কর্মপ্রার্থীদের বিভিন্ন দিক থেকে শুভ যোগাযোগ ঘটবে। হঠাৎ প্রেমে পড়তে পারেন। কর্মে উন্নতির যোগ। মাঝেমধ্যে ... বিশদ
তবে সেক্ষেত্রেও যাবতীয় হিসেব দাঁড়িয়ে আছে দু’টি অলীক ফ্যাক্টরের উপর। তৃণমূলে ক্রমাগত আরও বড় ভাঙন ধরানো, যা ভোটের দিন ঘোষণার পরও চলবে। আর ‘আমরাই এবার আসছি’, এই কথাটা বারবার প্রচার করে সিপিএমের হতাশ নিচুতলার সমর্থন টেনে আনা। কারণ ওই দু’টি ফ্যাক্টর বাদ দিলে এখনও এরাজ্যে বিজেপির নিজস্ব সংগঠনের জোর মোটেও উৎসাহব্যঞ্জক নয়। গত কয়েক মাসে সঙ্ঘ পরিবারের নীতি ও আদর্শহীন একতরফা দখলদারির রাজনীতি দেখে বাংলার মানুষ যদি ফের সিপিএমকে একটু বেশি আশীর্বাদ করে তাহলেই গেরুয়া পার্টির ক্ষমতা দখলের স্বপ্ন মাঠে মারা যাবে। এখনও পর্যন্ত যা খবর তাতে নিশ্চিতভাবেই এই ভোটে সিপিএমের হারানো ভোট বেশ কিছুটা ফিরবে। এবং তা হলেই গেরুয়া শক্তির যাবতীয় কৌশলও ব্যর্থ হবে। পাশাপাশি, দুর্নীতিকে খতম করতে ফুল, মালা, চন্দনে সেই দুর্নীতির কাণ্ডারীদেরই দলে আবাহন, আর যাই হোক সুস্থ রাজনীতি হতে পারে না। এই ধ্রুব সত্যটাকে বাংলার মানুষ হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করতে শুরু করেছে। এই একটা ফ্যাক্টরই কঠিন সময়ে শেষ দৌড়ে পার্থক্য গড়ে দিতে পারে।
তৃণমূল ভেঙে অনেক আশা জাগিয়ে যেসব দলবদলুরা স্রোতের মতো গেরুয়া শিবিরে যোগ দিচ্ছেন, তাঁদের ক্ষমতা নিয়েও সম্প্রতি একটু যেন সন্দিহান দেখাচ্ছে দিলীপ ঘোষদের। খোদ ভূমিপুত্রের খাসতালুক নন্দীগ্রামে গত ৮ জানুয়ারি সভা ঘিরে যে অপ্রীতিকর পরিস্থিতি হয়েছে, তারপরই ওই আশঙ্কা যথেষ্ট বেড়েছে। সভা ডেকে দলেরই একাংশের হাতে বেইজ্জত হওয়ার এমন ঘটনা মেনে নেওয়া বিজেপির মতো একটা সর্বভারতীয় দলের পক্ষে সহজ নয়। গেরুয়া শিবিরের ভিতরের হিসেবই বলছে, খুব বেশি হলে ৩৫টি আসনে ভূমিপুত্রের অল্পবিস্তর প্রভাব আছে। তার বেশি নয়। তাই অযথা লাফালাফির কোনও মানে হয় না। অনেক দরদস্তুরের পরও তাই দল ভেঙে আসা কোনও নেতাকে মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী করার পাকা কথা দেননি অমিত শাহরা। দেওয়ার কথাও নয়। বাকি যাঁরা যোগ দিচ্ছেন তাঁদের নিজের আসন টিকিয়ে রাখার ক্ষমতা আছে কি না, তা নিয়েই যথেষ্ট সন্দেহ আছে। ভবিষ্যতে তাঁরা দলের কাছে সম্পদ হবেন, না অভিশাপ হয়ে দেখা দেবেন, তা সময়ই বলবে।
নির্বাচন যেহেতু একইসঙ্গে বিরাট মনস্তত্ত্বেরও খেলা, তাই অমিত শাহরা দলের কর্মীদের উৎসাহিত করতে মুখে বলছেন, এবার ২০০ আসন তাঁরা জিতবেই। তাঁরা জানেন, এই প্রচারে বিরোধী শিবিরে শঙ্কা বাড়ে, শত্রু দলের কর্মীরা হতাশ হয়। কিন্তু বাস্তবে কোনও অঙ্কেই তা হওয়ার নয়। উল্টে কোথায় যেন নৈতিকভাবে ভোটের আগেই হার হয়ে যাচ্ছে দিলীপবাবুদের। নিজেরাই নিজেদের প্রশ্ন করছেন, এভাবে শত্রু দল ভেঙে গেরুয়া সংসারে ঘটা করে কুমির ডেকে আনার পরিণাম ভালো হবে তো! এই ভোটে বাংলার উন্নয়ন নয়, কর্মসংস্থান নয়, শিল্প গড়ার