কর্মপ্রার্থীদের কোনও সুখবর আসতে পারে। কর্মক্ষেত্রে পদোন্নতির সূচনা। গুপ্ত শত্রু থেকে সাবধান। নতুন কোনও প্রকল্পের ... বিশদ
কলেজে পড়ার সময় এনসিসির ক্যাডেট হিসাবে ন্যাশনাল রাইফেল শ্যুটিং কম্পিটিশনে সিলেক্টেড হয়ে বারাকপুরের পুলিস ট্রেনিং কলেজের রেঞ্জে রাইফেল ছুঁড়তে যেতে হতো। সারাদিন গুলি ছুঁড়তে হতো নানা পজিশন এবং দূরত্ব থেকে। মাথার উপরে এনসিসির এয়ার ফোর্স উইংয়ের ক্যাডেটরা বনানজা এবং টাইগার মথ প্লেনে করে উপরে প্লেন চালানো শিখত।
কয়েক বছর আগে একটি সান্ধ্য অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হয়ে গঙ্গার পাড়ের একটি ক্লাবে গিয়েছিলাম। সেখান থেকে নদীর অপর পাড়ে একসারি শিবমন্দির দেখা যেত। সেই অনুষ্ঠানে আমি নিধুবাবুর একটি টপ্পা গেয়েছিলাম। অনুষ্ঠান শেষে এক ভদ্রলোক এসে আমার হাত ধরে গানের খুব সুখ্যাতি করে নিজের পরিচয় দিয়ে বলেছিলেন, ‘আমার নাম কালাচাঁদ লাহিড়ী। আমি শুনেছি, তোমার ডাক নাম লালা। আমি তোমার চেয়ে বয়সে বড়। আজ থেকে আমি তোমার কালাদা।’ তারপরই বলেছিলেন, ‘ভায়া, আজকে তো মুখবন্ধ হল। তোমায় এখানে আবার আসতে হবে এবং আমার ছাত্রছাত্রীদের তোমার খালি গলার গান শোনাতে হবে। ইলিশ উঠলে তবেই তোমাকে আসতে বলব। দেড় কেজির কমের ইলিশে কোনও স্বাদ থাকে না। তেলও থাকে না। তোমাকে ইলিশ মাছ ভাজা, সাদা সর্ষে দিয়ে ইলিশ ভাপা, ইলিশের মাথা দিয়ে কচুর শাক, ইলিশ মাছের মাথা দেওয়া মুগের ডাল এবং ইলিশ মাছের মাথার টক খাওয়াব। তুলাইপঞ্জি চালের ভাতের সঙ্গে। সারাদিন আমি, তুমি এবং আমার ছাত্রছাত্রীরা গান গাইব এবং গান শোনাব।’ শুনে আমি বললাম, ‘কালাদা, আমি তো বাথরুম সিঙ্গার। শোনাবার মতো গান তো আমি গাই না। তাছাড়া নিধুবাবুর গান কালীপদ পাঠক মশাই, রামকুমার চট্টোপাধ্যায়, চণ্ডীদাস মাল এবং দিলীপ মুখোপাধ্যায়রাই গেয়েছেন এবং গেয়ে থাকেন। তাছাড়া আমি তো কোনও বাজনার সঙ্গে গেয়ে অভ্যস্ত নই। কারণ প্রচলিত অর্থে আমি তো গায়কও নই।’
—তুমি গায়ক না হতে পার আমি তো গায়ক। গান নিয়েই সারা জীবন কাটিয়ে দিলাম। তুমি তো ভায়া আরেক মিয়াঁ মৌজউদ্দিন। নানা বাজনার সঙ্গে যা রিওয়াজ করার তা তুমি আগের জন্মেই করে এসেছ। ঈশ্বর তোমার গলায় তানপুরা, হারমোনিয়াম, সারেঙ্গি এইসব কেসি দাসের রসগোল্লার টিনের মতো এয়ার টাইট কৌটোতে প্যাক করে পাঠিয়েছেন। তাই এ জন্মে তোমার কোনও বাজনারই প্রয়োজন নেই। তুমি গাইলে অদৃশ্য অনেক বাজনা অশ্রুতভাবে তোমার গানের সঙ্গে বাজবে। আমি বিব্রত হয়ে বললাম, ‘না কালাদা, এতসব প্রশস্তি আমার প্রাপ্য নয়। তবে আপনি অনুরোধ করলে এবং একটু আগে জানালে আমি নিশ্চয়ই আসব এখানে। আপনার এবং আপনার ছাত্রছাত্রীদের গান শুনতে এবং যদি মতি হয় তাহলে আমিও না হয় দু’কলি গাইব।’ তারপর জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনি কি সপরিবারে এখানে থাকেন?’
