল সর্বিট্রেট ও অ্যালজোলাম। টলতে টলতে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ল কমলেশ। রাত তখন প্রায় দুটো।
ভোর হল। নতুন ক্রেতা তখনও আসেননি। বলেছিলেন খুব সকালে আসবেন। অনেক দূরে গাড়িটা নিয়ে চলে যেতে হবে। মণিদীপা গরম গরম চা ঢেকে রেখে, কমলেশকে একবার ডেকে টয়লেটে গেল।
ঠিক সেই সময় থানা থেকে একটা ফোন এল। ছেলে ধরল ফোনটা। রাতের সেই অফিসার জানালেন, তাদের গাড়িটা হাইওয়েতে একটা ডিভাইডারে ধাক্কা মেরে চুরমার হয়ে পড়ে আছে। গাড়ির দু’জন আরোহী মৃত। আরেকজন আশঙ্কাজনক অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি। প্রচুর মদের বোতল পাওয়া গিয়েছে গাড়িতে।
ফোনটা রেখে ছেলে ছুটে এসে জানাতে চাইল কমলেশকে। সে তখনও ঘুমাচ্ছে। টয়লেট থেকে বেরিয়ে মণিদীপা শুনল সব কথা। দেখল, চা একদম ঠান্ডা হয়ে গিয়েছে। কমলেশকে ঠেলে জাগাতে চাইল। সেও তখন হিমশীতল ঠান্ডা গাড়ির মতোই নিঃসাড়।
অঙ্কন:সুব্রত মাজী
অলঙ্করণ: সুমনকুমার সিংহ
tags
রাশিফল
-
রাশিফল (২০/০৫/২৫)
- post_by Admin
- মে 20, 2025
-
আজকের রাশিফল (২১/০৫/২৫)
- post_by Admin
- মে 21, 2025
অমৃত কথা
-
ডাক
- post_by বর্তমান
- মে 21, 2025
এখনকার দর
-
নিফটি ব্যাঙ্ক (২০/০৫/২৫)
- post_by Admin
- মে 20, 2025
-
নিফটি ৫০ (২০/০৫/২৫)
- post_by Admin
- মে 20, 2025
-
ইউরো (২১/০৫/২৫)
- post_by Admin
- মে 21, 2025
-
পাউন্ড (২১/০৫/২৫)
- post_by Admin
- মে 21, 2025
-
ডলার (২১/০৫/২৫)
- post_by Admin
- মে 21, 2025
-
রূপোর দাম (২০/০৫/২৫)
- post_by Admin
- মে 20, 2025
-
সোনার দাম (২০/০৫/২৫)
- post_by Admin
- মে 20, 2025
-
সোনার দাম (২১/০৫/২৫)
- post_by Admin
- মে 21, 2025
-
রুপোর দাম (২১/০৫/২৫)
- post_by Admin
- মে 21, 2025
-
ডলার (২০/০৫/২৫)
- post_by Admin
- মে 21, 2025
-
পাউন্ড (২০/০৫/২৫)
- post_by Admin
- মে 20, 2025
-
ইউরো (২০/০৫/২৫)
- post_by Admin
- মে 20, 2025