কর্মপ্রার্থীদের কোনও সুখবর আসতে পারে। কর্মক্ষেত্রে পদোন্নতির সূচনা। গুপ্ত শত্রু থেকে সাবধান। নতুন কোনও প্রকল্পের ... বিশদ
ওপারে বাবা ও তার বন্ধুরা সব্বাই ব্যবসা করত। তাই এখানেও একজোট হয়ে ব্যবসাই শুরু করল। গড়িয়াহাটে কাপড়ের দোকানটা দারুণ চলছিল, মুনাফাও হচ্ছিল বেশ, কিন্তু কেন জানি না আমার মন সায় দিত না। ব্যবসায় রক্তের সম্পর্কেরই কোনও দাম থাকে না, সেখানে আবার শুধু বন্ধুত্ব! তারপর আবার আমার বাবা! ভীষণ ভীতু। ঠকলে কিছু মানুষ শক্ত হয় আর কিছু মানুষ ভেঙে পড়ে। বাবা বরাবর এই দ্বিতীয় শ্রেণীর। তবে খুব রসিক ছিল। তাই কাস্টমারদের সঙ্গে রিলেশনটা আলাদাই ছিল। আর ওইটিই ছিল আমার তুরুপের তাস। বাবার মাথা খেয়ে দোকানটা ভাঙিয়ে, ঠিক পাশেই দিলাম আমাদের নতুন দোকান। কিন্তু হিসাব মেলেনি। মানুষ কি আর শুধু মানুষের সঙ্গে ব্যবসা করে? ব্যবসা করে নিজের বিশ্বাস আর অসুবিধার সঙ্গেও। তাই ছেড়ে যাওয়া মানুষটার থেকে জুড়ে থাকা চারজনের গুরুত্বটা দাঁড়িপাল্লায় একেবারে কাত করে দিল। বাবাও আর বাঁচেনি। একদিন হুট করে স্ট্রোক আর তারপরেই সব শেষ। আমি জানি, ওটা হয়েছিল আমারই জন্য। কিন্তু অবাক করার মতো ব্যাপারটা হল বাবা মারা যাওয়ার পর বাকিরাও আর বেশিদিন বাঁচেনি। ওরা পাঁচজনই একের পর এক, তা’ও আবার বছর ঘুরতে না ঘুরতেই। কী জানি! কী ছিল ওঁরা। তবে আমি আর একা-একা দোকান টানতে পারিনি, জুড়ে গিয়েছিল সেই পাঁচ আবার— বাবাদের পাঁচ ছেলে। বাবা চলে যাবার পর, আমার আত্মবিশ্বাসটা এক ধাক্কায় পড়ে গিয়েছিল অনেকটা। আমি কোনওদিনই ভগবান মানিনি। ওই সব ষড়-রিপুর নিয়ন্ত্রণে আমি কোনওদিনও বিশ্বাস করিনি। ধুর! ভগবান চোখ দিয়েছেন দেখতে, কান দিয়েছেন শুনতে, নাক দিয়েছেন খাবারের গন্ধ শুঁকতে, জিভ দিয়েছেন স্বাদ নিতে আর ত্বকটা এসির হাওয়া খেতে। সব করব, আমি! কিন্তু হুট করে ভগবানে বিশ্বাসটা বাড়ল। ওই একটা কাঠ আর এক বান্ডিল কাঠ ভাঙার গল্পটা অনেক আগে পড়লেও ততদিনে বেশ বুঝেছিলাম একজোট হয়ে ব্যবসার একটা আলাদা স্বস্তি আছে!
