যে কোনও ব্যবসার বৃদ্ধি ও অর্থকড়ি আয় বৃদ্ধি। ধর্মাচরণে মনযোগ বৃদ্ধি। বন্ধুর শত্রুতায় ক্ষতি। ... বিশদ
ঋষি জমদগ্নি ছিলেন ধনুর্বেদ ও অস্ত্রবিদ্যায় সুনিপুণ। তাঁর স্ত্রী রেণুকা। রেণুকার গর্ভে জমদগ্নির পঞ্চপুত্র জন্মগ্রহণ করেন। তাঁদের কনিষ্ঠ পুত্রের নাম ‘রাম’। উত্তরকালে তিনিই পরশুরাম । ভৃগুবংশে জন্মেছিলেন বলে তিনি ‘ভার্গব’ এবং জমদগ্নির পুত্র বলে ‘জামদগ্ন্য’ নামেও খ্যাত । পরশুরাম শ্রীবিষ্ণুর ষষ্ঠ অবতার। আবার শ্রীমদ্ভাগবতে বলা আছে—
অবতারে ষোড়শমে পশ্যন্ ব্রহ্মদ্রুহো নৃপান্।
ত্রিঃ সপ্তকৃত্বঃ কুপিতো নিঃক্ষত্রামকরোন্মহীম্।।
(শ্রীমদ্ভাগবত - ১/৩/২০)
অর্থাৎ ‘ভগবান ষোড়শ অবতারে রাজগণকে ব্রাহ্মণদ্বেষী দেখে কুপিত হয়ে পৃথিবীকে একুশবার ক্ষত্রিয়শূন্য করেছিলেন।’
ছোটবেলা থেকেই শাস্ত্রপাঠ, তপস্যার চেয়ে ধনুর্বিদ্যায় রামের আগ্রহ ছিল বেশি। শাস্ত্রপাঠ শেষ হলে রাম কঠোর তপস্যার দ্বারা মহাদেবকে তুষ্ট করে মহাদেবের কাছ থেকে ইচ্ছামৃত্যুর বর পেলেন। সেইসঙ্গে একটি দিব্য পরশু বা কুঠার। শিবের দেওয়া এই পরশু দিয়েই তিনি একুশবার পৃথিবী ক্ষত্রিয়শূন্য করেছেন, তাই তিনি পরশুরাম নামে খ্যাত।
একবার তাঁর জননী রেণুকা গঙ্গায় জল আনতে গিয়ে গন্ধর্বরাজ চিত্ররথকে দেখে মোহিত হয়ে গেলেন। অন্যদিকে জমদগ্নি তাঁর আশ্রমে হোমের আয়োজন করে রেণুকার অপেক্ষায় বসে আছেন। অনেকক্ষণ পর রেণুকার হুঁশ ফিরলে মনে পড়ল সে কথা। তিনি স্বামীর ভয়ে ভীত হয়ে জল নিয়ে তাড়াতাড়ি আশ্রমে ফিরে এলেন। ততক্ষণে জমদগ্নি যোগবলে জেনে গিয়েছেন আসল ঘটনা। তিনি ক্রোধে জ্বলে উঠলেন। পত্নীকে ভর্ৎসনা করলেন এবং নিজের চার পুত্রকে একে একে আদেশ দিলেন, ‘এই পাপিষ্ঠাকে এখনই হত্যা করো!’ কিন্তু কোনও পুত্রই জমদগ্নির আদেশ পালন করলেন না। জমদগ্নি আরও রেগে গিয়ে পুত্রদের অভিশাপ দিলেন, ‘তোমরা পশু-পাখির মতো জড়বুদ্ধিসম্পন্ন হয়ে যাবে!’
