উচ্চবিদ্যার ক্ষেত্রে বাধার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হতে হবে। কর্মপ্রার্থীদের ক্ষেত্রে শুভ যোগ। ব্যবসায় যুক্ত হলে ... বিশদ
বাসুদেব রঙ্গা সাবলে। নাসিকের কৃষক। পেঁয়াজ চাষ করেছিল সে। কিন্তু প্রকৃতি পাশে দাঁড়াল না। অনাবৃষ্টির শুখায় খেতেই শেষ হয়ে গেল আশা-ভরসা...। পাশে দাঁড়াল না মহাজনও। টাকা ফেরত দিতে হবে। কী করে? জানত না বাসুদেব। জানত না মহাজনও। যেভাবে হোক টাকা ফেরত দাও... সুদটা তো বটেই। গলায় ফঁাস জড়ানো শরীরে ছিল শুধুই সব হারানোর যন্ত্রণা। নাসিক মহাকুম্ভের ঠিক আগে।
এ দেশের চাষি বোঝে, দাম না পাওয়ার যন্ত্রণা। জানে, সেই আতঙ্ক কোথায় যেতে পারে। পরিবারের মানুষগুলো প্রতি রাতে ঘুমায় বুকভরা আশঙ্কা নিয়ে... পরদিন ঘুম থেকে উঠে বাড়ির লোকটাকে দেখতে পাব তো! আশপাশে কোথাও সেঁকো বিষ না থেকে যায়... কিংবা একগাছা দড়ি...। দাম না পেলে দু’বেলা দু’মুঠো জোটে না। সারা মরশুমের খাটনি হারিয়ে যায় কিছু ফড়ের দালালি, মহাজনের চোখ রাঙানিতে। মরশুমের শুরুতে ধার করার আগে তাই সে বারবার ভাবে... মেটাতে পারব তো? ফসলের দাম পাব তো? গ্যারান্টি ছিল না বাম জমানায়। ছিল না সহায়ক মূল্য, ছিল না ফড়েরাজ বন্ধ করার এতটুকু প্রয়াস... তাই চাষির ঘরে মৃত্যু আকছার ঘটনা। নাঃ, মৃত্যু নয়... আত্মহত্যা।
সংস্কার যজ্ঞে নেমেছে নরেন্দ্র মোদি সরকার। এবার পালা কৃষির। তিনটি অর্ডিন্যান্স এবং সংসদের ‘বহুমতে’ তা আইনে পরিণত করা। সেই সব দেখনদারির কারবার শেষ। নয়া কৃষি আইন বলবৎ হতে এখন শুধু রাষ্ট্রপতির সইয়ের অপেক্ষা। প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং বললেন, ‘আমিও কৃষক। এ সরকার কৃষকের স্বার্থ বোঝে। তাই এই বিল পাশ।’ বিরোধীরা মানল না। মানল না এনডিএর সবচেয়ে পুরনো শরিক শিরোমণি আকালি দলও। ‘সরকারকে বোঝাতে পারিনি’... এই হতাশা নিয়ে পদত্যাগ করলেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হরসিমরত কউর বাদল। আকালি দলের নেত্রী। কেন? সরকারের মধ্যেই যদি সমীকরণে গলদ দেখা যায়, তাহলে কি বলা যায় যে, সব ঠিক আছে? না সব ঠিক নেই। সেটা নরেন্দ্র মোদিও বিলক্ষণ বোঝেন। তাই চলছে সাফাই... লাগাতার।
নতুন বিলে আতঙ্ক কোথায়? মূলত চারটি... বিক্রিবাটা বা লেনদেনের জায়গা (ট্রেড এরিয়া), ব্যবসায়ী (ট্রেডার), বাজার দর (মার্কেট ফি) এবং সমস্যা হলে তার সমাধানের প্রক্রিয়া (ডিসপুট রেজল্যুশন)।
