বিকেলবেলায় স্কুলের দালানে দাঁড়িয়ে নিশিদাদা ঢং ঢং করে ছুটির ঘণ্টা বাজায়। ঠিক তখনই স্কুল কম্পাউন্ডের নিমগাছের ডালে বসে একটা টিয়াপাখি সবুজ ডানা ঝাপটায় এবং লাল টুকটুকে ঠোঁট বাড়িয়ে নিমফল খায়। ইদানীং রোজ টিটো পাখিটাকে দেখতে পাচ্ছে।
টিটোর ভালো নাম দেবর্ষি। বাড়িতে তো বটেই, স্কুলেও অনেক বন্ধু তাকে টিটো বলে ডাকে। তার প্রিয় বন্ধু তপন। ডাকনাম টিপু। তপনকেও স্কুলের অনেক বন্ধু টিপু বলে ডাকে।
মাস্টারমশাইরা ছাত্রদের ভালোনাম ধরেই ডাকেন।
স্যার বললেন, ‘ব্ল্যাকবোর্ডে অঙ্ক কষছি। দেবর্ষি ও তপন তোমাদের এদিকে মন নেই। গল্প করছ কেন!’
ওরা সেই টিয়াপাখিটাকে নিয়ে আলোচনা করছিল। ভূতনাথ স্যারের ধমকে লজ্জা পায়। উঠে দাঁড়ায়। মাথা নিচু করে থাকে। ক্লাসের মধ্যে তখন আটতিরিশটা ছাত্র নিজেদের মধ্যে ফিসফিস করে বলে, ‘বেশ হয়েছে। এবার ভূতনাথ স্যার এসে টিটো ও টিপুর কান মলে দেবেন।’
কিন্তু ভূতনাথ ভৌমিকের মনটা কেমন নরম হয়ে যায়। স্কুল কম্পাউন্ডের কদম গাছের ডালে বসে একটা কোকিল তখন কুহুকুহু করে ডাকছিল। তাই হয়তো উনি একটু উন্মনা হয়ে গিয়েছিলেন। টিটো ও টিপু জানে অঙ্কের স্যার ভূতনাথ ভৌমিক ছান্দসিক ছদ্মনামে কবিতা লেখেন। স্কুলে আর কেউ এই খবরটা জানে না।
অন্য একটা দিনের কথা টিটো-টিপুর মনে আছে। সেদিন তাড়াতাড়ি ছুটি হয়ে গিয়েছিল। ওরা বাড়ি ফিরছিল। ওদের যেতে হয় রেলস্টেশন ছাড়িয়ে।
ছুটির পর ওরা দেখেছিল ভূতনাথ স্যার হন্তদন্ত হয়ে স্কুল থেকে বেরিয়ে পড়ি কি মরি করে স্টেশনের দিকে একরকম ছুটে যাচ্ছেন। মাসের পাঁচ তারিখ। স্যার নিশ্চয়ই আজ মাইনে পেয়েছেন। হয়তো কলকাতায় ফ্যামিলি থাকে। ট্রেন ধরার জন্য ছুটছেন।
ওরা স্যারের পিছন পিছন চলল। অবশেষে দেখল উনি স্টেশনের কাছে একটা পত্র-পত্রিকার স্টলের সামনে এসে দাঁড়ালেন। তারপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে কী যেন খুঁজতে লাগলেন। ততক্ষণে ওরা স্যারের পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে।
স্টল-মালিক বললেন, ‘দাঁড়ান। দাঁড়ান। দিচ্ছি। এখনও ডিসপ্লে করা হয়নি। আসলে কী জানেন স্যার, ওই ‘নিরিবিলি’ ম্যাগাজিনের তেমন চাহিদা নেই। কেবল রিটায়ার্ড জজ হেরম্ববাবুর অনুরোধে একটা লোক মাসের গোড়ার দিকে বর্ধমান থেকে কয়েক কপি এই নিরিবিলি পত্রিকা নিয়ে আসে। হেরম্ববাবুও আপনার মতো এতে কবিতা লেখেন। এই সংখ্যায় আপনার আর জজসাহেবের কবিতা আছে। সত্যি কথা বলছি স্যার। আজকালের কবিতা বুঝতে পারি না। সত্যেন দত্ত কালিদাস রায়ের মতো কবিতা লিখুন না স্যার।’ ভূতনাথবাবু খুকখুক করে হাসেন। দোকানদার থলি থেকে নিরিবিলি বার করে তাঁকে দেন এবং পয়সা নেওয়ার সময় বলেন, ‘তবে আপনার ছদ্মনামটি চমৎকার। সত্যেন দত্তকে নাকি ছন্দের জাদুকর বলা হতো!’
স্যার বলেন, ‘হ্যাঁ। বলা হতো।’ নিরিবিলি ব্যাগে রেখে ঘুরে দাঁড়াতেই ওদের দেখতে পান।
টিটো জিজ্ঞেস করে, ‘স্যার, আপনি কবিতা লেখেন!’ সঙ্গে সঙ্গে টিপু বলে, ‘একটু দেখান না স্যার।’
ওদের নিয়ে ভূতনাথ স্যার স্টল থেকে খানিকটা দূরে সরে এসে বলেন, ‘চলো, সামনের দোকানে বসে চা খাওয়া যাক।’ টিপু বলল, ‘আমরা সারাদিনে এক কাপ চা খাই। সকালে খেয়েছি। আর খাব না। শুধু আপনার কবিতাটা আমরা একবার দেখব।’
স্যার বলেন, ‘তাহলে চা খেয়ো না। যদুর দোকানে গরম গরম কচুরি ভাজছে। তাই খাওয়া হবে। এসো।’
দুই ছাত্রকে নিয়ে যদুর দোকানে ঢুকে একটা বেঞ্চিতে বসলেন। কচুরির অর্ডার দিলেন। যদু বলল, ‘মাস্টারমশাই দশ মিনিট বসুন। গরম গরম ভেজে দিচ্ছি।’
সেই অবসরে ভূতনাথ স্যার ‘নিরিবিলি’ খুলে তাঁর কবিতা ওদের পড়তে দিলেন। ওরা পড়ল। একবর্ণ অর্থও উদ্ধার করতে পারল না। তবে বলল, ‘খুব ভালো হয়েছে স্যার। আপনার ছদ্মনামটাও চমৎকার।’
স্যার খুশি হয়ে বললেন, ‘এখন তোমরা এই কবিতা বুঝতে পারবে না। আরও একটু বড় হলে বুঝতে পারবে।’
কোকিলটা তখনও ডাকছিল। বোর্ডে অঙ্ক কষতে কষতে স্যার থেমে গিয়েছেন। সারা ক্লাস অপেক্ষা করছে। কই, স্যার তো এগিয়ে এসে টিটো ও টিপুর কান মলে দিচ্ছেন না! টিটো ও টিপুকে বসতে বলে ভূতনাথ ভৌমিক চেয়ারে বসলেন। একটু পরে ঢং ঢং করে পিরিয়ড শেষের ঘণ্টা পড়ল।
দুই
ছুটির পর স্কুল থেকে বেরিয়ে ওরা হাঁটছে। আকাশ দিয়ে উড়ে গেল একঝাঁক টিয়াপাখি। লাহাদের জীর্ণ বাড়ির প্রাচীন বাগানে পেয়ারা গাছের ডালে বসে একটা কোকিল ডাকছে। ওরা পোস্ট অফিসের সামনে এসে দেখল ভূতনাথ স্যার ওই অফিসে ঢুকছেন।
কয়েকদিন হল ভূতনাথ স্যার স্কুলে আসছেন না। ওঁর নাকি জ্বর হয়েছে। ওঁকে দেখে মনে হল স্যার ভালো নেই। দাড়িটাড়ি কামাননি। চুল উসকো-খুসকো। গায়ের নীল জামাটা ময়লা। ধুতিও। অসুস্থ শরীর নিয়ে কেন বাড়ি থেকে বেরিয়েছেন!