এমন সময় পরশুরাম আশ্রমে ফিরলেন এবং পিতার এক কথাতেই নির্দ্বিধায় কুঠারের আঘাতে মাতার শিরশ্ছেদ করলেন। জমদগ্নি প্রসন্ন হয়ে পুত্রকে বললেন, ‘কী বর চাও?’ পরশুরাম পিতার কাছে প্রার্থনা করলেন—(১) জমদগ্নির তপঃপ্রভাবে মাতা রেণুকা যেন পুনর্জীবন লাভ করেন, (২) তাঁকে হত্যা করার ঘটনা যেন রেণুকার মনে না থাকে, (৩) মাতৃহত্যার পাপ যেন পরশুরামকে স্পর্শ না করে এবং তাঁর ভ্রাতারাও যেন তাঁদের স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে পান, (৪) যুদ্ধে আমি (পরশুরাম) যেন অজেয় হই এবং (৫) দীর্ঘায়ু লাভ করি। জমদগ্নি তৎক্ষণাৎ পরশুরামকে বর দিলেন। জীবন ফিরে পেলেন রেণুকা। বিচক্ষণ পরশুরাম তাঁর পিতার আশ্চর্য ক্ষমতা আছে জেনেই নিজের জননীকে বধ করেছিলেন। হৈহয় বংশের অত্যাচারী রাজা ছিলেন কার্তবীর্যার্জুন। নর্মদার তীরে মাহিষ্মতী নগরী ছিল তাঁর রাজধানী। নারায়ণের অংশাবতার ঋষি দত্তাত্রেয়র বরে কার্তবীর্য হাজারখানা হাত পেয়েছিলেন। কার্তবীর্য একদিন মৃগয়ার জন্য নির্জন বনে ভ্রমণ করতে করতে সহসা জমদগ্নির আশ্রমে প্রবেশ করলেন। তখন জমদগ্নির পুত্রেরা কেউ আশ্রমে নেই। রাজা হঠাৎ সৈন্য-সামন্তদের নিয়ে চলে এসেছেন। এক পর্ণকুটিরবাসী ব্রাহ্মণের পক্ষে অল্প সময়ের মধ্যে এত লোকজনের খাবারের বন্দোবস্ত করা বেশ কঠিন। কিন্তু কার্তবীর্য অবাক হয়ে দেখেন যে, জমদগ্নি তাঁদের সকলের জন্য খাওয়া-দাওয়ার সুন্দর বন্দোবস্ত করে ফেলেছেন। কার্তবীর্য জানতে পারলেন যে, জমদগ্নির কাছে এক আশ্চর্য কামধেনু আছে। তার আশ্চর্য ক্ষমতার জোরেই জমদগ্নি নিমেষের মধ্যে এই আয়োজন করতে পেরেছেন।
রাজা দেখলেন, জমদগ্নির ঘরে যে ধন আছে, তার ঘরে সে ধন নেই। সুতরাং রাজা সেই কামধেনুটি চেয়ে বসলেন। জমদগ্নি ধেনু দিতে নারাজ। তখন দুষ্ট রাজার নির্দেশে তার অনুচরেরা ধেনুটিকে টানতে টানতে আশ্রম থেকে নিয়ে গেল। পরশুরাম আশ্রমে ফিরে সব শুনে ক্রোধে ফুঁসে উঠলেন এবং কুঠার হাতে বেরিয়ে পড়লেন ধেনু ফিরিয়ে আনতে।
রাজা তখন মাহিষ্মতী পুরীতে প্রবেশ করছেন। হঠাৎ দেখেন মৃগচর্মপরিহিত, জটাধারী, ধনুক, বাণ ও কুঠারধারী এবং সূর্যের মতো তেজস্বী পরশুরাম আসছেন। তাঁর রুদ্রমূর্তি দেখে কার্তবীর্য ভয় পেয়ে গেলেন। তাঁর আদেশে হাতি, ঘোড়া, রথে চড়ে, অতি ভয়ঙ্কর অস্ত্র নিয়ে সপ্তদশ অক্ষৌহিনী সেনা পরশুরামের সঙ্গে যুদ্ধ করতে এল। পরশুরাম অবলীলায় সপ্তদশ অক্ষৌহিনী সেনা নিশ্চিহ্ন করে দিলেন। পরশুরাম মহাবেগে কুঠারের আঘাত করতে করতে যুদ্ধক্ষেত্রে যে যে জায়গায় যাচ্ছিলেন, সেইসব জায়গায় শত্রুসৈন্যদের সারথি, হাতি, ঘোড়ার মৃতদেহ এবং সৈন্যদের ছিন্ন হাত, পা, মুণ্ড জমা হচ্ছিল।
