ব্যবসায় বেচাকেনা বেশ ভালো হবে। কাজকর্মে কোনও প্রভাবশালী ব্যক্তির আনুকূল্য লাভ ও ভাগ্যোন্নতি। ... বিশদ
বন্ধ থাকবে? লক্ষ লক্ষ গরিবকে দুর্ভোগে (পড়ুন, শাস্তি দিতে!) ফেলে। তাও একদিন, দু’দিন নয়, টানা দু’মাস। কিন্তু গত কয়েকদিন ধরেই দেখছি এত বিষ ছড়িয়েও, সবাইকে বিদ্রোহের লিটমাসে চুবিয়েও বাংলার অন্তর্নিহিত আনন্দমুখর প্রাণশক্তি, উৎসবপ্রিয় মনটাকে মেরে দেওয়া যায়নি একটুও। সব একই আছে। প্রমাণ হচ্ছে, ওটা অনুভবের ব্যাপার। হাড়গোড় ঘাঁটা ডাক্তারদের কম্ম নয়। তাই মহালয়া থেকেই বাঙালি মনে যেন সেই পুরনো খুশির ঝিলিক। শত দুঃখ কষ্টের মধ্যে নিজেকে খুঁজে পাওয়ার আকাশ বিস্তৃত তৃপ্তি। শিউলি গাছ শহরের ফ্ল্যাট কালচারে ব্রাত্য হলেও তার গন্ধ বেশ অনুভব করছি মনের কানায় কানায়। ছোট ছোট তারা নক্ষত্রের মতো ছেলেমেয়েরা হাত ধরাধরি করে মণ্ডপে ঢুকছে
বেরচ্ছে মধ্যরাতেও। ফুচকাওয়ালার আজ আর ভোররাতেও ঘরে ফেরার তাড়া নেই। আঙুলে বেলুন বেঁধে মায়ের সঙ্গে হাঁটছে পুচকে। পুজো যাপনের অপূর্ব এই আলোয় ভাসতে শুরু করেছে গ্রাম
বাংলা থেকে শহরের প্রাণকেন্দ্র। এটাই বাংলা। এটাই উৎসব। তাতে ফেরা মানে শিকড়ের কাছে ফেরা। ভেকধারীদের ‘আজাদি’ স্লোগানে সেই ভিত্তি সহজে ছিন্ন হওয়ার নয়।
এই পুজো শপথ নেওয়ারও। সত্যিমিথ্যে ছড়িয়ে বাংলার বদনাম করা বন্ধ হোক। বিশেষ করে দেশে বিদেশে ছড়িয়ে থাকা প্রবাসীদের অবিরাম বিষবর্ষণ। আমেরিকায় বসে পিতা মাতাকে ভুলে যাওয়া বাঙালিও সকালসন্ধে ‘বিচার’ চাইছে। প্রতিবাদ করছে। অথচ অনেকেই বাবা, মার শেষকৃত্যেও দেশে ফিরতে পারেনি বা প্রয়োজন বোধ করেনি। দু’রাত পিস ওয়ার্ল্ডে থাকার পর দাহ করেছে পাশের বাড়ির লোক! তাঁদের কাছে অভয়াকে কারা কীভাবে মেরেছে, সেই ধারাবিবরণী শুনে অবাক হচ্ছি। এত তথ্য তো সিবিআইয়ের কাছেও নেই! সিবিআইকে ভাগিয়ে ইউটিউবওয়ালাদের কাউকে তদন্তভার দিলে তো এতদিনে বিচার সম্পূর্ণ হয়ে যেত। কোনও কোর্ট কাছারির দরকারই হতো না! কিন্তু বাংলার বদনাম করে কার লাভ? আমরা যাঁরা এখানেই থাকব, বাইরে যাব না, তাঁদের বলি রাজ্যটার বদনাম করে আপনার রুটিরুজি নিরাপদ থাকবে তো? আপনি মাথা উঁচু করে বাঁচতে পারবেন