কর্মলাভের যোগ আছে। ব্যবসায় যুক্ত হওয়া যেতে পারে। কর্মক্ষেত্রে সাফল্য আসবে। বুদ্ধিমত্তার জন্য প্রশংসা জুটবে। ... বিশদ
ছোট্ট বন্ধুরা জানো তো সত্যজিৎ রায়ের জন্মশতবর্ষ চলছে! তাঁর বাবা সুকুমার রায় ছিলেন বিখ্যাত কবি। মা’র নাম সুপ্রভা রায়। এক রবিবার সত্যজিৎ রায় জন্মেছিলেন। এবার আসি তাঁর ছবিগুলির কথায়।
প্রথমেই এক গানপাগল যুবকের কথা বলি। রাজবাড়ির দিকে মুখ করে বসে সে গান ধরেছে। গানের শব্দে রাজার ঘুম ভেঙে যায়। যুবকটিকে পেয়াদা পাঠিয়ে ধরে নিয়ে আসেন রাজা। তার কাছে রাজার প্রশ্ন, ‘নাম কী?’ যুবকের উত্তর ‘গোপীনাথ গায়েন’। রাজার পরের প্রশ্ন ‘সপ্তক জানা আছে?’ সম্মতি জানায় যুবকটি। রাজার পরের প্রশ্ন ‘তৃতীয় সুরটা কী?’ যুবক বলে ‘গা’। রাজার এবারের প্রশ্ন, ‘ষষ্ঠ সুর’? যুবকের চটপট উত্তর ‘ধা’। রাজা আবার প্রশ্ন করলেন, ‘দুইয়ে মিলে কী হয়?’ রাজাই উত্তর দিয়ে দিলেন ‘গাধা’। যুবকের হাতের তানপুরাটা নিজের হাতে নিয়ে মেঝেতে ছুঁড়ে ফেললেন রাজা। তানপুরাটা পড়ে খান খান হয়ে গেল। রাজা নির্দেশ দিলেন ‘একে গাধার পিঠে তুলে গ্রামের বাইরে বার করে দাও’। অপমানিত যুবকটি গাধার পিঠে চড়ে বাঁশবন পর্যন্ত চলে আসে। একাই ঢোকে বাঁশবনে। সেখানে তার পরিচয় হয় আর এক যুবকের সঙ্গে। জানতে পারে এই যুবকটিও রাজার কাছে অপমানিত হয়ে গ্রামছাড়া হয়েছে। যুবকটি ভালো ঢোল বাজায়। যুবকটির নাম বাঘা বাইন। গোপীনাথ গাইন থেকে প্রথম যুবক হয়ে ওঠে গুপী গাইন। গুপী গাইন, বাঘা বাইন। তোমরা এতক্ষণে ঠিক বুঝতে পেরেছ যে আমি ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ ছবির গল্প করছিলাম। সত্যজিৎ রায়ের ঠাকুরদাদা উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর লেখা ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ একসময় ‘সন্দেশ’ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছিল।
পরিচয় পর্বের পর দুটো অদ্ভুত ঘটনা ঘটে। বাঁশবনের মধ্যেই বাঘের আগমন। বাঘা পরামর্শ দেয় গান-বাজনা করো, তুমি তো গাইন। তাহলে আর বাঘ আসবে না। বাঘার ঢোলের আওয়াজের সঙ্গে সঙ্গে গুপী গাইন গান ধরে। বাঘটা একবার ওদের দিকে তাকিয়ে চলে যায়। ওরা হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। আরেক দৃশ্য দেখে ওদের ভয় লেগে যায়। বাঁশবাগানের ফাঁকে ফাঁকে ভুতের নাচ শুরু হয়। ভূতের রাজা গুপী-বাঘার দুঃখের কথা শুনে ওদের তিনটে বর দিলেন। গুপী-বাঘার আনন্দ আর ধরে না। গুপী গান ধরে ‘ভূতের রাজা দিল বর, জবর জবর তিন বর’। সত্যজিৎ রায় এমনভাবে সবকিছু তুলে ধরলেন যাতে তোমরা তো আনন্দ পেলেই, বয়স্করাও