বাবা চলে যাবার পর, তর্পণটা আমি কোনওদিনও বাদ দিইনি। সমীর, দেবু, স্বপন, প্রদীপরাও দেয়নি। আসলে ওরা সকলেই ছিল ভীষণ ধর্মভীরু।
আমাদের সবার একটা করে মেয়ে আছে। আর মেয়েদের বিয়ে দিয়ে আমরা সবাই এখন একেবারে ঝাড়া হাত-পা, সেয়ানাগিরিটার এখন তাই আর সেভাবে প্রয়োজনও পড়ে না। ওপারে দোকানটার নাম ছিল রাখহরি বস্ত্রালয়। আমরা এপাশে এসে দোকানের নাম আর ভগবানের নামে রাখিনি। যাইহোক বাবা মারা যাবার পর সেই একটা বছরই আমাকে একা একা তর্পণ করতে হয়েছিল। সেই ভোর চারটেয় উঠে বাগবাজারের ঘাট। কি বীভৎস ভিড়! সবাই একে অপরকে ঠেলছে আর তার মাঝে ভাটার গঙ্গা— পাশের চুল্লির পোড়া কাঠ থেকে শুরু করে আরও কত কিছু। ওতেই একটা ডুব মেরে হাতে একটা তামার কোষা, আর দু’আঙুলে দুটো কুশের আংটি পরিয়ে পুরোহিত মশাইদের লড়াই। কপালে, দু’হাতের বাহুতে, বুকে, পেটে, পিঠে গঙ্গার মাটি দিয়ে তিলক দেওয়ার পর, পায়ের পাতাটুকু যেন জলে ডুবে থাকে। কোনওক্রমে ঠেলেঠুলে কিছুটা জায়গা জোগাড় করে পা’টা জলে ডুবিয়ে গোটা দশেক লোককে নিয়ে পুরোহিত শুরু করলেন, ‘ওঁ অপবিত্র, পবিত্রবা।’ আমি আবার বামুনের ছেলে, তাই বাকিদের ক্ষেত্রে যেটা নমঃ, আমার ক্ষেত্রে সেটা ওঁ। সে কী সমস্যা! পুরোহিত বলছেন, ‘নমঃ’ আর আমার দিকে বাঁকা চোখে ইশারা করছেন, না, নম নয়, ওঁ। তারপর, পৈতেটাকে একবার ডানদিকে, একবার বামদিকে, একবার মালার মতো করে পরে সে এক প্রকার সাঁঝ-সকালের পিটি। একবার বলে উত্তর দিকে জল দিন, একবার বলে দক্ষিণ দিকে, একবার বলে কোষার উলটোদিকে, সে এক বিশাল ঝক্কি! যাইহোক সব শেষে ওই ভাটার গঙ্গায় শেষ ডুবখানি দিয়ে আমি বমি করে ফেললেও মনে মনে একটু শান্তি পেয়েছিলাম! যতই হোক, আমার বাপু মেয়ে! মরলে ওসব তর্পণের ঝামেলা পোহাতে হবে না! সেদিন সন্ধে থেকে মনটা বেশ হালকা হয়েছিল। দোকান ভাঙার যে আপরাধবোধটা মাঝে মধ্যে মাথা চাড়া দিয়ে উঠত, সেটা যেন একপ্রকার নেমে গেল। কিন্তু, ওই পুরোহিত নিয়ে হাজার লোকের ঘোলা জলে ডুব দেওয়াটা কিন্তু একটা আতঙ্ক হয়েই থেকে গিয়েছিল। পরের বার অবশ্য আমাকে একা যেতে হয়নি। সমীর, দেবু, স্বপন, প্রদীপরাও ছিল। কিন্তু অভিজ্ঞতাটা ছিল সেই এক। আমরা পাঁচজনেই ছিলাম পৈতেধারী বামুন। তাই ওই পৈতে ঘুরিয়ে পাটুকু ডোবানোর মতো জল আর ঘোলা জলে একটা ডুব মারার ঝক্কিটা ছিল ভয়ঙ্কর। এই নিয়েই আমরা প্রায় চোদ্দো বছর মতো কাটিয়েছিলাম— মা, বউগুলোও চলে গেল সব। কিন্তু ধীরে ধীরে মন চাইলেও শরীর যেন আর পারত না। ‘বছরে তো একটা দিন’— অনেকবার নিজেরা নিজেদের বুঝিয়ে যখন ক্লান্ত হয়ে গেলাম তখন ঠিক করলাম, আর না! পরের বার থেকে একটা আলাদা ঘাটে যাব। কিন্তু পুরোহিত! এই বিশাল জনসমুদ্র ছেড়ে কোনও পুরোহিতই রাজি হল না। সবশেষে ঠিক করলাম আমরা পাঁচজনই যখন বামুন, তখন নিজেদেরই একজন পৌরোহিত্য করব।
প্রথমবার আমার মন খুব করে চাইলেও আমি ওই পৌরোহিত্যের দায়িত্বটা নিইনি। আসলে জীবনের প্রথম ভাগে, আগে গিয়ে আমি সোনা পেলেও শেষের দিকে হিসাবটা উলটে গিয়েছে— আগে গেলে বাঘে খায়। দোকান ভাঙার ঝক্কিটা আগে নিয়ে আমার বাবাটাই আগে মরল। যাই হোক, আমার মন চাইলেও মাথা সায় দিল না। দেবুর ঘাড়ে ছেড়ে দিলাম, আর বাগবাজার নয়, সারদা মায়ের ঘাটের একটু ডান হাতে একটা নিরিবিলিতে শুরু হল তর্পণ। শান্তিতে সারা গায়ে তিলক কেটে, এক কোমর জলে ডুবে ‘ওঁ অপবিত্র, পবিত্রবা’। আহা কি শান্তি! কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই দেবু চলে গেল। হুট করে স্ট্রোক। এরপর আমাকে বেশ জোরাজুরি করলেও পৌরোহিত্যের দায়িত্বটা আমি নিইনি। কেন জানি না মন সায় দেয়নি। পরেরবার তাই মন্ত্র মুখস্থ করল সমীর। কিন্তু তাজ্জব ব্যাপার! সমীরটাও চলে গেল ঠিক তার পরেই। কিছু তো একটা ভুল হচ্ছিল। আমার বাপু বাঁচার খুব ইচ্ছে! আমার জামাইটা আবার প্রাইভেট ফার্মে চাকরি করে। কী জানি কোন দিন চাকরি চলে যায়! তাই ব্যবসাটা একটু বুঝিয়ে দিয়ে যাওয়াই ভালো। তাছাড়া জেনেশুনে কেন মরব বলুন তো! আমি জানতাম, চেনা লোক মরলে কাছে টানে। তাই বাকিদের নিয়ে, চলে গিয়েছিলাম এক পণ্ডিতের কাছে। প্রশ্ন আমার সাজানোই ছিল— ‘পুরোহিত ছাড়া, আমরা নিজেরা কি তর্পণ করতে পারি?’ প্রশ্নটা শুনেই ভদ্রলোক প্রসন্ন মুখে দু’হাত তুলে জোর গলায় যেই বললেন, ‘নিশ্চয়ই’। আমি আনন্দে আরও একটা প্রশ্ন করে ফেলেছিলাম। ‘দেবু আর সুমনের তো ছেলে নেই, তাহলে ওদের তর্পণ কি আমরা...’ পণ্ডিত একটা মুহূর্তও নষ্ট না করে বললেন, ‘কেন পারবেন না?’ বাহ! মনটা যেন কিছুটা হলেও শান্ত হল। তবে আমি পৌরোহিত্যের দায়িত্ব নিইনি। স্বপনকে দিয়ে মন্ত্রটা ঝালিয়ে নিয়ে আমরা তিনজনে গেলাম গঙ্গার পারে। প্রথমে, পিতৃপুরুষ আর তারপর দেবু আর সমীরকে জল দিয়ে মনটা যেন ভারী হয়ে গেল। জীবনে কক্ষনো আমার এমনটা হয়নি! কিন্তু ঠিক যেটার ভয় করেছিলাম সেটাই হল। স্বপনও চলে গেল। চারদিনের ডেঙ্গির জ্বর আর তারপরেই সব শেষ! না! আর নয়। আমি তো মরতে চাই-ই-না, সেইসঙ্গে প্রদীপকেও আমি মরতে দেব না। কিন্তু প্রদীপ আমার কথা শুনলে তো! মহালায়ার আগে একদিন মন্ত্র মুখস্থ করে এসে বলে, ‘হেলু!দ্যেখস তো! মন্তরটা কেমন শুনতাছিস?’ আমি ‘না’ করলেও প্রদীপ শোনার মানুষ ছিল না!
এবার আমি একদম একা। জামাইটাও গত বছর... প্রদীপের পরেই! তবে ওকে আমি জল দেব না! চাকরি, চাকরি করে আমার ব্যবসাটা একবার দেখল না পর্যন্ত! তাছাড়া তর্পণ তো পিতৃপুরুষের জন্য, ওসব ছেলে-ছোকরাদের জল দেবার মতো বুকের পাটা আমার নেই! আমি ওসব মন্ত্র-তন্ত্র আর আওড়াইনি! ধুর! বাপ-ঠাকুরদা অনেক তিল-জল খেয়েছে! হয়তো জন্ম নিয়ে এই আশপাশেই কোথা থেকে আমাকে দেখে হাসছে আর ভাবছে ‘বুড়োটা এখনও এই বয়সে কী করছে রে বাবা!’ আমাদের নিজেদের ঘাটটাতেও আজ বেশ ভিড়। আমি অনেকক্ষণ বসে থাকলাম। সদ্য মা-বাপ মরা লোকেদের ভক্তি একটু বেশি, কারও কারও চোখে জল। কেউ কেউ আবার কোনওক্রমে জলটা দিয়ে উঠতে পারলে বাঁচে! সকালে উঠে এতদূর এলাম, মন্ত্রগুলোও মুখস্থ— তাই শেষমেশ ঘাটে নেমেই গিয়েছিলাম। নিজেই একটু গঙ্গার পাঁক তুলে কপালে, বুকে, হাতে, পায়ে তিলক করতেই বুকটা হু হু করে উঠল। তারপর জোগাড় করা দুটো কুশের আংটি পরে এক বুক জলে নেমে ভাঙা গলায় জোরে জোরে শুরু করলাম, ‘ওঁ অপবিত্র, পবিত্রবা, সর্ব বস্ত্রাং গতোবিভা...’ বাপ-ঠাকুরদাদের জল দেবার পর দোকানটার নামেও একটু জল দিলাম। দেবুরা চলে যাবার পর আমার সেয়ানাগিরির জোরে দোকানটা ছিল আমারই। কিন্তু জামাইটা গত হবার পর দোকানটাও মরে গিয়েছে। কি হবে! আর তো কেউ নেই! তাছাড়া ওটাও আমাদের বাপ-মা ছিল, এতদিন খাইয়েছে। ভিতরটা কেমন একটা করছিল। গলাটাও শুকিয়ে গিয়েছে। এমনটা আমার কোনওদিনও হয়নি! তারপর মনে মনে ঠিক করলাম দেবুকে জলটা দিই। এই জন্মে আমাদের বয়স একই ছিল। হয়তো অপেক্ষা করছে আমার মরার জন্য, আবার সবাই এক সঙ্গে জন্মাব। কিন্তু কোষাটা হাতে নিয়ে জলটা দিতে গিয়েই ভিজে চোখে দেখলাম, একটু দূরেই চারজন! ওই তো দেবু, সমীর, স্বপন আর প্রদীপ। কোষা নিয়ে আমার উদ্দেশে জল দিচ্ছে আর হাসছে। সে কি হাসি ওদের! ‘দে না রে, একটু জল!’ নিজের আনমনে, কথাগুলো বলতে বলতেই কোষাটা পড়ে গেল হাত থেকে। আর খুঁজিনি। অদ্ভুতভাবে আমার শুকনো গলাটাও যেন ভিজে গেল, ওরা যেন ওপার থেকে আমারই উদ্দেশে তর্পণ করছে! ‘আমাকে নিবি না তোদের সঙ্গে?’ আমি বলতেই, দূর থেকে চারজন কাছে এসে বলল, ‘কী দাদু! এই বয়সে গঙ্গার পারে কেউ আসে? ধুতিটা গুটিয়ে নিন।’ একরাশ আফশোসের সঙ্গে ধুতিটা গুটিয়ে নিয়েছিলাম। ওপার থেকে আর তর্পণ করা হল না!