কর্মপ্রার্থীদের বিভিন্ন দিক থেকে শুভ যোগাযোগ ঘটবে। হঠাৎ প্রেমে পড়তে পারেন। কর্মে উন্নতির যোগ। মাঝেমধ্যে ... বিশদ
দেওয়ালের খানিকটা চারপাশের তুলনায় বেশি সাদা। সেইদিকে আঙুল দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, এইখানে কাঠের আলমারিটা ছিল না?
—মনে আছে তোর? ছিলই তো।
—গেল কোথায় আলমারিটা?
দু’হাত তুলে উড়ে যাবার ভঙ্গি করে মা বলল, ভ্যানিশ।
অবাক হয়ে গেলাম। অত বড় আলমারিটা ভ্যানিশ?
মা প্রাঞ্জল করল, সোনার কেল্লা দেখিসনি? ভ্যানিশ।
—কে নিয়ে গেল? চোরে?
—বলতে পারিস। তবে এই চোরকে ধরতেও পারবি না, জেলেও পুরতে পারবি না।
—হেঁয়ালি রেখে আসল কথা বল।
—কাজের মেয়েটা বলল, দিনরাত আলমারির ভেতর কুরকুর আওয়াজ হচ্ছে। পেছনে কাঠের গুঁড়ো জমছে। মনে হচ্ছে উই ধরেছে। ডাকা হল কাঠের মিস্তিরি। মিস্তিরি এসে সামনের পাল্লাটা ধরে যেই খুলতে গেছে... বিশ্বাস করবে না, পুরো আলমারিটা ঝুরঝুর করে গুঁড়ো হয়ে মাটিতে মিশে গেল। পড়ে রইল শুধু সামনের পাল্লার কাচের অংশটুকু।
নিঃশ্বাস বন্ধ করে জিজ্ঞেস করলাম, আর আলমারির ভিতরের জিনিস? সেগুলোর কী হল?
—যা কিছু ছিল সমস্ত উইয়ের পেটে। কিচ্ছুটি পড়ে নেই।
চুপ করে গেলাম। মনে পড়ল ছোটবেলার কথা। বাড়িতে তখন আলমারি বলতে ওই একখানাই। মূল্যবান যা কিছু, তা সে টাকাপয়সা-গয়নাগাটিই হোক, আর দরকারি কাগজপত্র, আলমারিতেই জায়গা পেত। কিছুদিন পর সংসার সুখে না বাড়ুক সংখ্যায় বাড়ল। একটা বড় স্টিলের আলমারি ঢুকল বাড়িতে। ঘর যেহেতু মোটে দু’খানা। কাঠের আলমারির পাশেই জায়গা হল স্টিলের। তবে তার আভিজাত্য বেশি। মূল্যবান জিনিস সবই কাঠের আলমারি থেকে স্টিলের আলমারিতে স্থানান্তরিত হল। আর কাঠের আলমারি চলে এল আমাদের জিম্মায়।
জিম্মায় বলাটা ঠিক হল না। কারণ ওর মধ্যে স্ট্যান্ডার্ড লিটারেচার-এর বিশ খণ্ড ‘বুক অব নলেজ’ জায়গা পেল। জায়গা পেল ‘শরৎ সমগ্র’, নারায়ণ সান্ন্যালের ‘বিশ্বাসঘাতক’, ‘আমি নেতাজিকে দেখেছি’, দানিকেনের লেখা দু’ তিনটে সাড়া জাগানো বই। মুশকিল একটাই, আলমারির চাবিটা রাখা থাকত আলমারির মাথায়, আর সেখানে আমাদের হাত পৌঁছত না। অবশেষে যেদিন হাত আলমারির মাথা ছুঁল অর্থাৎ চাবিটা হস্তগত হল, সেদিনটাকেই আমাদের শৈশবত্বের অন্তিম দিন বলে ধরে নেওয়া যেতে পারে। প্রথমে আমি, তারপর ভাই বাল্যে উপনীত হলাম।
আলমারিটা কিন্তু আর বাড়ল না। একসময় আমাদের মাথা আলমারির উচ্চতায় উঠে এল, তখন আমরা আলমারির ছাদে রাখা চাবি ছাড়াও ভুল করে রাখা অন্যান্য জিনিসও অক্লেশে গুঁজে দিচ্ছি। আলমারির ভিতরটাও আর নতুন বইয়ের জায়গা দিতে পারছে না, ঠিক হল, এবারে শুধু বইয়ের জন্য একটি দেওয়াল আলমারি না হলেই নয়। কাঠের আলমারি থেকে অনেক বই একসময় দেওয়াল আলমারিতে জায়গা পেয়ে উঠে গেল।
—কী ভাবছিস?
মায়ের কথায় অতীত থেকে ফিরে এলাম।
—তোমার কিছু মনে নেই না?
মা বিরক্ত হল। আজকাল সকালের কথাও বিকেলে ভুলে যায়। তবু ‘মনে নেই’ শুনলে রাগ করে।
—কোনটা মনে নেই?
—আলমারিতে কী রাখা ছিল?
