উচ্চবিদ্যার ক্ষেত্রে বাধার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হতে হবে। কর্মপ্রার্থীদের ক্ষেত্রে শুভ যোগ। ব্যবসায় যুক্ত হলে ... বিশদ
ছোট্ট বন্ধুরা তোমরা জানো একসময় শিশুশিল্পী যাঁরা ছিলেন তাঁরা বড় বড় শিল্পীদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অভিনয় করে দর্শকদের ভেল্কি দেখিয়ে দিয়েছিলেন। বড় বয়সে তাঁদের অনেকেই হারিয়ে গিয়েছেন চিরদিনের জন্য। কেউ কেউ আবার উঠেও এসেছেন। তাঁদের সবার কথা তোমাদের জানাতে বসেছি। প্রথমে সত্যজিৎ রায়ের ছবির শিশুশিল্পীদের কথাই ধরা যাক। সত্যজিৎ রায়ের প্রথম ছবি ‘পথের পাঁচালী’র দুটি মুখ্য চরিত্র অপু আর দুর্গা। এই দুটি চরিত্রে সত্যজিৎ রায় নিয়ে এলেন শ্রীমান সুবীর এবং উমা দাশগুপ্তকে। তাদের প্রাণবন্ত অভিনয় দেখে কে বলবে যে এদের প্রথম ছবি এটি। কিন্তু এদের দু’জনের ক্ষেত্রেই দেখা গিয়েছে ‘পথের পাঁচালী’ এদের প্রথম এবং শেষ ছবি। সত্যজিৎ রায়ের পরবর্তী ছবি ‘অপরাজিত’ অপুরই কাহিনী। সেখানে অপুবেশী শিল্পীর নাম পিনাকী। পিনাকী অবশ্য সুবীরের মতো দর্শক আকর্ষণ করতে পারেননি। রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষের বছরে সত্যজিৎ রায় রবীন্দ্রনাথের তিনটি গল্প নিয়ে যে ‘তিন কন্যা’ ছবি নির্মাণ করলেন, তার মধ্যে ছিল ‘পোস্টমাস্টার’ গল্প। সেই গল্পের রতন চরিত্রে নবাগতা শিশুশিল্পী চন্দনাকে নিয়ে এলেন সত্যজিৎ রায়। অভূতপূর্ব চরিত্রায়ন। সেই চন্দনা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রথম ও শেষ ছবি ‘পোস্টমাস্টার’। সত্যজিৎ রায় যখন তাঁর ফেলুদা সিরিজকে তুলে আনলেন বড় পর্দায়, তখন প্রথম ছবিটি হল ‘সোনার কেল্লা’। বিরাট শিল্পী তালিকা সেই ছবিতে। কিন্তু সবাইকে চমকে দিলেন মুকুল রূপী শিশুশিল্পী কুশল চক্রবর্তী। এখনও তিনি চুটিয়ে নিয়মিত অভিনয় করে চলেছেন বিভিন্ন ধারাবাহিকে। সত্যজিৎ রায় তাঁর ‘শাখা-প্রশাখা’ ছবিতে অসংখ্য শিল্পীর মাঝখানে নিয়ে এলেন এক শিশুশিল্পীকে। নাম মাস্টার বিট্টু। যদিও মাস্টার বিট্টুর প্রথম অভিনীত ছবির নাম অঞ্জন চৌধুরীর ‘ছোট বউ’। বিট্টুর ভালো নাম সোহম। বাংলা ছবির এখন দুরন্ত নায়ক এই সোহম চক্রবর্তী।
তপন সিংহের ছবিতেও শিশুশিল্পীদের আবির্ভাব দর্শকদের নজর কেড়েছে। রবীন্দ্রনাথের ‘কাবুলিওয়ালা’র চিত্ররূপ দিলেন তপন সিংহ। নাম ভূমিকায় ছবি বিশ্বাস। মিনির মা ও বাবা মঞ্জু দে, রাধামোহন ভট্টাচার্য। মিনি করবে কে? পাওয়া গেল একটি মেয়েকে। শর্মিলা ঠাকুরের বোন টিংকু ঠাকুরকে। তার আধো আধো কণ্ঠস্বর, বিস্ফারিত দুটি চোখ, ছোট ছোট হাত-পা নেড়ে গান নাচ একবার যিনি দেখেছেন তিনি কোনওদিন ভুলতে পারবেন না। এই পর্যন্ত। টিংকু আর অভিনয় করেননি। তপন সিংহ’ অতিথি’ গল্পের চিত্ররূপ-এর সময় জমিদার তনয়া চারুশশীর জন্য নির্বাচন করলেন প্রখ্যাত অভিনেতা ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের কন্যা বাসবীকে। নিখুঁত নির্বাচন। জেদি অহংকারী চারুশশীকে মূর্ত করেছিলেন বাসবী। পরে অবশ্য তিনি আর অভিনয় করেননি। প্রসঙ্গত ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুত্র গৌতম বাবার হাত ধরে শিশুশিল্পীর চরিত্রে ‘কাঞ্চন মূল্য’, ‘অর্ধাঙ্গিনী’ ছবিতে অভিনয় করেছিলেন। ‘অতিথি’ ছবির তারাপদ চরিত্রে তপন সিংহ নিয়ে এলেন পার্থ মুখোপাধ্যায়কে। এর আগে পার্থ চিত্ত বসুর ‘মা’ ছবিতে সন্ধ্যা রানীর ছেলের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। পরবর্তীকালে অনেকগুলো ছবিতে নায়ক হয়েছিলেন পার্থ মুখোপাধ্যায়।
পঞ্চাশের দশকের এক স্মরণীয় শিশুশিল্পী মাস্টার তিলক। স্মরণীয় ছবির তালিকায় রয়েছে হসপিটাল, দুই ভাই, কানামাছি, দেড়শো খোকার কান্ড, তরণীসেন বধ, মায়ার সংসার প্রভৃতি ছবি। উত্তরকালে তিনি দুটি ছবির নায়ক হয়েছিলেন, ‘আনন্দ মেলা’ এবং ‘কালো চোখের তারা’। ষাটের দশকের আরেক স্মরণীয় শিশুশিল্পী মাস্টার শংকর। প্রথম ছবি ‘বাদশা’। প্রথম ছবিতেই বাজিমাত। তার মুখের গানগুলি আজও জনপ্রিয় হয়ে আছে। ছোটবেলার ছবিগুলির মধ্যে রয়েছে নতুন তীর্থ, বৌদি, তীরভূমি, লবকুশ, স্ত্রী প্রভৃতি। উত্তরকালে অঞ্জন চৌধুরীর প্রায় সব ছবিতেই চরিত্রাভিনয় করেছেন। তিনি পেশায় অধ্যাপক নেশায় অভিনেতা। চুপিচুপি বলে রাখি সেই মাস্টার শংকর হলাম আমি। ছোটবেলায় পড়াশোনায় কোনওদিনও ফাঁকি দিইনি। ষাটের দশকের আরেক শিশুশিল্পী মাস্টার অরিন্দম। সকলেই তাকে একডাকে চেনে ‘হংসরাজ’ ছবির হংসরাজ চরিত্রের জন্য। কিন্তু অরিন্দমের শুরু ‘প্রস্তর স্বাক্ষর’ ছবি দিয়ে। বিভিন্ন ধারাবাহিকের এখন নিয়মিত অভিনেতা। সেইসঙ্গে চার্বাক গোষ্ঠীর বিভিন্ন নাটকের পরিচালক অরিন্দম।
ষাটের দশকেই পেলাম প্রসেনজিৎকে। বিশ্বজিতের ‘ছোট্ট জিজ্ঞাসা’ ছবিতে তাঁর আবির্ভাব। এছাড়া ‘রক্ত তিলক’ ছবিরও শিশুশিল্পী প্রসেনজিৎ। পরবর্তীকালে ‘অমর সঙ্গী’ ছবির মধ্য দিয়ে নায়ক হিসেবে তাঁর প্রতিষ্ঠা ঘটে গেল বাংলা ছবিতে। পাশাপাশি মনের মানুষ, অটোগ্রাফ, বাইশে শ্রাবণ, প্রাক্তন, দৃষ্টিকোণ প্রভৃতি ছবিতে প্রসেনজিৎ জাত অভিনেতার পরিচয় দিয়েছেন। প্রসেনজিতের কথা উঠলেই দেবশ্রী রায়ের কথা উঠে আসে স্বভাবতই। দেবশ্রী যখন বালিকা তখন তাঁর নাম চুমকি। চুমকির প্রথম ছবি ‘বালক গদাধর’। তরুণ মজুমদার যখন ‘কুহেলি’ ছবিতে চুমকিকে বিশ্বজিৎ-সন্ধ্যা রায়ের মেয়ে হিসেবে নিয়ে এলেন, তখনই ভাবীকালের অভিনেত্রীর পরশ পাওয়া গিয়েছিল। ‘দাদার কীর্তি’র অন্যতম নায়িকা হিসেবে তাঁর প্রতিষ্ঠা হল। একের পর এক স্মরণীয় অভিনয়। ‘উনিশে এপ্রিল’ ছবির সূত্রে সেরা অভিনেত্রীর রাষ্ট্রপতির পুরস্কার লাভ করেন ১৯৯৬ সালে। দেবশ্রীর আগে এক ডাকসাইটে বালিকা শিশুশিল্পী পঞ্চাশের দশকের বাংলা ছবিতে একচেটিয়া অভিনয় করেছিলেন। তিনি শিখারাণী বাগ। ‘অগ্নিপরীক্ষা’ ছবিতে ছোট তাপসী হলেন শিখা, বড় তাপসী হলেন সুচিত্রা সেন। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটল ‘শিল্পী’ ছবিতেও। কালি প্রসাদ ঘোষ পরিচালিত ‘রানী রাসমণি’ ছবিতে তিনি ছোট রাসমণি। তবে তিনি প্রথম নজরে পড়েন ‘মেজদিদি’ ছবিতে কানন দেবীর কন্যার চরিত্রে। ‘প্রণাম তোমায় ঘনশ্যাম’ গানটির সময় তাঁর সেই মিষ্টিমুখ দর্শক-মনে আঁকা রয়েছে। বহুদিন হল ছবির জগৎ থেকেই তিনি সরে রয়েছেন।