প্রথমে দেখা যাক ‘ট্রেড এরিয়া’ বলতে কী বলা হচ্ছে। নয়া ব্যবস্থাপনায় ট্রেড এরিয়া হল এমন এলাকা বা জায়গা, যেখানে ফসল উৎপাদন বা সংগ্রহ হয়। তার মধ্যে রয়েছে, খামার চত্বর, কারখানা চত্বর, গুদাম, হিমঘর, ফসলের গোলা, বা দেশের এমন যে কোনও জায়গা, যেখানে কৃষিজাত দ্রব্যের ব্যবসায়িক লেনদেন চলতে পারে। এই তালিকায় কিন্তু কিষাণ মান্ডি, বাজার, বা বাজার চত্বরের উল্লেখ নেই। অর্থাৎ রাজ্যের আইন মোতাবেক তৈরি হওয়া মান্ডি বা পাইকারি বাজারের সেই অর্থে কোনও গুরুত্ব থাকছে না। মান্ডি বা পাইকারি বাজারে জায়গা পাওয়ার জন্য লাইসেন্স দরকার। তা না থাকলে সেই ব্যবসায়ী বৈধ নয়। ফড়ে বা সেই জাতীয় লোকজন যাতে কৃষকদের ঠকাতে না পারে, সেই বিষয়টা নিশ্চিত করার জন্যই এই নিয়ম। কিন্তু নতুন বিলে সে সবের বালাই নেই। আইন কার্যকর হলে মান্ডিগুলিকে তাদের একটা লক্ষ্মণরেখার মধ্যে বেঁধে দেওয়া হবে। যা ভেঙে বেরনো তাদের পক্ষে সম্ভব হবে না। বরং বেসরকারি সংস্থা বা খাদ্যপণ্য জগতের কর্পোরেট চাঁইদের পোয়াবারো। এক একটা মান্ডি এখন প্রায় ২০০টি গ্রামকে একসঙ্গে পরিষেবা দিতে পারে। তাদের ‘বন্দি’ করে ফেললে কর্পোরেটদের পরিধি বাড়বে ঠিকই, কিন্তু ধীরে ধীরে ধসে পড়বে কিষাণ মান্ডি। মূল ব্যবসায়ী বা ‘ট্রেডার’ হয়ে উঠবে কর্পোরেট। এই ট্রেডার কারা? যারা সরাসরি কৃষকদের থেকে শস্য কিনবে, তারাই ট্রেডার। দেশের যে কোনও জায়গায় এই ট্রেডিং চলতে পারে। এরপর থেকে ফসলের উপর রাজ্যের কোনও অধিকার বলতে কিছু থাকবে না। গুজরাত থেকে কোনও ‘ট্রেডার’ এসে বাংলার ধান কিনে নিয়ে যেতেই পারে। পাইকারি, মজুতদার, রপ্তানিকারী, বা খুচরো বিক্রেতা—কোথাও বাধা থাকবে না। শুধু প্যান কার্ড থাকলেই হল। কিষাণ মান্ডির জন্য বা রাজ্যের এপিএমসি আইনের আওতাধীন লাইসেন্স? দরকার নেই।
কেন্দ্রীয় সরকার দাবি করছে, মধ্যসত্ত্বভোগী বা ফড়েদের রাজত্ব এবার শেষ হবে। সরাসরি ক্রেতারা যাবেন কৃষকের কাছে। কিনে নেবেন ফসল। সঠিক দামটা পাবেন চাষি। সত্যিই কি তাই হবে? কৃষক কি জানতে পারবেন, কে ফড়ে, আর কে নন? ভুয়ো প্যানকার্ড গলায় ঝুলিয়ে প্রতারক যদি পাঁচ কুইন্টাল ধান কিনতে যান, দালানে বসে থাকা চাষির পক্ষে তাকে চেনা সম্ভব নয়। তাঁরা কিন্তু চেনেন কিষাণ মান্ডির অমুক মণ্ডল বা তমুক হালদারকে। পাঞ্জাবে না হয় মান্ডিতে ফসল বিক্রি করতে গেলে সাড়ে আট শতাংশ লেভি দিতে হয়। যার মধ্যে মার্কেট ফি তিন শতাংশ, গ্রামীণ উন্নয়ন চার্জ তিন শতাংশ এবং ‘অরহতিয়া কমিশন’ আড়াই শতাংশ। অরহতিয়া কী? সোজা ভাষায় মধ্যসত্ত্বভোগী। পাঞ্জাবের মতো ধনী কৃষিনির্ভর রাজ্যে একটা বড় অংশ এই ‘পেশা’তেই পেট চালায়। সেখানকার কৃষকরাও যা মেনে নিয়েছেন। বছরের পর বছর ধরে এটাই চলে আসছে। পশ্চিমবঙ্গে অবশ্য এমন কোনও লেভি নেই। মান্ডিতে ধান বিক্রি করতে গেলে কোনও বাড়তি টাকা বা কমিশনও গুনতে হয় না। বরং এখানে চাষি জানেন, সরকারি সহায়ক মূল্যটা কত। মান্ডিতে সেই দামের থেকে নীচে নামা মুশকিল। কৃষক তাহলে তাঁর উৎপাদিত শস্য সরকারকেই