—কী আর থাকবে? ছিল কিছু বই।
—বই তো ছিলই। তার সঙ্গে আমাদের বেশ কিছু সার্টিফিকেটও ছিল।
মনে পড়ল, বছর খানেক আগেও মা আলমারি খুলে ফাইলের পর ফাইল কোলে নিয়ে বসত। একটা করে ফাইল খুলত আর ভিতর থেকে টেনে টেনে বের করত সার্টিফিকেট।
—এইটা তুই পেয়েছিলি জুনিয়ার রেডক্রশে বেস্ট ক্যাম্পার হয়ে। এইটা রহড়া রামকৃষ্ণ মিশনে ডিবেট করে। এই দুটো বিড়লা মিউজিয়ামে সায়েন্স সেমিনারে পাওয়া। মনে পড়ছে আবৃত্তি করতে গিয়ে একটা লাইন বাদ পড়ে গিয়েছিল। তাও সেকেন্ড প্রাইজ পেয়েছিলি?
ভাইয়েরগুলোও। প্রতিটা পুরস্কার, প্রতিটা সার্টিফিকেট সমস্ত ইতিহাস সঙ্গে নিয়ে অতীত থেকে উঠে আসত। জানলা দিয়ে আসা রোদ সার্টিফিকেটের চকচকে কাগজে ঠিকরে মা-র মুখে গিয়ে বসত। সেখানে টলটল করত সুখস্মৃতি। উদ্ভাসিত মুখে একটার পর একটা সার্টিফিকেট উল্টে যেত মা। আঁচলে মুছে আবার ফাইলবন্দি করত।
মা’র দিকে তাকালাম।
—কী বলো?
—আমি যে পারলাম না।
মা’র চোখে জল।
—কী পারলে না?
—তোদের সার্টিফিকেটগুলো আমার জিম্মায় রাখতে দিয়েছিলি। আমি যে নষ্ট করে ফেললাম!
উঠে গিয়ে মা’র পিঠে হাত রাখলাম, —কী বলছ আবোলতাবোল? চলো, বাইরে চলো।
বারান্দায় পাশাপাশি বসে মা’র একটা হাত হাতে নিয়ে বললাম, কে বলেছে আমাদের সার্টিফিকেট? ওগুলো আমাদের আর কোন কাজে লাগবে? ওইসব সার্টিফিকেটই তোমার। মনে আছে যেখান থেকেই পাই, এনে তোমার হাতেই তুলে দিতাম। যত্ন করে তুলে রাখতে। উল্টেপাল্টে দেখতে।
তোমার জিনিস, তোমার হাতেই গেল। এতে দুঃখ পাবার কী আছে?
—তবু! তোর বাচ্চারা, তাদের ছেলেমেয়েরাও তো দেখতে পেত।
—দেখত না মা। তাদের নিজস্ব জগৎ। তাই নিয়েই তারা ব্যস্ত। বরং তাদের সার্টিফিকেট আমরা যখন বুড়ো হব, উল্টেপাল্টে দেখব। জড়িয়ে ধরে বসে থাকব।
মা কিছুটা শান্ত হল। উঠে গেল খাবার সাজাতে।
চোখ গেল দেওয়ালের ফাঁকা জায়গাটায়। যেখানে কাঠের আলমারিটা ছিল, সেখানে দেওয়ালের রং একটু বেশি সাদা। বাইরের ধুলোবালি থেকে দেওয়ালটাকে আলমারিটাই তো আড়াল করে ছিল।
আজ থেকে ষাট বছরেরও বেশি আগে চলতে শুরু করেছিল মা। মা আর বাবা। চলার পথে একসময় বাবা পিছিয়ে পড়ল। তারপর একা মা। ভাই দূরে থাকে। আমিও কাছে থাকতে পারি না। তবুও মা যে এতখানি পথ পার হয়ে আসতে পেরেছে তার একটা বড় কারণ নিশ্চয়ই সান্নিধ্য। যে সান্নিধ্য দিয়েছে অনেক কিছুর মতো, ওই কাঠের আলমারিটাও।
আলমারির পাল্লার আড়ালে, বইপত্রের ভাঁজে ভাঁজে, থেকে গিয়েছিল কিছু ফাইল। ফাইলের ভিতর সার্টিফিকেট... সার্টিফিকেট নয়, ফাইলের দু’ মলাটের ভিতর থরে থরে সাজানো ছিল স্মৃতি। সেই স্মৃতি উল্টেই এতগুলো বছর অতিক্রম করেছে মা। স্মৃতিও মাকে ছেড়ে যেতে শুরু করেছে। কী পড়ে রইল তবে?
আলমারির রেখে যাওয়া ফাঁকা জায়গাটা আর একবার দেখলাম। মা আজকাল সবই ভুলে যাচ্ছে। বিস্মরণের আস্তরণ একসময় আলমারির অস্তিত্বকেও ঢেকে দেবে। হারিয়ে যাবে আলমারি তার সমস্ত ফাইল আর সার্টিফিকেটের স্মৃতি নিয়ে। এক প্রশান্ত বিস্মৃতি মা’র ভিতর থেকে প্রতিটি দুঃখময় স্মৃতি মুছে দেবে। মা ভুলে যাবে মা’র জিম্মায় থাকা কিছু কাগজের হারিয়ে যাবার কথা।
ভালো থেকো মা! ভুলে থেকো।