সমান আনন্দ পেলেন। এবার শিল্পী তালিকাটা দেখা যাক। গুপীর ভূমিকায় পরিচালক নিয়ে এলেন নতুন মুখ তপেন চট্টোপাধ্যায়কে। বাঘার চরিত্রে রবি ঘোষ। শুন্ডির রাজা এবং হাল্লার রাজা এই দুই চরিত্রের জন্য এলেন সন্তোষ দত্ত। হাল্লা রাজার মন্ত্রীর চরিত্রে জহর রায়। জাদুকর বরফি চরিত্রে হারীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়। এছাড়াও অনেক শিল্পী। এই ছবির অন্যতম আকর্ষণ অবশ্যই বাঘ। সত্যিকারের বাঘ। এখনকার ছবির মতো কম্পিউটারে তোলা বাঘ নয়। সত্যিকারের বাঘ মানে তার শ্যুটিংয়ের ধকলটা অনেক। গ্রাম থেকে বিতাড়িত গুপী যখন বাঁশবনের কাছাকাছি তখন তার মনে হয় ‘সন্ধ্যা হইলে বনবাদাড়ে বাঘে যদি ধরে? গুপী যদি মরে?’ এমন ভাবনা যখন গুপীর তখন বাঘকে আনতেই হয় পর্দায়। সত্যজিৎ রায় বেরিয়ে পড়লেন বাঘের খোঁজে। ভারত সার্কাসের খেলায় বাঘ এসেছে। সার্কাসের ম্যানেজারের সঙ্গে এবং বাঘের ট্রেনার মিঃ থোরাটের সঙ্গে কথা পাকাপাকি হয়। লোকেশন সিউড়ির বাঁশবন। নির্দিষ্ট দিনে গাড়ির খাঁচায় চেপে বাঘ নিয়ে আসা হল। তাও একটি বাঘ নয়, দু’ দুটো বাঘ। সঙ্গে মিস্টার থোরাট আর তাঁর দুই সঙ্গী। সত্যজিৎ রায় কারণ জিজ্ঞাসা করার পর তিনি জানালেন,
একটা বাঘ যদি কথা না শোনে তাই আরেকটা বাঘ। দুটোই রয়েল বেঙ্গল টাইগার। ঠিক হল রয়েল বেঙ্গল টাইগারের গলায় বাঘের চামড়া দিয়ে তৈরি বকলেস পরানো থাকবে। মস্ত বড় ইস্পাতের তার বকলেস-এর প্রান্তে এবং তারের অপর প্রান্তে লোহার খুঁটিতে বেঁধে সেটি লুকানো থাকবে বাঁশবনের আড়ালের মাটিতে। শট রেডি। ক্যামেরা অ্যাকশন বলার সঙ্গে সঙ্গে খাঁচার মুখ খুলে দেওয়া হল। বাঘ প্রথমে লাফ দিয়ে নেমে খানিক লম্ফঝম্প করে শান্ত হল। শট ওকে। সত্যজিৎবাবু বাঘের খুব কাছে গিয়ে আরও কিছু শট নিলেন। কলকাতায় ফিরে প্রোজেকশন দেখে সত্যজিৎ রায়ের মন ভরল না। তাঁর মনে হল বাঘ আর বাঁশবন কালো এসেছে। এবার শ্যুটিং স্পট বদল হল। তাঁর প্রথম ছবি পথের পাঁচালীর যে বোড়াল গ্রামে শ্যুটিং হয়েছিল, সেখানে এবার বাঘ ও দলবল নিয়ে শ্যুটিং করলেন সত্যজিৎ রায়। ছবির গানগুলি চিরদিনের গান। ‘ভূতের রাজা দিল বর’, ‘দেখো রে নয়ন মেলে জগতের বাহার’, ‘মহারাজা তোমাকে সেলাম’, ‘ও মন্ত্রী মশাই ষড়যন্ত্রী মশাই থেমে থাক’, ‘এক যে ছিল রাজা তার ভারি দুখ’, ‘ওরে বাবা দেখো চেয়ে কত সেনা চলেছে সমরে’— এমন সব গান। ছবির ভাগ্যে জুটেছিল দেশ-বিদেশের অসংখ্য পুরস্কার।
শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্যোমকেশের মতো সত্যজিৎ রায় সৃষ্টি করলেন তাঁর গোয়েন্দা চরিত্রের, নাম প্রদোষ চন্দ্র মিত্র। সবাই অবশ্য ফেলুদা নামে চেনে। শার্লক হোমস আর ওয়াটসন যেমন দারুণ জুটি ঠিক তেমনি ফেলুদার সহকারীর নাম তপেশ। ফেলুদা ডাকেন তোপসে বলে। এছাড়া আর একজন নিয়মিত সঙ্গী আছেন— লালমোহন গাঙ্গুলী। জটায়ু ছদ্মনামে তিনি রহস্য-রোমাঞ্চ গল্প লেখেন। জটায়ু চরিত্রটি রসে ভরা। ভুলভালের মধ্য দিয়ে তাঁর শুদ্ধিকরণ ঘটে বারংবার। ‘সন্দেশ’ পত্রিকার ১৯৬৫ সালের ডিসেম্বর সংখ্যায় ফেলুদার আবির্ভাব। প্রথম পাঁচটি গল্পে জটায়ু নেই। জটায়ু ঢুকলেন ‘সোনার কেল্লা’ থেকে। ১৯৭২ সালের ‘দেশ’ শারদ সংখ্যাতে এটি প্রকাশিত। ফেলুদাকে নিয়ে বড় পর্দার জন্য সত্যজিৎ রায় তৈরি করলেন ‘সোনার কেল্লা’ ছবিটি। তিনি অযথা গোলাগুলি মারদাঙ্গা দেখাতে চাননি। তাই ফেলুদার অস্ত্র হল মগজাস্ত্র। সেই মগজ খাটিয়ে তিনি কঠিন সব রহস্যের সমাধান করেন। মুকুল নামের একটি বাচ্চাকে কেন্দ্র করে গল্পের বিস্তার। মুকুল আঁকার খাতায় রাজস্থানের সোনার কেল্লার ছবি আঁকে। সে নাকি পূর্বজন্মে সেখানেই থাকত। তার কথার সত্যাসত্য অনুসন্ধানের জন্য প্যারা সাইকোলজিস্ট ডাক্তার হাজরা তাকে নিয়ে দুর্গের খোঁজে বেরিয়ে পড়েন। একদল বদমাশ তাদের পিছু নেয়। ছেলের সর্বনাশ হতে পারে এই ভয়ে মুকুলের বাবা ফেলুদাকে নিয়োগ করেন দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালনের জন্য। ফেলুদা তোপসে ও জটায়ুকে নিয়ে রাজস্থানে হাজির। তিনি রহস্যের সমাধান করলেন। বড়পর্দায় ফেলুদা চরিত্রে প্রথম এলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। তোপসে চরিত্রে সিদ্ধার্থ চট্টোপাধ্যায়। জটায়ু চরিত্রে সন্তোষ দত্ত। মুকুলের চরিত্রে শ্রীমান কুশল। অভিভাবকরা সাদরে গ্রহণ করলেন ফেলুদাকে। জমে গেল সোনার কেল্লা। ১৯৭৪ সালের বড়দিনের সময় এই ছবি মুক্তি পেয়েছিল।
এই ছবির সাফল্যে উৎসাহিত হয়ে ফেলুদা সিরিজের আরেকটি রহস্য গল্পকে সত্যজিৎ রায় বড় পর্দায় নিয়ে এলেন। ছবির নাম ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’। ১৯৭৫ সালের ‘দেশ’ শারদ সংখ্যায় এই উপন্যাসটি বেরিয়েছিল। ফেলুদা তোপসে ও জটায়ুকে নিয়ে বেড়াতে গেছেন বেনারসে। গোয়েন্দাগিরির কোনও ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু বেনারসের এক পরিবারের মূল্যবান গণেশ মূর্তি চুরি হয়ে যায়। বাধ্য হয়ে ফেলুদা সেই পরিবারের কর্তার অনুরোধে তদন্তে নেমে পড়েন। সেখানে তিনি মুখোমুখি হন কুখ্যাত ব্যবসায়ী মগনলাল মেঘরাজের। একদিন মেঘরাজ করলেন কী, ফেলুদা তোপসে ও জটায়ুকে নিজের বাড়িতে ডেকে এনে জটায়ুর সঙ্গে এক ভয়ঙ্কর ছুরি ছোঁড়ার খেলায় ফেলুদাকে বুঝিয়ে দেন যে এই তদন্তের কাজ চালিয়ে গেলে ফেলুদা বিপদে পড়বেন। কিন্তু হুমকি দিয়ে কি ফেলুদাকে আটকে রাখা যায়? টানটান রহস্য আর উত্তেজনাকে তুলে ধরলেন সত্যজিৎ রায়। যথারীতি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ফেলুদা। সিদ্ধার্থ চ্যাটার্জি তোপসে। সন্তোষ দত্ত জটায়ুর চরিত্রে। মগনলাল চরিত্রে উৎপল দত্ত। ১৯৭৯ সালের ৫ জানুয়ারি শিশু ও কিশোর চিত্র হিসেবে ছবি মুক্তি পেল। ‘সেরা শিশু চলচ্চিত্র’ হিসেবে রাষ্ট্রপতি পুরস্কার পেল ছবিটি। এ ছাড়া বিদেশের নানান পুরস্কার তো আছেই।
‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’-এর পরবর্তী ধাপ ‘হীরক রাজার দেশে’। তবে প্রথমটি সত্যজিৎ রায়ের ঠাকুরদার লেখা। দ্বিতীয়টি তাঁর নিজের। ছবির সংলাপ ছন্দ মিলিয়ে মিলিয়ে, যা ছোট বড় সবাই উপভোগ করেছে পুরোমাত্রায়। গুপী-বাঘা নিমন্ত্রণ পেয়ে গিয়েছে হীরক রাজার দেশে। সেই রাজা অত্যাচারী প্রজাপীড়ক। রাজার এক পাগল বিজ্ঞানী আছেন যিনি আবিষ্কার করেছেন মগজ ধোলাই যন্ত্র। রাজার কাজের যারা বিরোধী তাদের মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়া হচ্ছে রাজার শেখানো বুলি। ‘যায় যদি যাক প্রাণ হীরকের রাজা ভগবান’, ‘বেশি খেলে বাড়ে মেদ অনাহারে নাহি খেদ’, ‘লেখাপড়া করে যে অনাহারে মরে সে’, ‘জানার কোন শেষ নাই জানার চেষ্টা বৃথা তাই’ ইত্যাদি ইত্যাদি। শেষ পর্যন্ত রাজশক্তিকে ভেঙে দিতে আসেন গুরুমশাই উদয়ন। উদয়নকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসে গুপী-বাঘা। শেষ পর্যন্ত রাজাই মগজ ধোলাইয়ের শিকার হন। নিজেই নিজের মূর্তি ভাঙার উৎসবে ছুটে গিয়েছেন। তখন রাজা নিজেই বলছেন ‘দড়ি ধরে মারো টান রাজা হবে খান খান’। শেষপর্যন্ত রাজা ও বিজ্ঞানীর পাগলামো থেকে মুক্তি পায় সাধারণ মানুষ। সত্যজিৎ রায় নিজের লেখা একটি লোকগীতি এই সিনেমায় ব্যবহার করেছিলেন, যেটি খুব জনপ্রিয়তা পেয়েছিল— ‘কতই রঙ্গ দেখি দুনিয়ায় ও ভাইরে’। গেয়েছিলেন অমর পাল। গুপীর গানগুলি গেয়েছেন অনুপ ঘোষাল। গুপীর চরিত্রে তপেন চট্টোপাধ্যায়। বাঘার চরিত্রে রবি ঘোষ। উদয়ন পণ্ডিত হয়েছেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। হীরক রাজার ভূমিকায় উৎপল দত্ত। বিজ্ঞানীর চরিত্রে সন্তোষ দত্ত। এই ছবির ভাগ্যেও জুটেছে দেশি-বিদেশি বহু পুরস্কার। ছবিটি মুক্তি পেয়েছিল ১৯৮০ সালের বড়দিনের সময়। ছোট্ট বন্ধুরা সত্যজিৎ রায় এই ছবিগুলি তৈরি করেছিলেন তোমাদের জন্য। এই ছবিগুলির আবেদন কোনওদিন ফুরোবার নয়। জন্মশতবর্ষে সবাই আমরা তাঁকে প্রণাম জানাই।
ছবি: সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে