কাজকর্মের ক্ষেত্রে দিনটি বিশেষ শুভ। নতুন যোগাযোগ ও উপার্জন বৃদ্ধির ক্ষেত্র প্রস্তুত হতে পারে। বিদ্যায় ... বিশদ
আসলে আমরা খেয়াল না করলেও আমাদের চারপাশের হাওয়ায় এখনও দিব্যি নিঃশ্বাস নেয় আঠেরো-উনিশ শতকের কলকাতা। আর সেই পুরনো কলকাতার স্মৃতিকে ধরে রাখার অন্যতম প্রতীক হল— পরী। দীনেশচন্দ্র সেন তাঁর পূর্ববঙ্গ গীতিকার ফুটনোটে বলেছেন যে, বৃন্দাবন দাসের চৈতন্য ভাগবতের আদিখণ্ডে ‘মধুমালা পরী’-র উল্লেখ আছে। তাই কলকাতার পরীদের উৎস খুঁজতে ইউরোপ যাত্রা করলে অনেকেই আপত্তি তুলবেন। কিন্তু কলকাতার স্থাপত্য থেকে আসবাব হয়ে বিয়ের পদ্যের হলুদ গোলাপি কাগজে ছাপা পরীদের চেহারা ও হাবভাব খুঁটিয়ে দেখলে ইউরোপীয় উৎস আমাদের দৃষ্টি এড়ায় না। কেলটিক অঞ্চলে প্রাচীন খ্রিস্টীয় বিশ্বাসের কেন্দ্রে ছিল এই এঞ্জেল নামের পরীরা। মানুষের বিশ্বাস ছিল যে, স্বর্গলোকের ব্যাপার সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হন কবিরা। তারা নিজেদের রচনায় পরীদের আহ্বান করতেন, কারণ পরীরা ঈশ্বরের নাম গান করে। সেই মঙ্গলবার্তা বা মঙ্গলসঙ্গীতের প্রতীক পরীদের হাতে ভেঁপু। যা হুতোমও দেখেছিলেন এবং আপনিও দেখেন।
হ্যাঁ, আপনিও দেখেন। কলকাতার সবুজ ময়দানের উপর সাদা মুক্তোর মতো দেখতে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল। এর মাথায় ব্রোঞ্জ নির্মিত ১৬ ফুট উচ্চতার এই ‘এঞ্জেল অব ভিক্ট্রি’ নামের কালো রঙের পরীটিও ভেঁপু নিয়ে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিজয় ও পরবর্তী সময়ে শান্তি ও প্রগতির বার্তা ঘোষণা করে চলেছে সেই ১৯২০ সাল থেকে। নান্দনিকতা ছাড়াও তিন টন ওজনের ভাস্কর্যটি লাইটনিং অ্যারেস্টার হিসাবে কাজ করে সমগ্র স্থাপত্যটিকে রক্ষা করে চলেছে।
মহারানির স্মৃতিসৌধ ছাড়াও কলকাতার আরও স্থাপত্যে পরীর ছোঁয়া দেখতে পাওয়া যায়। আর্মেনিয়ান স্ট্রিটের একটি বাড়ির মাথায় সারিবদ্ধ দাঁড়িয়ে আছে শান্ত পরীরা। যদিও বাড়িটির নাম ‘ঝগড়া কোঠি’। আবার প্রসন্নকুমার ঠাকুর স্ট্রিটে মল্লিক বাড়ির ছাদের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে স্থাপিত ইউরোপীয় মূর্তিটির ডানা নেই। তবে, এই মূর্তির কল্যাণে লোকে বাড়িটি পরীওয়ালা মল্লিক বাড়ি নামেই চেনে। পুরো পরিবারের অভিভাবক হিসাবে বাড়িতে পরীর মূর্তি বসানোর প্রথার অনুকরণেই এদেশে শুরু হয়েছিল ‘গার্জিয়ান এঞ্জেল’ বসানো। তেমনই একটি নমুনা শোভাবাজার স্ট্রিটের এক পুরনো বাড়ির পেডিমেন্ট আলো করে আজও দাঁড়িয়ে। অন্যদিকে, বৈঠকখানার ক্যাথলিক উপাসনালয়ের মতো বিভিন্ন গির্জায় বা খ্রিস্টান কবরখানায় প্রার্থনারত পরীর মূর্তি তাদের ধর্মীয় উৎসের কথা মনে করিয়ে দেয়। এছাড়াও বাগানের ফোয়ারা আর থামের গায়ে হেলান দেওয়া পরীরাও একসময় খুব চেনা দৃশ্য ছিল কলকাতার। তবে কলকাতার পরীদের মধ্যে আলাদা করে বলতে হয় রাধানাথ মল্লিক লেনে বসুমল্লিক পরিবারের ঠাকুরদালানের উঠোনে বসানো ঢালাই লোহার পরীদের কথা। এই পরীদের ডানা তাদের শিরস্ত্রাণের দুই পাশে। ইতালির ফ্লোরেন্স শহরে ‘ফ্লাইং মারকারি’ নামে ভাস্কর্যের ভঙ্গির ও ডানার অবস্থানের সঙ্গে মল্লিক বাড়ির ভাস্কর্যগুলির মিল থাকলেও পাশ্চাত্যের মূর্তি পুরুষের আর কলকাতার মূর্তিগুলি নারীর।