স্বপ্ন দেখানো নয়, ভ্রষ্টাচারের বিরুদ্ধে লড়াইকেই প্রধান অস্ত্র করেছে বিজেপি। অথচ সংগঠন বাড়াতে সেই দুর্নীতির সঙ্গেই খোলাখুলি আপস করতে হচ্ছে। নিজেদের সুবিধাবাদী রাজনীতির প্রয়োজনে বারেবারে এই গোলপোস্ট বদলে দেওয়ার রাজনীতি কখনও নৈতিকভাবে জয়ী হতে পারে না। ঘনিষ্ঠ মহলে গেরুয়া দলেরই অনেকে স্বীকার করছেন, এত কুৎসা আর অভিযোগ সত্ত্বেও এখনও জননেত্রীর ভাবমূর্তির বিন্দুমাত্র ক্ষতি করা যায়নি। উন্নয়নের জোরে তিনি বাংলার ঘরে ঘরে এখনও অন্যদের চেয়ে অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য। তাঁর স্বাস্থ্যসাথী থেকে কন্যাশ্রী গোটা দেশে অপ্রতিদ্বন্দ্বী। তাই এবারেও রাজ্যের ২৯৪ আসনে তিনিই প্রার্থী। তাঁর চেয়ে যোগ্যতর মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার মুখ পশ্চিমবঙ্গে নেই। আর যাঁরা আছেন তাঁরা কেউ মেদিনীপুরের, কেউ খড়্গপুরের নেতা। কিন্তু গোটা বাংলার গরিব নিপীড়িত মানুষের হৃদস্পন্দন এখনও রাজ্যের একজনের সঙ্গেই একতারে বাঁধা। সেই যোগ ছিন্ন করার মতো শক্তিশালী মুখ বিজেপিতে কোথায়? ক্ষমতা দখলের নেশায় দল ভেঙে যে বিষবৃক্ষ বঙ্গ বিজেপি বপন করছে তার দায় তাদেরই নিতে হবে! তৃণমূল ছেড়ে আসা দলবদলুদের সবাইকে টিকিট নয়, বলে সেই অধ্যায়েরই সূচনা করেছেন দিলীপবাবু। এখন দেখার এই একটা ঘোষণায় ক’টি জেলা রক্তাক্ত হয়! আর কে কে টিকিট না পেয়ে পুরনো জায়গায় ফিরতে বাধ্য হন।
এটা ঠিক গত কয়েক বছরে বিজেপির রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বাংলায় লাফিয়ে বেড়েছে। একই দিনে রাজ্যে একাধিক রোড শো, জেলায় জেলায় সভা, একাধিক কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর নিত্য আসা-যাওয়া, তিন চার বছর আগেও অত্যন্ত দূর কল্পনা ছিল। ২০১৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচন থেকেই দল ক্রমেই প্রধান বিরোধী হয়ে ওঠার দৌড়ে শামিল হয়েছে। এবং বলাই বাহুল্য, সিপিএম সহ বাম নেতৃত্ব ও তার দোসর কংগ্রেসের ভোট কেটে ক্রমেই এগিয়েছে। বাম ও কংগ্রেসের ভোট বিগত লোকসভায় কোন জাদুতে প্রায় পুরোটাই বিপরীত মেরুর বিজেপিতে পড়েছে, তার কোনও ব্যাখ্যা আজও মেলেনি। ভোট রাজনীতি পাটিগণিত নয়, চলে রসায়নের নিয়মে। সেখানে নদীর পাড় ভাঙাগড়ার তত্ত্ব খাটে না। সেখানে দু’য়ে দু’য়ে সব সময় চারও হয় না। মাঝেমাঝে অজানা কারণে যোগফল শূন্যও হয়। গত বিধানসভা ভোটের কথা একবার মনে করুন। সেবার জোট করেও বামেদের ভোটব্যাঙ্কের রক্তক্ষরণ বন্ধ করা যায়নি। আবার দু’বছর আগের লোকসভা নির্বাচনে বামেরা কার্যত নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে। সেই শূন্যস্থান দখল করেই বিজেপির ভোট এরাজ্যে অবিশ্বাস্য ৪০ শতাংশ পেরতে সক্ষম হয়েছে। ১৮টি আসন জিতে দিলীপবাবুরা তাক লাগিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছেন। তৃণমূলের সঙ্গে ভোটের ফারাক মাত্র ৩ শতাংশের কিছু বেশি। যদিও লোকসভা আর বিধানসভা ভোটের প্রেক্ষিত সম্পূর্ণ আলাদা। তবু একবার রক্তের স্বাদ পাওয়া গেরুয়া শক্তি তাই সেই থেকেই বাংলা দখলে মরিয়া।