টিপু ছুটে গিয়ে স্যারকে ধরল। টিটোও এসে গিয়েছে।
টিপু বলল, ‘অসুস্থ শরীর নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়েছেন কেন!’ স্যারের হাতটা ধরেই টিটো বলল, ‘এ কী! আপনার গা যে জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে!’
উনি বললেন, ‘ও কিছু নয়। তোমরা যাও। এখানকার দরকার সেরেই বাড়ি ফিরে যাব। ছকুলাল রিকশা নিয়ে অপেক্ষা করছে।’
টিপু বলল, ‘না স্যার। কাজটা সেরে নিন। আমরা অপেক্ষা করছি। আপনাকে রিকশায় তুলে দিয়ে আমরা বাড়ি ফিরব।’ টিটো জিজ্ঞেস করল, ‘এখানে কী কাজ স্যার!’
ভূতনাথবাবু বোধহয় ক্লান্তি বোধ করছিলেন। পোস্ট অফিসে একটা ফাঁকা বেঞ্চি পেয়ে বসে পড়লেন। স্যারের পাশে ওরাও বসল।
ভূতনাথ ভৌমিকের বয়স পঞ্চাশ একান্ন হবে। মাথার চুল পাতলা। চোখে হাই পাওয়ারের চশমা। সুপুরুষ নন। সবসময় নীলজামা আর ধুতি পরেন। কাঁধে ঝোলা ব্যাগ থাকে। জটিল জটিল অঙ্ক অনায়াসে সলভ করে দেন। কখনও তাঁকে মনে হয় রাগী। কখনও মনে হয় তিনি শিশুর মতো সরল।
একটু ধাতস্থ হয়ে স্যার বললেন, ‘তোমরা এবার বাড়ি যাও। আমি কাজ সেরে ফিরব। তোমাদের বাড়িতে নিশ্চয়ই মা-বাবা চিন্তা করছেন। আমি তো একা। সংসার-টংসার করা হয়নি। তাই চিন্তা করারও কেউ নেই।’
হঠাৎ টিপু বলল, ‘জানেন স্যার। দেবর্ষি টিয়াপাখি দেখতে পায়।’
ভূতনাথ স্যার ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছেন। টিটো খুব রেগে যাচ্ছে আর বিরক্ত হচ্ছে। কীভাবে কথা বলতে হয় টিপু এখনও শিখল না।
টিপু এবার পরিষ্কার করে ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিল।
শুনে-টুনে স্যার বললেন, ‘এর একটা মানে আছে বলে আমার মনে হয়। আমি যেমন মাঝে মাঝে কোকিলের ডাক শুনি। তুমিও কি কবিতা লেখো দেবর্ষি!’ টিটো মাথা নাড়ল।
স্যার বললেন, ‘ভবিষ্যতে একটা কিছু হবে বোধহয়। বিজ্ঞানী কিংবা ক্রিকেটার বা অন্য কিছু।
টিপু হতাশ গলায় বলল, ‘আমি তো কোনও পাখির ছবি দেখতে পাই না স্যার।’ স্যার বললেন, পাবে। পাবে। কেউ আগে পায়। কেউ পরে। এটি অবশ্য একান্ত আমার নিজের ধারণা মাত্র। এবার উঠে কাউন্টারে যেতে হবে। এবার ‘নিরিবিলি’র সম্পাদক ভাগ্যবান হালদার একগুচ্ছ কবিতা চেয়েছেন। সামনের সংখ্যা শারদীয় সংখ্যা। রেজিস্ট্রি ডাকে পাঠাতে হবে।’
ভূতনাথ স্যার নিজের ঝোলা থেকে একটা পুরুষ্টু লেফাফা বার করে কাউন্টারের দিকে এগলেন।
গল্প ও ছড়ার অলংকরণ : সুব্রত মাজী