ব্যবসায় বেচাকেনা বেশ ভালো হবে। কাজকর্মে কোনও প্রভাবশালী ব্যক্তির আনুকূল্য লাভ ও ভাগ্যোন্নতি। ... বিশদ
প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে চীনের এত আগ্রহ কেন? ঠিক কী ধরনের স্বার্থ রয়েছে তাদের? আসলে, সুপার পাওয়ার হতে চাওয়া চীন মূলত এই অঞ্চলে আধিপত্য রাখতে চায়। বিশেষত, বঙ্গোপসাগরে। আর, এই আগ্রহের প্রধান কারণ আমেরিকার ‘ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি’। ২০২১ সালে আমেরিকা এই স্ট্র্যাটেজি ঘোষণা করে। সেখানে চীনকে বাদ দিয়ে জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, ভারত, ফিলিপিন্স, বাংলাদেশ সহ অন্য দেশগুলিকে সঙ্গে নিয়ে একটি নিরাপদ ‘ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল’ গড়ে তোলার কথা ঘোষণা করে আমেরিকা। এই ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে বিশ্বের অর্ধেকেরও বেশি মানুষ বাস করে। ফলে যে কোনও পণ্যের বাজার হিসেবে এই অঞ্চলটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সমুদ্র বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও। সেই কারণেই এই অঞ্চলে নজর আমেরিকার। বেজিংয়ের সঙ্গে হাত মিলিয়ে আমেরিকান স্ট্র্যাটেজিতে আঘাত হেনেছিলেন শেখ হাসিনা। ফলে শেষ কামড় দিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে আমেরিকাও।
বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস ‘মিট দ্য অ্যাম্বাসেডর’ শীর্ষক এক অনুষ্ঠানে জানিয়েছিলেন, তিনি ও তাঁর সরকার কী চাইছে। ছোট তালিকা। তবে তাতে যথেষ্ট স্পর্শকাতর উপাদান ছিল। বিশেষ করে আমেরিকা চেয়েছে, ইন্দো–প্যাসিফিক অঞ্চলে তাদের পাশে থাকুক বাংলাদেশ। এজন্য তারা দু’টি সামরিক চুক্তিও করতে চায়। এসব প্রস্তাব বাংলাদেশের জন্য কিছুটা বিব্রতকর। কারণ, একই অঞ্চলে আমেরিকার স্বার্থের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে রয়েছে চীন। রয়েছে ভারতও। সকলের স্বার্থ এক রকম নয়।
সমস্যাটা কোথায়, পোড় খাওয়া কূটনীতিক পিটার হাস নিশ্চিত জানতেন। নিজেই বলেছিলেন, চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক ওয়াশিংটন-ঢাকা বন্ধুত্বে কোনও বাধা হওয়ার কথা নয়। যদিও বিষয়টি অত্যন্ত জটিল। কারণ, বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক আর দু’টি দেশের সাধারণ সৌজন্যে আটকে ছিল না। ৪৭ বছরে তা ক্রমাগত কাছে এসেছে। উভয়ের এখনকার বন্ধন বহুমাত্রিক এবং অনেক গভীর। একাত্তরে স্বীকৃতি দিতে দেরি করে ভুল করেছিল বেজিং। পরে সেটা পুষিয়েছে। ফলে বাংলাদেশের পক্ষে চীনের প্রতিপক্ষ আমেরিকার সঙ্গে মাখামাখি করা কঠিন। রয়েছে তাইওয়ান প্রশ্নও। হাসিনা জমানায় তাইওয়ানের পৃথক স্বাধীন সত্তা স্বীকার করেনি বাংলাদেশ। অথচ, আমেরিকার ইন্দো-প্যাসিফিক নীতির অবিচ্ছেদ্য অংশ তাইওয়ানকে সুরক্ষা দেওয়া। তবে বাংলাদেশে চীনের নৈতিক ও সাংস্কৃতিক ভিত্তি দুর্বল। ভারত বা আমেরিকা তার তুলনায় অনেক এগিয়ে। তাই বাংলাদেশকে শুধু চীনের সঙ্গে নয়, তিন সীমান্তের প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গেও ভারসাম্য রক্ষা করতে হয়। তাহলে বাংলাদেশ কোন দিকে হাত বাড়াবে? এই অঙ্কই কষেছেন পিটার হাস। তাদের হাতে রয়েছে বিশ্বব্যাঙ্ক, আইএমএফ, রাষ্ট্রসঙ্ঘ এবং নানা মিশনের প্রভাব-প্রতিপত্তি। তিনি নিশ্চিত জানতেন, বিপদে পড়লে কোনওদিনই হাসিনার পাশে দাঁড়াবে না বেজিং!