বিজেপি জানে, রাতারাতি পুরনো সিপিএম কিংবা তৃণমূলের মতো সংগঠন গড়ে তোলা অসম্ভব। তাই তৈরি জিনিস দখল করো। অনেকটা পরের তৈরি কারখানা কিনে নিয়ে রাতারাতি উৎপাদন শুরু করার মতো। সেই তাগিদ থেকেই এবার রাজ্যের ভোট কার্যত তৃণমূল বনাম তৃণমূলত্যাগীদের লড়াইয়ে পরিণত হচ্ছে। সংগঠন নেই, লোক নেই, নেতা নেই, এমনকী অফিসওই নেই এমন পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়েও আসন জেতার স্বপ্ন দেখছে শুধু ভাঙন ধরানোর কৌশলে। ভোটের দিন এখনও ঘোষণা হল না, কোথায় কে প্রার্থী হবেন তার ঠিক নেই। কে শেষ পর্যন্ত কোথায় থাকবেন, তাও অমীমাংসিত। ক’দফায় ভোট, কবে শুরু তার ঠিকঠিকানাও নেই। কিন্তু রোজ পরিবেশ গরম হচ্ছে। সামাজিক দূরত্ব বিধিকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে মাস্ক ছাড়াই পাড়ার মোড়ে মোড়ে সভা। দূর পর্যন্ত মাইকের চোং। কদর্য পারস্পরিক আক্রমণে কান ঝালাপালা। এ ওকে চোর বলছে। অমনি যাকে চোর বলা সে তিনটে ছবি দেখিয়ে বলছে, দেখুন ও তো আরও বড় ডাকাতের সঙ্গে বসে আছে, তার বেলা! পাল্টা ছুটে আসছে বেইমান, বিশ্বাসঘাতক, গদ্দার বিশেষণ। রাজনৈতিক আক্রমণ পর্যবসিত হচ্ছে স্রেফ ব্যক্তিগত কাদা ছোঁড়াছুঁড়িতে। সেই সঙ্গে মওকা বুঝে উচ্চাকাঙ্ক্ষা পূরণ করার আদিম হিংস্রতা। পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে সবচেয়ে বেশি পেয়েছে যে পরিবারটি সেই পরিবারের সুসন্তানই বঞ্চনা আর দুর্নীতির কথা বলে দল ছেড়েছেন। বলছেন, উম-পুনের টাকা লুট হয়েছে। অথচ তাঁদেরই পরিবার নিয়ন্ত্রিত পুরসভা এলাকায় তাঁর অঙ্গুলিহেলন ছাড়া কারা চাল ত্রিপল নিয়ে পালাল, তা বলছেন না। উল্টে অভয় দিচ্ছেন, ভোটের দিন ঘোষণা হলে বলব। আপনার পিছনে যদি এতই জনসমর্থনের ঢেউ, তাহলে এখনও ভয়টা কীসের?
পরিস্থিতি এমন যে কাউকে বিশ্বাস করাই এখন দায়। বিশ্বাস, অবিশ্বাস আর বিভ্রান্তির ত্র্যহস্পর্শ থেকে বঙ্গ রাজনীতিতে আজ বেরিয়ে আসছে একটাই ধ্রুবপদ, আখের গোছাও। বহিরাগত বিত্তশালী দলের নেতাদের এই আগুন নিয়ে খেলায় তো মানুষের পেট ভরে না। দল ভাঙার মধ্যে চমক থাকলেও মানুষের মন জেতার জাদু নেই। এটা ঠিক, কোনও নেতা এদিক ওদিক করলে তাঁর সঙ্গে কিছু অনুগামীও রংবদল করে। কিন্তু তাতে মানুষের কী যায় আসে? সবাই নিজের নিজের স্বার্থ আর এজেন্ডার কথা ভাবছে। কেউ কি রাজ্যটার কথা ভাবছে? রাজ্যের উন্নয়ন, রাজ্যের মানুষের অগ্রগতি সবই কথার কথা। তাই সাধারণ মানুষেরও উচিত, এই ভোটে বেছে বেছে বিশ্বাসঘাতকদের শিক্ষা দেওয়ার শপথ নেওয়া। ভোটবাক্সে মধুর বদলা নেওয়া। একটা পতাকার জোরে দশ বছরে সবকিছু গুছিয়ে নিয়ে তারপর উল্টো দলে ঝাঁপ মারা, তাহলেই চিরতরে বন্ধ হবে। ভোটটা টাকা কামানোর উৎসব নয়, গণতন্ত্রের উৎসব, এই শিক্ষা একমাত্র দিতে পারেন সাধারণ মানুষই।