চতুর্দিকে ছড়িয়ে আছে সৈন্যদের ছিন্নভিন্ন দেহ, দিকে দিকে শুধু রক্তের স্রোত বইছে, আর সেই মরণভূমিতে অক্ষত কেবল রুদ্রমূর্তি পরশুধারী রাম। সহস্রবাহু কার্তবীর্য ক্রুদ্ধ সর্পের মতো ফুঁসতে ফুঁসতে পরশুরামের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন। পরশুরাম কুঠারের আঘাতে কার্তবীর্যের সহস্র বাহু ছেদন করে, শেষে তাঁর মুণ্ডটিও কেটে ফেললেন। কার্তবীর্যের দশ হাজার পুত্র ভয়ে পালিয়ে গেল।
কামধেনু নিয়ে আশ্রমে ফিরলেন পরশুরাম। তার পর পিতার আদেশে রাজার হত্যার প্রায়শ্চিত্ত করতে তীর্থে তীর্থে ভ্রমণও করলেন। অন্যদিকে কার্তবীর্যের পুত্রেরা প্রতিহিংসার আগুনে জ্বলছে। একদিন পরশুরামের অনুপস্থিতিতে তারা আশ্রমে গিয়ে জমদগ্নিকে নৃশংস ভাবে হত্যা করল। রেণুকা বুক চাপড়ে কাঁদছেন। দূর থেকে মায়ের কান্না শুনতে পেয়ে আশ্রমে ছুটে এলেন পরশুরাম। তার পর ক্রন্দনরত জননী ও পিতার মৃতদেহের সামনে দাঁড়িয়ে পরশুরাম প্রতিজ্ঞা করলেন, সমস্ত অনাচারী ক্ষত্রিয়দের তিনি পৃথিবী থেকে মুছে ফেলবেন।
অগ্নিমূর্তি পরশুরাম মাহিষ্মতীতে গিয়ে কার্তবীর্যের পুত্রদের বধ করে তাদের ছিন্ন মুণ্ড দিয়ে একটা বিশাল পর্বত তৈরি করলেন। এইভাবে পিতার বধকে নিমিত্ত করে পরশুরাম পৃথিবীকে একুশবার ক্ষত্রিয়শূন্য করে স্যমন্তপঞ্চক ক্ষেত্রে দুষ্ট ক্ষত্রিয়দের রক্তে পরিপূর্ণ নয়টি হ্রদ তৈরি করেছিলেন। তিনি হয়তো আরও ক্ষত্রিয়নিধন করতেন, কিন্তু তাঁর পিতামহ ঋচীকের অনুরোধে অবশেষে ক্ষান্ত হলেন। পরশুরাম ক্ষত্রিয়নিধনের প্রায়শ্চিত্তস্বরূপ এক মহাযজ্ঞের আয়োজন করেন। সেই যজ্ঞে তিনি ঋষিদের হাতে পৃথিবী শাসনের ভার দিয়ে ভারতবর্ষ ত্যাগ করে ভারতসাগরে মহেন্দ্রপর্বত নামক এক দ্বীপে গিয়ে কঠোর তপস্যায় মগ্ন হন।
কথিত আছে, অক্ষয় তৃতীয়ার পুণ্যলগ্নেই পরশুরাম পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়েছিলেন। তাই এই দিনটি পরশুরাম জয়ন্তী নামেও খ্যাত। তিনি পুরাণের সাতজন চিরঞ্জীবীদের অন্যতম। পরশুরাম ছিলেন মহাভারতের ভীষ্ম, দ্রোণ, কর্ণের অস্ত্রগুরু। ভীষ্মের সঙ্গে ভয়ানক যুদ্ধেও লিপ্ত হয়েছেন পরশুরাম। রামায়ণে আছে, শ্রীরাম হরধনু ভঙ্গ করে জানকীকে বিবাহ করে মিথিলা থেকে অযোধ্যায় ফিরছেন। পথে তাঁর দেখা হয় পরশুরামের সঙ্গে। রঘুবীর পরশুরামের বৈষ্ণবধনু ভঙ্গ করে পরশুরামের তেজ নিজের দেহে নিয়ে নেন।
ভাগবতে আছে, চিরজীবী পরশুরাম আগামী মন্বন্তরে সপ্তর্ষিমণ্ডলে থেকে বেদ প্রবর্তন করবেন। এমনকী তিনি আজও মহেন্দ্র পর্বতেই অবস্থান করছেন। সেখানে সিদ্ধ, গন্ধর্ব ও চারণগণ মধুরস্বরে তাঁর বিচিত্র লীলা কীর্তন করছেন। তবে এমন দিনও আসবে, যেদিন পরশুরাম আবার ফিরে আসবেন। যখন কলিযুগের শেষে শম্ভল গ্রামের বিষ্ণুযশ নামক এক ব্রাহ্মণের গৃহে শ্রীহরির দশম অবতার কল্কিদেব আবির্ভূত হবেন, তখন চিরঞ্জীবী পরশুরাম মহেন্দ্র পর্বত থেকে ফিরে আসবেন কল্কিদেবকে অস্ত্রচালনা শেখাতে।
তথ্যসূত্রঃ
ছবি: সুব্রত মাজী