আর্ল মিলারের পর বাংলাদেশে রাষ্ট্রদূত হয়েছিলেন পিটার। ২০২২ সালের মার্চে দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রথম কয়েক মাস স্বাভাবিক নিয়মে রুটিনমাফিক কাজ করে গিয়েছেন। কিন্তু ২০২২ সালের ডিসেম্বর থেকে তাঁকে দেখা যায় বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নানা বিষয়ে মাথা ঘামাতে। আসলে ‘হাসিনা বিরোধী’ লড়াইটা শুরু হয়েছিল বাংলাদেশে মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসকে ঘিরেই। হাসিনা বিরোধীরাও দ্রুত বুঝে গিয়েছিলেন আগামী দিনে তিনিই হবেন ‘পালাবদলের অনুঘটক’। ফলে মার্কিন দূতাবাসে বিএনপি নেতাদের আনাগোনাও বেড়ে যায়। উল্টোদিকে হাসিনা সরকার আমেরিকার সঙ্গে দূরত্ব ক্রমশ বাড়িয়ে চলেছিল।
২০২৩ সালের ২৪ মে নয়া ভিসা নীতি ঘোষণা করে আমেরিকা। বলা হয়, বাংলাদেশে যারা নির্বাচনকে বানচাল করার চেষ্টা করবে, আমেরিকা তাদের সে দেশে যাওয়ার ভিসা দেবে না। এর পরই সরকার বিরোধী আন্দোলন জোরদার হতে শুরু করে পদ্মাপারে। নয়া উদ্যমে আন্দোলনের নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি। বাংলাদেশের রাজনীতির আলোচনার মূল স্রোতে ঢুকে পড়ে সে দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ ‘সেন্ট মার্টিন’। আমেরিকা নৌঘাঁটি বানাতে দ্বীপটি নিতে চায় এবং বিএনপি দ্বীপটি ‘বিক্রির মুচলেকা’ দিয়ে ক্ষমতায় আসতে চায়—ক্ষমতাসীন আওয়ামি লিগের এই অভিযোগ ওয়াশিংটনে মার্কিন বিদেশ দপ্তরের প্রেস ব্রিফিং পর্যন্ত গড়ায়। মুখপাত্র ম্যাথু মিলার বলেন, এটি ঠিক নয়। গুঞ্জন উসকে দিয়ে হাসিনা বলেন, ‘যতই চাপ আসুক দেশের এক ইঞ্চি ভূখণ্ডও অন্য কোনও দেশকে ব্যবহারের অনুমতি দেওয়ার প্রশ্ন আসে না।’ এরপর বাংলাদেশে নির্বাচন নিয়ে মার্কিনিরা যে উতলা, তা টের পাওয়া যায় আমেরিকার দূতাবাসের সক্রিয়তায়। তবু ঘুম ভাঙেনি হাসিনা সরকারের। আওয়ামি নেতারা ব্যস্ত ছিল অঙ্ক কষতে, কীভাবে বিনা-নির্বাচনে পরের ভোট উতরে যাওয়া যায়।
এভাবে সময় গড়াতে গড়াতে আসে ২০২৩ সালের ২৮ অক্টোবর। ঢাকায় বিএনপির মহাসমাবেশ অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গণমাধ্যমকর্মীদের ব্যাপক মারধর। এক পুলিস হত্যা। প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলা সহ নজিরবিহীন তাণ্ডব দেখে ঢাকা। এই ঘটনায় কার্যত নিষ্ক্রিয় ছিলেন পিটার হাস। এই সময় শ্রীলঙ্কা হয়ে নিজের দেশ সফরের পর আর বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে প্রকাশ্যে কোনও কথা বলতে দেখা যায়নি তাঁকে। বরং আমেরিকার মুখে শোনা গিয়েছিল অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের কথা। কিন্তু আওয়ামি লিগের রাজনৈতিক উগ্রতায় শেষ দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের ছবিটা বদলে যায়। পরে অবশ্য সেই উগ্রতাই কাজে লাগিয়েছে বিরোধীরা। ভোট দিতে না পারার যন্ত্রণা উস্কে দিয়েছিল জনগণের মধ্যে।
শুরুটা হয়েছিল পড়ুয়াদের ‘কোটা আন্দোলন’ থেকে। তারপর আন্দোলনের অভিমুখ ঘুরে যায় ‘এক দফা’ দাবি। আন্দোলন-সংঘর্ষে উত্তাল হয়ে ওঠে পদ্মাপারের দেশ।
ফের লাল কালিতে লেখা শুরু হয় বাংলাদেশের ইতিহাস। লেখা চলছে...।