শিশুশিল্পী হিসেবে এখন কয়েকজনের কথা বলব যাঁরা পরবর্তীকালে সুনাম বজায় রেখেছিলেন, কিন্তু এখন এঁরা প্রয়াত। মাস্টার বিভু ছোটবেলায় একচেটিয়া অভিনয় করেছেন। মাঝে দীর্ঘ বিরতি। আবার ফিরলেন ‘চিরকুমার-সভা’ ধারাবাহিকের মধ্য দিয়ে। এক এক করে জটায়ু চরিত্রের শিল্পীরা যখন প্রয়াত, তখন সন্দীপ রায় বাছলেন বিভু ভট্টাচার্যকে। ‘কৈলাসে কেলেঙ্কারি’, ‘টিনটোরেটোর যীশু’, ‘বোম্বাইয়ের বোম্বেটে’, অবশেষে ‘রয়েল বেঙ্গল রহস্য’তে জটায়ু চরিত্রের শিল্পী বিভু। শেষোক্ত ছবিতে ডাবিং শেষ করে তিনি মারা গিয়েছেন। মাস্টার সুখেন ‘লালু ভুলু’ ছবির খোঁড়া ভুলু। দুর্দান্ত অভিনয়। ‘দাসীপুত্র’, ‘বিন্দুর ছেলে’, ‘ইন্দ্রনাথ’, ‘পরেশ’ ছবিগুলোতেও তিনি শিশুশিল্পী হিসেবে কাজ করেছেন। পরবর্তীকালে পরিচালক হলেন এবং নিজের কয়েকটি ছবিতে নায়কও হলেন। মাস্টার সৌমিত্র ‘সুভা ও দেবতার গ্রাস’ ছবির ‘দেবতার গ্রাস’ অংশে বিধবা রমণীর একমাত্র পুত্রের চরিত্রে। ‘মহাশ্বেতা’ সহ আরও কয়েকটা ছবিতে সৌমিত্র শিশুশিল্পীর চরিত্রে কাজ করেছেন। পরবর্তীকালে একচেটিয়া ভিলেনের চরিত্রে (অমর সঙ্গী, গুরুদক্ষিণা, অঞ্জলি, হীরক জয়ন্তী প্রভৃতি ছবি)। মাস্টার রমাপ্রসাদ-এর প্রথম ছবি ‘পান্না’। উত্তরকালে মূলত নাটকের লোক হয়ে উঠেছিলেন রমাপ্রসাদ বণিক।
এবারে এমন কয়েকজন শিশুশিল্পীর কথা বলব যারা পরবর্তীকালে সরে গিয়েছেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন সত্যজিৎ রায়ের ‘মহানগর’ এবং মৃণাল সেনের ‘প্রতিনিধি’ ছবির মাস্টার প্রসেনজিৎ। মৃণাল সেনের ‘অবশেষে’, ‘পুনশ্চ’ ছবির মাস্টার কুনাল। ঋত্বিক ঘটকের ‘বাড়ি থেকে পালিয়ে’ ছবির মাস্টার পরম ভট্টরক লাহিড়ী।
রক্তপলাশ, কাল স্রোত ছবির মাস্টার বাসুদেব, নিশিপদ্ম সহ বেশ কয়েকটি ছবির মাস্টার মলয়, জয়জয়ন্তী ছবির মাস্টার সম্রাট, ছেলে কার সহ বেশ কয়েকটি ছবির মাস্টার বাবুয়া, পরিবর্তন ছবির মাস্টার সত্যব্রত, বাবলা ছবির মাস্টার বীরেন, লালকুঠি ছবির মাস্টার পার্থ, ফুলেশ্বরী, দত্তা প্রভৃতি ছবির মাস্টার জমিদার, মানিক ছবির মাস্টার তৃণাঞ্জন, হীরে মানিক ছবির মাস্টার বাপ্পা ও মাস্টার সৌরভ, শত্রু, একান্ত আপন ছবির মাস্টার তাপু, বিদ্রোহী, দোলনচাঁপা ছবির মাস্টার স্বর্ণেন্দু তেমনি কয়েকজন শিশুশিল্পী যাঁরা উত্তরকালে হারিয়ে গেছেন। যে ছবিগুলির নাম বললাম, সেই সব ছবিগুলিতে এইসব শিশুশিল্পীর কাজ দর্শকদের মনে ভীষণভাবে দাগ কেটে গিয়েছিল।
ছবি: সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে