কাজকর্মের ক্ষেত্রে দিনটি বিশেষ শুভ। নতুন যোগাযোগ ও উপার্জন বৃদ্ধির ক্ষেত্র প্রস্তুত হতে পারে। বিদ্যায় ... বিশদ
মুখোমুখি দাঁড়িয়ে লালকেল্লা ও লাল মন্দির। একটি জগৎ বিখ্যাত। অন্যটি স্বল্প খ্যাত। লাল মন্দিরের উচ্চতা তো কম নয়। লালকেল্লার সামনের রাস্তায় দাঁড়িয়ে চাঁদনি চকের দিকে তাকালেই চোখে পড়ার কথা। অথবা সেভাবে পর্যটকদের দৃষ্টিগোচরই হয় না। ১৬৪৮ সালে সমাপ্ত হল লালকেল্লা। আগ্রা ঠিক পছন্দ নয়। তার উপর আবার ভূত আছে। সেটা তো আকবরও বলে গিয়েছেন। শাহজাহানেরও আগ্রা থেকে অন্যত্র চলে যাওয়ার ইচ্ছা প্রবল। শাহজাহানের কাছে পছন্দ ছিল দু’টি স্থান। নতুন রাজধানী এবং নতুন প্রাসাদের জন্য। লাহোর। দিল্লি। তাও আবার যেখানে দিল্লি শহর এতকাল ধরে গড়ে উঠেছে সেটা নয়। অর্থাৎ সেই পৃথ্বীরাজ চৌহানের লাল পিথোরা নয়। যার অদূরেই গড়ে উঠেছিল কুতুব প্রাঙ্গণ। আবার তুঘলকদের তুঘলকাবাদও নয়। হুমায়ুন দীনপনাহ নামক নগরী স্থাপন করেন। মধ্যদিল্লিতে। কিন্তু ভোগ করতে পারলেন কোথায়? কখনও শের শাহের কাছে পরাস্ত হয়ে পরিবার নিয়ে পালাতে হল। কখনও আবার লাইব্রেরির সিঁড়ি থেকে দ্রুত নামতে গিয়ে মৃত্যু। অতএব অভিশাপ সেই দীনপনাহকে জুড়েও। যা আজকের পুরনো কেল্লা চত্বর। শাহজাহান এ সব কিছুকে টপকে গিয়ে নতুন এক বিস্তীর্ণ খোলা প্রান্তরে তৈরি করলেন নতুন রাজধানীর নতুন আবাসস্থল। চোখ ধাঁধানো লালকেল্লা।
কিন্তু তিনি একা কিংবা পরিবার অথবা সেনাদের নিয়ে এসে বসতি স্থাপন করলেই তো হল না। দীর্ঘদিন ধরে তাঁর সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক বজায় রেখেছে, রণসহায়তার পারস্পরিক মিত্রতার বন্ধন যাদের সঙ্গে হয়েছে, প্রশাসন ও সেনাবাহিনীতে যাদের ধীরে ধীরে প্রবেশ করানো হয়েছে, এরকম বিশ্বস্ত ও যোগ্যদেরও তো নতুন কেল্লার প্রাঙ্গণে অথবা তাঁর সৃষ্ট নয়া নগরী শাহজাহানাবাদে নিয়ে আসতে হবে! অতএব আগরওয়াল জৈনদের, পূর্বতন মেহরৌলিতে বসবাসরত হিন্দুদের, আগ্রার গহনাশিল্পীদের নিয়ে এলেন। শাহজাহানাবাদে।
বিশেষ করে আগরওয়াল জৈনদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক মধুর ও স্বার্থের। বেশ কিছু সেনাপতি জৈন সম্প্রদায়ের। কোষাগার সংরক্ষক এবং হিসাব রক্ষকও জৈন সম্প্রদায়ভুক্ত ব্যক্তিদের হাতে। অতএব জৈনদের তিনি আমন্ত্রণ করে নিয়ে এসে জমি দিলেন। সেখানে বাড়িঘর তৈরি করে যাতে তারা থাকে।
কিন্তু থাকলেই তো হল না। ধর্মীয় সাংস্কৃতিক একটি জীবন তো আছে। একজন সেনাধ্যক্ষ নিজের তাঁবু এবং বাসস্থানে স্থাপন করলেন পার্শ্বনাথের মূর্তি। সেখানেই তিনি কাজ শেষে দিনে দু’বার প্রার্থনা করেন। পুজো করেন। প্রথমে একা। যেন পারিবারিক ব্যক্তিগত এক ইষ্টদেবতা। কিন্তু সেই সংবাদ ব্যবসায়ী অথবা প্রশাসনিক কর্মী জৈনদের কানেও পৌঁছল। একে একে তারাও আসতে শুরু করল। তাঁবু হলেও আদতে গড়ে উঠল একটি অঘোষিত মন্দিরই। তবে শাহজাহান আরও উদারতা দেখালেন। বললেন, ওখানেই একটুকরো অতিরিক্ত জমি নিয়ে পরিপূর্ণ মন্দির করে ফেলছ না কেন তোমরা?
তাই হল। ক্ষুদ্র একটি প্রার্থনাগৃহ, কয়েকটি তীর্থঙ্করদের মূর্তি, প্রবেশদ্বারে একটি স্তম্ভ। এভাবেই শুরু হল। তবে শাহজাহান বেশিদিন আর বাঁচলেন না। প্রথম জীবনে নিষ্ঠুর, অসহিষ্ণু এবং অত্যাচারী হলেও পরবর্তীকালে যেন তিনি অনেক সহিষ্ণুতা এবং সর্বধর্মসমন্বয়ের একটি বার্তা দিতে চাইছিলেন। কিন্তু সেই দায় তো আর তাঁর মেজো পুত্র আওরঙ্গজেবের নেই। তিনি এমনিতেই দিকে দিকে মন্দির ধ্বংস করতে শুরু করলেন। আর যেহেতু পিতার থেকে জৈনরা এই মন্দির ও সংলগ্ন বাস্তুজমি পেয়েছে, তাই সরাসরি ধ্বংস করতে পারলেন না। তবে নিষেধাজ্ঞা জারি করলেন বাদ্যযন্ত্র, ঘণ্টা ও নাগাড়ায়। সুরে বাজছে এরকম কোনও সাঙ্গীতিক বিনোদন হবে না। অতএব জৈন মন্দিরে নাগাড়া কিংবা ঘণ্টাধ্বনি বন্ধ করে দেওয়া হল।
কিন্তু জৈন ধর্মাবলম্বীরা তো অবাক। মাঝরাতে অথবা ভোররাতে কিংবা সন্ধ্যাকালীন প্রার্থনার সময়ও আচমকা কেন বাজে ঘণ্টা? কেন বেজে উঠছে নাগাড়া? কে বাজায়? ওসব বাজানোর কর্মীদের তো বিদায় দেওয়া হয়েছে। তাহলে গোপনে লুকিয়ে কে বাজাচ্ছে? সম্রাটের নাকের ডগায় এসব চললে এরপর আর মন্দির থাকবেই না। ধ্বংস হবে।
যা ভয় পাওয়া গিয়েছিল, তাই কিন্তু হল। অর্থাৎ সম্রাট আওরঙ্গজেবের কানেও গেল। ক্ষিপ্ত হয়ে ডেকে পাঠালেন জৈন সিপাহশালারকে। এসব কী? আমার আদেশ নাকি শিরোধার্য হচ্ছে না? ভয়ে কম্পিতচিত্ত। তাও সিপাহশালার বললেন, আমরা নিজেরাই খুব বিভ্রান্ত। জানি না কে বাজাচ্ছে! আওরঙ্গজেব আরও রেগে গেলেন। এসব কি ইয়ার্কি হচ্ছে? নাকি মিথ্যাচার? তিনি নিজেই তদন্ত করবেন। ফতোয়া দিলেন জৈন মন্দির থেকে শব্দ পেলেই তৎক্ষণাৎ গিয়ে দেখতে হবে কী ব্যাপার! কে বাজায়? কেউ পালায় কি না ইত্যাদি।
প্রত্যেকেই সম্রাটকে বার্তা দিল যে, নাগাড়া বাজে। ঘণ্টা বাজে। কিন্তু কেউ বাজায় না। আওরঙ্গজেব বিস্মিত। তিনি আর সেই জৈন মন্দির নিয়ে কোনও হুঁশিয়ারি অথবা ফতোয়ার পথে হাঁটলেন না। বললেন, যেমন পুজোপ্রার্থনা চলার কথা, তাই হোক।
তবে মুঘল সাম্রাজ্যের অস্তমিত হওয়ার আগে থাকা সেই মন্দির আজ আর নেই। ১৮৭৮ সালে নতুন করে মন্দির নির্মাণ করা হল। সেখানেই। সেই মন্দিরের অংশবিশেষ আজও হয়তো এই নয়া মন্দিরেও মিশে রয়েছে। চাঁদনি চকের রাস্তায় প্রবেশের ঠিক আগে এই হল তিন চূড়া বিশিষ্ট প্রাচীন জৈন মন্দির। লাল মন্দির। যার সূত্রপাত কমবেশি লালকেল্লারই সময়কালে। দিল্লির এটাই প্রাচীনতম জৈন মন্দির। যার সঙ্গে ওই অলৌকিক গাথা মিশে গিয়ে তৈরি করেছে এক মিথ।
জীবলদাস পাপড়িওয়ালের ছিল একটিই লক্ষ্য। ভারতজুড়ে ক্ষুদ্র অথবা বৃহৎ মন্দিরে যত বেশি সম্ভব তীর্থঙ্করদের মূর্তি বসাবেন তিনি। তুর্কি আক্রমণের সময় থেকে যেন মন্দির অথবা মূর্তি ধ্বংসের উৎসব শুরু হয়। গুজরাতের ধার্মিক মানুষ জীবলদাস ঠিক করেছিলেন কত ধ্বংস করবে? তার থেকে বেশি নির্মাণ করব। ভারতীয় সংস্কৃতি আর ধর্মকে মুছে ফেলা এত সহজ নাকি? সেই জীবলদাসের এই লক্ষ্য দেখে উদ্দীপ্ত হলেন এক শিল্পী। যিনি আবার জৈন সন্ন্যাসীও বটে। জিনচাঁদ দেব।
জীবলদাসের জীবনের ওই লক্ষ্যকে পূরণ করতেই যেন তিনি অসম্ভব এক কাজে ব্যাপৃত করলেন নিজেকে। মূর্তি নির্মাণ। জনশ্রুতি যে তিনি একাই এক লক্ষাধিক মূর্তি নির্মাণ করেছিলেন। আর জীবলদাস সেগুলি ছড়িয়ে দেন ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে। তারই কয়েকটি হরিয়ানা ও দিল্লিতে ছিল। জানতে পেরেই শাহজাহানের অন্যতম এক জৈন সেনাধ্যক্ষ একটি মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন নিজের তাঁবুমন্দিরে! প্রাচীন সেই মহাবীরের মূর্তি ১৪৯১ সালে নির্মিত হয়। লাল মন্দিরের মহাবীর মূর্তি কি সেটাই? বিশ্বাস তেমনই!
লালমন্দিরে প্রবেশ করার সবথেকে বড় সার্থকতা কী? মানসস্তম্ভের সামনে দাঁড়ানো। ওই স্তম্ভ নশ্বর মানুষকে যেন বলে নত হতে। বিনয়ী হতে। অহংহীন হতে। এই হল লাল মন্দিরের আখ্যান!