কর্মলাভের যোগ আছে। ব্যবসায় যুক্ত হওয়া যেতে পারে। কর্মক্ষেত্রে সাফল্য আসবে। বুদ্ধিমত্তার জন্য প্রশংসা জুটবে। ... বিশদ
আম্মাও কোনওদিন হাসি-খুশি ছেলেটাকে আব্বুর কথা কিছু বলে না।
বড় রাস্তার ধারে একটাই তো দরমার বাড়ি।
বর্ষাকালে রাস্তার জল এসে ঘরে ঢোকে। সহজে বের হতে চায় না।
কত দিনের নড়বড়ে একটা তক্তপোশ! সেখানে তিন জনের খুব কষ্ট হয়।
তবু হাসি-খুশি ছেলেটার মনে যেন দুঃখ বলে কিছু নেই।
আশ-পাশের বাড়ি থেকে গোটা মাটিয়ার মানুষজন জানে সোহারাব ছেলেটা যেমন পড়াশুনোয় সেরা; তেমন উদার! গরিব মানুষদের দেখলে কেমন যেন মুখটা কালো হয়ে যায়!
ঝাপসা হয়ে আসে দুটো চোখ!
ইস্কুলের স্যারেরা অবশ্য খুবই ভালোবাসেন ছেলেটাকে।
কিন্তু সোহারাব যেন কেমন!
টিফিন খেতে ডাকলেও মুখ নিচু করে কোথায় যে লুকিয়ে পড়ে খুঁজে পাওয়া যায় না কিছুতেই।
শুধু বন্ধুরা ডাকলে না বলে না সোহারাব!
সেখানে কখনও সিরাজুল, অধীর, দিলীপ, সাকির যখন তখন ঘিরে ধরে লাজুক ছেলেটাকে।
নিজেদের টিফিন থেকে সোহারাবকে কিছুটা না দিলে যেন মনটা ভালো হয় না কারওর।
বড় রাস্তার ধারে গোটা মাটিয়া গ্রামটাই যেন ছেলেটাকে ভালোবাসে নিজেদের ছেলের মতন।
সব্বাই যেন কী রকম সব স্বপ্ন দেখে সোহারাবকে নিয়ে।
স্যারেরাও কত কী পাঠিয়ে দেন বাড়িতে। ছেলে সবটা জানে না।
আম্মা শুধু আব্বুকে বলেন।
আব্বু জল ভরা চোখ দুটো আকাশের দিকে তুলে আল্লাতালাকে বিড় বিড় করে কী যে বলেন সেটাও কেউ শুনতে পায় না!
কিন্তু ছেলেটা যেন কেমন!
সহজে ভয় পায় না। ভূত-প্রেত বা জিনকে!
পড়তেও চায় না ওই রকম সব গল্প!
বন্ধুরা সবাই জেনে গেছে, সোহারাব মোটেও আজগুবি গল্প বিশ্বাস করে না কিছুতেই।
ছোটবেলা থেকেই বিজ্ঞান হল বড় বন্ধু ছেলেটার।
সঙ্গে আছে অসহায় আর গরিব মানুষদের জন্যে মন কেমন করা একটা টান।
বাড়িতে একটার বেশি দুটো গামছার দেখা পাওয়া যায় না সহজে।
আব্বা তো কত কষ্ট করে কিনে আনেন ছেলের জন্যে, কিন্তু একদিন বাদেই কোথায় যে হারিয়ে যায় কেউ জানতে পারে না!
শুধু দু-একজন অসহায় বুড়ি মা সোহারাবকে খুব ভালো মতন চেনেন!
একটা গামছা আর এমন কী?
ঈদের সময় একটা নতুন কাপড় দিতে পারলে খুব আনন্দ হতো।
পরীক্ষায় ফার্স্ট হওয়ার চেয়েও বেশি গর্ব হতো তখন!
তবু ইস্কুলের স্যারেরা সব সময় খবরা-খবর রাখে সোহারাবের।
সামনেই তো বড় পরীক্ষা।
বাবা-মা যেন কেমন অস্থির। ঘুম হচ্ছে না ভালো করে। তার ওপর আব্বারও শরীরটা ভালো নেই। সবদিন দিনমজুরির কাজ জোটে না কপালে!
কিন্তু সোহারাবটা যেন কেমন!
শুধু পাড়ার অসহায়-গরিব মানুষরাই নয়, তাদের বাড়ির ছোটদের সবারই জন্যে ছেলেটার যেন কত রকম চিন্তা!
শীতে কার গায়ে চাদর নেই, কোন বুড়িমার খাবার জোটেনি সারা দিন, সে সব নিয়ে উশখুশ করে মনটা।
ইস্কুলের স্যারেরা যেন সব খবর রাখেন সব সময়।
নিজে ভালো করে টিফিন খায় না কোনওদিন। স্যারেরা আড়ালে ডাকলেও লাজুক মুখে শুধু একটু হাসে।
মুড়ির একটা কৌটোয় কী থাকে বন্ধুরাও কেউ জানে না!
হেড স্যার নির্মলবাবু এক একদিন আড়ালে ডাকেন।
চুপি চুপি বলেন, মনে আছে তো—সামনেই তোর বড় পরীক্ষা!
নিজে কী খাস সারাদিন? শুনেছি, সবই তো বন্ধুদের দিয়ে দিস লুকিয়ে-চুরিয়ে। তার ওপর মায়ের তো শরীর খুব খারাপ শুনেছি। বাবাও তো রোজ কাজ জোটাতে পারে না এখন! তাহলে—
সোহারাব কথা বলে না।
মুখটা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে।
স্যার তবু থামেন না। বলেন, আমি শুনেছি, আমাদের ইংলিশের দিদিমণি তোমাকে নিয়ে একটা শীতের চাদর কিনে দিয়েছিলেন সবাইকে লুকিয়ে। কিন্তু সে চাদর তুমি নিয়ে যাওনি! কী করেছ সেটাও আমি শুনেছি! বলব?
সোহারাব আর কথা বলতে পারে না।
মুখটা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে।
স্যার অবশ্য চেয়ার ছেড়ে উঠে একবার বুকের কাছে টেনে নিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দেন সোহারাবের।
একটু ধরা গলায় বলেন, তোমার জন্যে আমাদের খুব গর্ব হয়। শুধু তোমাদের এই মাটিয়া গ্রামটাই নয়, গোটা বারাসতই একদিন গর্ব করবে তোমাকে নিয়ে। তুমি দেখো।
সোহারাব তাড়াতাড়ি স্যারের পায়ে হাত দিতেই, দু’হাত বাড়িয়ে লাজুক ছেলেটাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন তিনি।
তারপর মুখ আঁটা একটা খাম দিলেন এগিয়ে।
বললেন, মায়ের হাতে এটা গিয়ে দিয়ে দিও। কেমন?
ছেলে যেন একটু কেমন থতমত খেয়ে গেল হঠাৎ।
তবু হেড স্যার চোখ দুটো আড়াল করে বললেন, মনে রেখো সামনেই তোমার বড় পরীক্ষা। রাত জাগতে হবে না। বড্ড শীত পড়েছে এবার। পারলে মাকে বলবে, একটু বেশি করে চাল-আটা আর আলু কিনে রাখতে বাড়িতে!
সোহারাব যেন কাঁদতে গিয়েও চোখ দুটো আড়াল করল কেমন!
বাড়ি ফিরে আম্মার হাতে খামটা দিয়ে কী করবে ঠিক করতে পারছিল না কিছুই। তবু আব্বার পায়ে হাত ছুঁইয়ে বলল, হেড স্যার দিয়েছেন আব্বু। আমি কিন্তু কাউকে কিছু চাইনি!
তারপর?
তারপর আর কী!
একটু একটু করে গল্পটা কেমন ছোট্ট থেকে আকাশের সাতরঙা রামধনুর মতো রঙিন হয়ে এল একদিন।
কাগজ অফিসের লোকেরা যেমন, টিভি-র লোকেরাও তেমন ভিড় করে এল মাটিয়ার একটা ভাঙা-ফুটো এক চিলতে বাড়িতে।
তখন শুধু কলকাতা থেকে মাটিয়া, বারাসাত, বীরভূম, কী টাকির কাছে ইছামতীর এপার-ওপারের বন্ধুরা নয়, বাঘমুণ্ডি আর দলমা পাহাড়ের আড়ালে লুকিয়ে থাকা শীত কাতুরে গল্পরাও কেমন ছাপতে গেল কাগজে কাগজে! টি-ভিরা সব ভেংচি কেটে বললে আমাদের সঙ্গে পারবে?
টুমপি বললে, ধুর! আমাদের সোহারাব কাকুর সঙ্গে ওরা কেউ পারে? সবেতেই তো ফার্স্ট আর ফার্স্ট! কলকাতার কাগজে কাগজে কত রকম খবর। কত হইচই!
নানান মানুষের শুভেচ্ছা!
দরাজ মনের মানুষ মোস্তাক হোসেন সাহেব তো দুঃখী মানুষের সোনায় গড়া ছেলেটার জন্যে ছুটে গেলেন মাটিয়ায়।
সোহারাবের বন্ধুরাও তখন কে কী নিয়ে বাড়িতে যাবে সেটাই ঠিক করতে পারল না সঙ্গে সঙ্গে!
তবু পাশের গ্রামের রক্তিম, আলাউদ্দিন, ভবানী মেকাইল আর জয়ন্তী—সবাই মিলে চাঁদা তুলল বন্ধুর জন্যে।
সোহারাব তাহলে কী খেতে সবচেয়ে ভালোবাসে?
চেঁচিয়ে উঠল যেন গোটা ইস্কুল।
—শোনপাপড়ি—শোনপাপড়ি...
অলংকরণ : সুব্রত মাজী