বিক্রি করে দেবে। যেমন ধরে নেওয়া যাক, চলতি মরশুমে এক কুইন্টাল ধানের সহায়ক মূল্য ১৮১৫ টাকা। আগামী মরশুমে তা আরও ৫৩ টাকা বাড়বে। এমনটা কেন হয়? বিদ্যুৎ, সার, মজুরি... এই সবই সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাড়ে। সরকার সহায়ক মূল্য বাড়িয়ে সেই বাড়তি খরচকেই ভারসাম্যে নিয়ে আসে। কিন্তু সহায়ক মূল্য বা সরকারি দামের গ্যারান্টি না থাকলে কর্পোরেট দুনিয়া যেমন খুশি দাম দেবে। প্রথম প্রথম একটু বেশিই। মান্ডি বাজারের কাঠামো ধসে পড়লে আঘাত সরাসরি পড়বে কৃষকদের উপর। তখন ছড়ি ঘোরাবে কর্পোরেট। এই পরিস্থিতিতে বেসরকারি বাজার যা দাম দেবে, তাতেই সন্তুষ্ট থাকতে হবে কৃষকদের। অর্থাৎ, শুরু হবে কর্পোরেট মনোপলি। কৃষিক্ষেত্রেও একচ্ছত্র আধিপত্য বেসরকারি জগতের। কোনও সমস্যা হলে? সমঝোতা করে নিতে হবে ব্যবসায়ীর সঙ্গে। খুব বেশি হলে এসডিওর কাছে দেওয়া যাবে আবেদনপত্র। তিনি সেই আবেদন পৌঁছে দেবেন তাঁরই তৈরি করা বোর্ডের কাছে। যারা বিচার করবে, কৃষকের আবেদন কতটা ঠিক। অর্থাৎ, আদালতের দরজায় কড়া নাড়তে পারবেন না কৃষক। বন্ধ হচ্ছে সেই পথ। চাষ করে যেতে হবে মুখ বুজে... মিলবে না দাম। কর্পোরেটের হাত ধরে ফিরবে নীল চাষের সিঁদুরে মেঘ।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সাফাই দিতে আসরে নেমেছেন। বলছেন, মান্ডি বন্ধ হবে না। ভয় পাবেন না। এ এক ঐতিহাসিক বিল। কৃষকের স্বার্থে। সত্যিই কি তাই? আমাদের ভারত সরকার বোধহয় দূরেরটা ভাবছে না। আর না হলে বানিয়াদের সুবিধার্থে এক সুদূরপ্রসারী অঙ্ক রয়েছে এই সরকারের। বিরোধীরা কিন্তু এই অভিযোগেই সরব হয়েছে। তুমুল হট্টগোল হয়েছে রাজ্যসভায়। ওয়াক আউট, ওয়েলে নেমে বিক্ষোভ, আট এমপি সাসপেন্ড... তারপরও পাশ হয়ে গিয়েছে বিল। সংখ্যাগরিষ্ঠতায়। আধিপত্য এখানেও। বিজেপির আধিপত্য, নরেন্দ্র মোদির আধিপত্য। বিজেপি সরকার এখন যা চাইবে, সেটাই হবে। অঙ্ক তাই বলছে। যে বিল আনা হবে, সেটাই হেলায় পাশ হয়ে যাবে। বিরোধী মতের গুরুত্ব নেই। কারণ, আমরা... ভারতবাসী ভোটের ঝুলি উজাড় করে বিজেপিকে কেন্দ্রের কুর্সিতে বসিয়েছি। ‘ভোটার দেবতা’র বরলাভ করে এখন নরেন্দ্র মোদির তূণীর সর্ব অস্ত্রে সজ্জিত। তাই সংস্কার হবে। নতুন নতুন আইন আসবে। সংশোধন হবে। মেনে নিতে হবে মানুষকে... কৃষককে।
২০১১ সালের পর থেকে বাংলায় ভূতনাথ পালের সংখ্যা কমেছে। গত দু’বছরে ফসলের দাম না পাওয়ায় একজন কৃষকও এ রাজ্যে আত্মঘাতী হয়নি। কিন্তু নতুন আইনে যদি রাজ্যের সব ক্ষমতা কেড়ে নেওয়া হয়, তাহলে কী হবে? আমরা কি নতুন, আধুনিক ভারতের দিকে আরও একধাপ এগব? নাকি ফিরে যাব ফেলে আসা অন্ধকারাচ্ছন্ন অতীতে... যেখানে মৃত্যুই কৃষকের একমাত্র মুক্তির পথ।