স্থাপত্য থেকে দৈনন্দিন ব্যবহারের জিনিসের দিকে দৃষ্টি দিলেও ডানা মেলা পরীদের উপস্থিতি নজর এড়ায় না। বাগানে সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য বসানো নকশাদার পাথরের ফোয়ারা অংশ হতো পরীরা। খাটের মাথার ও পায়ের দিকে ছত্রি বসানোর থামকে দু’টি বিশাল পরীর আকার দিয়ে তৈরি বিশেষ ধরনের শয্যা আসবাবের নামই ছিল ‘পরী-পালঙ্ক’। বাংলার সূত্রধর কারিগরদের শিল্প সুকৃতির নিদর্শন এই প্রাচীন আসবাবের নকশা। কাঠের সন্দেশের ছাঁচেও পরীর অবয়ব আজও ফুটিয়ে তোলেন চিৎপুর নতুন বাজারের কারিগররা। পুজোয় ব্যবহৃত পঞ্চপ্রদীপ থেকে নানা তৈজসপত্রে পরীর দেখা পাওয়া যেত। বাড়ির সিঁড়ি দিয়ে উপরে ওঠার মুখে বাবুরা দেখতেন সহাস্যে ধাতুর তৈরি পরীরা হাতে বাতি নিয়ে তাঁদের পথ আলোকিত করছে। ছোটদের খেলার জন্য অথবা শো-কেসে সাজিয়ে রাখার উদ্দেশ্যে পোর্সেলিনের পরীরাও আলো ছড়াত উনিশ শতকের কলকাতায়। প্রথমদিকে সে সব পুতুল ইউরোপ থেকে আসত। পরে কলকাতায় বেঙ্গল পটারি উৎপাদন শুরু করলে এখানেই তৈরি হতো।
আলাদা ভাবে উল্লেখ করতে হয় আরও একটি ছবির, যার মূল চরিত্ররা পরী। ফ্রান্সিস বি ব্রাডলি বার্টের বেঙ্গল ফেয়ারি টেলস বইটির ইলাস্ট্রেশন করেছিলেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সেই বইয়ের ছবিগুলির মধ্যে মধুমালা, দ্য রিথ অব সুইটনেস শীর্ষক গল্পে অবনীন্দ্রনাথের আঁকা ‘কালা পরী অ্যান্ড নিদ্রা পরী’ শীর্ষক পাতা জোড়া ছবিতে স্বপ্নের পরিবেশ ধরা হয়েছে। নরম সাদা মেঘ এবং জ্যোৎস্নার চাঁদের রয়েছে সঙ্গে রয়েছে কালো পরী আর নিদ্রা পরীর মুখের প্রোফাইল। সাধারণত পরীদের শুভ্র গাত্রবর্ণ ও ইউরোপীয় ছাঁদের চেহারায় কল্পনা করা হয়। এর সম্পূর্ণ বিপরীতে গিয়ে ১৯২০ সালে আঁকা অবনীন্দ্রনাথের পরীদের শ্যামবর্ণ ও মুখশ্রীতে স্পষ্ট ভারতীয় ছাপ যেন পরীদের দুনিয়াতেও নিয়ে এসেছিল স্বদেশির হাওয়া।
ছাপার কাগজে ছবির আবির্ভাবের পর নানা সন্দর্ভে পরীর ছবির ব্যবহার হতে শুরু হয়। পঞ্জিকার ছবিতে বা রূপকথার গল্পের পরীরা ভরিয়ে তুলেছে ছাপা বইয়ের পাতা। পিঠে ডানা আর হাতে তির-ধনুক নিয়ে ছোট শিশুর রূপে কিউপিডের ছবিও দেখা যেত বটতলার নানা প্রকাশনায়। বিয়ে উপলক্ষ্যে ছাপা পদ্যের কাগজে মালা হাতে পরীদের উপস্থিতি অপরিহার্য ছিল মাঙ্গলিক অনুষ্ঠানের প্রতীক হিসাবে।
কাঠ পাথর ধাতু আর কাগজে ছাপা ছবি ছাড়াও কলকাতার সঙ্গে জড়িয়ে আছে জীবন্ত পরীদের গল্পও। অযোধ্যার রাজা ওয়াজিদ আলি শাহ একজন সংস্কৃতিমনস্ক মানুষ ছিলেন। তিনি নাচ গানে পারদর্শী বাইজিদের এনে জড়ো করেছিলেন নিজের দরবারে। সোহাগ করে তাদের নাম দিয়েছিলেন— ‘পরী’। একটি আস্ত মহল তৈরি করেছিলেন লখনউ শহরে। সেই প্রাসাদের নাম ছিল ‘পরীখানা’। অযোধ্যার রাজ্যপাট কেড়ে নিয়ে তাঁকে কলকাতায় নির্বাসিত করা হয়। এই নির্বাসনে বেশ কয়েকমাস তাকে অস্থায়ীভাবে রাখা হয়েছিল একটি ঔপনিবেশিক স্থাপত্য শৈলীর বাড়িতে। যা বর্তমান বিএনআর হাউসে। সেসময় অনেকে সেটাকেই পরীখানা বলতেন। তবে ওয়াজিদ আলি মেটিয়াবুরুজে ছোটা লখনউ গড়ে তোলার সময় সুলতানখানা, আসমানি মঞ্জিল, রইস মঞ্জিল, কয়সর উল বয়জা সহ বেশ অনেকগুলি ইমারত গড়লেও আর কোনও পরীখানা তৈরি করেননি। নতুন জায়গায় মন বসানোর এই সব চেষ্টার মাঝে নিজের শৈশব-কৈশোর-যৌবন কাটানো গোমতী তীরে পরীদের আর হয়তো ফিরে পাননি নির্বাসিত মানুষটি। আমরা এর উত্তর জানি না। ইতিহাসও তার উত্তর দেয় না।