—না ভায়া, আমি বিয়ে করিনি। এই নয় যে, কোনও মেয়ে আমাকে বিয়ে করতে চায়নি। কিন্তু আমার যে আগেই সুরের সঙ্গে বিয়ে হয়ে গিয়েছিল। আমার দু’কাঁধের দাঁড়ে ললিত, বিভাস, তরী, ভৈরবী, মালকোষ, কাফি, দরবারি কানাড়া এই সব পাখিরা মৌরুসি পাট্টা গেড়েছিল। তাই আমার দু’কাঁধ ঝাঁকিয়ে দিয়ে তাঁদের উড়িয়ে দিয়ে একজন মাত্র ললনাকে আমার অধিশ্বরী করে হৃদয়াসনে বসাতে পারিনি।
আমার ছাত্রছাত্রীরাই আমার পরিবার। দেখো ভায়া, গান তো অনেকেই গায় কিন্তু দুঃখের বিষয় একথা হৃদয়াঙ্গম করে ব্যথা পাই, যখন দেখি যে তাদের সুরের দিনগুলিকে কোনও এক অদৃশ্য অসুর তার অ-সুরের খোঁয়াড়ে পুরে রেখেছে। তাই নিটোল মুক্তোর মতো সুর তাদের কণ্ঠ নিঃসৃত হয় না। গান যদি গানের মতো না হয়, সুর যদি স্বচ্ছতোয়া ঝর্ণার মতো না হয় তাহলে সে সুর হৃদয়ের তন্ত্রে তন্ত্রে আঘাত করবে কী করে? তাই সে গান তাল, লয়, সুর এসবে মাখামাখি হয়ে কয়েতবেল মাখার মতো স্বাদু এবং মধুর হয়ে উঠতে পারে অবশ্যই সেটাকে তখনকার মতো মজিয়ে দিতে পারে কিন্তু সে গান শ্রোতার হৃদয় এবং মস্তিস্কে অনুরণন তুলতে পারে না। ভায়া, তুমি নিজে বুঝবে না বিধাতা তোমাকে কী দিয়েছেন। এই অমূল্য ধন তুমি অতি বিনয়ী হয়ে নষ্ট করো না। যদি তা করো তাহলে তা বিধাতাকে অসম্মান করা হবে।
কালাদা মাঝে মাঝে আমাকে ফোন করেন। ভরাট গলায় বলেন, ‘লালা, আমি তোমার কালাদা বলছি। কী করব বলো ইলিশগুলো সব বেঁটে হয়ে গিয়েছে। এই ক’বছরের মধ্যে দেড় কেজির বেশি ইলিশ চোখেই পড়ল না। তোমাকে আসতে বলি কোন মুখে বলো!’
আমি বললাম, ‘আপনাকে দেড় কেজি ইলিশের জন্য অপেক্ষা করতে হবে না। আপনি পুঁটি মাছের চচ্চড়ি খাওয়ালেও যাব। কিন্তু আমার বয়স পঁচাশি হলেও কালাদা আপনি তো আমার চেয়েও বড়। আপনার কত হল?’
উনি বললেন, ‘নব্বই ছুঁই ছুঁই।’
আমি বললাম, তবে আর দেরি করে লাভ নেই। আমি ছোট হলেও তো আপনার চেয়ে আগে যেতে পারি। তাই আমার ও আপনার গলা যতদিন সুরে বলে ততদিনেরই মধ্যে একদিন ডাকুন আপনার ছাত্রছাত্রীদের। হোক একদিন হুল্লোড়। গানে গানে বারাকপুরের গঙ্গায় আমরা সকলে মিলে ভেসে যাই চলুন। গায়ক আমিও অনেক দেখেছি কালাদা। উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের গায়ক, রবীন্দ্রসঙ্গীতের গায়ক, আধুনিক গানের গায়ক। কিন্তু আপনার মতো প্রকৃত গায়ক বেশি দেখিনি। অনেকেই গান করেন কিন্তু তাঁদের গান শুনে রবীন্দ্রনাথের সেই গানের কলিগুলি মনে পড়ে যায়—
‘প্রাণে গান নাই, মিছে তাই ফিরিনু যে
বাঁশিতে সে গান খুঁজে।
প্রেমেরে বিদায় ক’রে দেশান্তরে
বেলা যায় কারে পূজে।’
আমার কাছে কালাদার ফোন নম্বরটি ছিল কিন্তু চোখে দেখি না বলে কোথায় যে রেখেছি, তা আর খুঁজে পাচ্ছি না। জানি না এ লেখা কালাদার চোখে পড়বে কি না। তাঁকে আমার প্রণাম এবং তাঁর দীর্ঘায়ু প্রার্থনা করে এ ক’টি কথা বললাম।
অলঙ্করণ: সোমনাথ পাল