তো? আমেরিকাতেও কিন্তু নিয়ম করে স্কুলে গুলি চলে। ধর্ষণ হয়, খুনখারাবি লেগেই থাকে। মাসে অন্তত হাফ ডজন এমন খবর ছাপতে হয় আমাদের। উত্তরপ্রদেশে, মহারাষ্ট্রে, বেঙ্গালুরুতে একটাও খুন ধর্ষণের ঘটনা ঘটে না, বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবেন তো? বিদেশে বসবাস করা প্রবাসীরা বাংলার নামে নাক সিঁটকোচ্ছেন। অথচ দিল্লি থেকে হাতরাস, আমেরিকা থেকে ব্রিটেন, কোথায় বলুন তো ধর্ষণ-খুনের ঘটনা ঘটেনি গত একমাসে। আমেরিকায় পুলিসি হেফাজতে এক কৃষ্ণাঙ্গকে মেরে ফেলা হয়েছে। প্রায় প্রতি সপ্তাহে নিয়ম করে কোনও না কোনও স্কুলে গুলি চলছে। মৃত্যু হচ্ছে। কই কোথাও তো আমেরিকার বদনাম করার জন্য সবাই মুখিয়ে নেই। তাহলে দোষীকে শাস্তি না দিয়ে বাংলার এত বদনামে ক্ষতি কার? বাজার পণ্ড করে গরিব মানুষকে ভাতে মারার চেষ্টাই বা কেন? সামনাসামনি ভোটে জেতার কোনও সম্ভাবনা নেই বলেই এত গরল বর্ষণ?
অবশেষে জুনিয়র ডাক্তারদের দীর্ঘ কর্মবিরতি উঠল। কিন্তু এই সিদ্ধান্তের সঙ্গে এল ২৪ ঘণ্টার মধ্যে দাবি না মিটলে অনশনের হুমকি। পুজোর
মধ্যে অনশন কোনকালে হয়েছে? কী চাইছে মেধাবী ছেলেমেয়েরা? যদি ভিড় আরও পাতলা হয়, সেই ভয় থেকেই কি অনশনের মধ্যে দিয়ে আন্দোলন জিইয়ে রাখার চেষ্টা? বলতেই হবে, কর্মবিরতি প্রত্যাহারও লক্ষ লক্ষ গরিব রোগীর স্বার্থে নয়। সিনিয়র ডাক্তাররা যাতে পুজোর ছুটি পুরোদমে উপভোগ করতে পারেন তার জন্য। প্রশ্ন উঠবেই সিনিয়ররা এতদিন পর যখন কর্মবিরতি তুলতে সক্রিয় হলেন, তখন এতদিন চুপ করে বসেছিলেন কেন? টানা দু’মাস কেটে গিয়েছে। সুপ্রিম কোর্ট, রাজ্য সরকার থেকে শুরু করে সব পক্ষ বারবার নির্দেশ দিয়েছে হাসপাতালগুলিকে সচল করার। সবাই জানে বিচার একদিনে আসে না। তার একটা পদ্ধতি আছে। আইন আছে। নিম্ন আদালত থেকে সর্বোচ্চ আদালত ঘুরেই বিচার সম্পূর্ণ হয়। সেইসঙ্গে তদন্ত কতটা সফল, চার্জশিট কতটা শক্তিশালী তারও চুলচেরা যাচাই চলে। সৌভাগ্য কিংবা দুর্ভাগ্য যাই বলুন, ফেসবুক কিংবা ইউটিউবের তথ্যের উপর ভিত্তি করে এখনও এদেশে কারও ফাঁসি কিংবা যাবজ্জীবন সাজা হয় না! সৌদি আরবের মতো প্রকাশ্যে কোতলও এখানে নিষিদ্ধ।
জুনিয়র ডাক্তাররা বিচারের নামে ঠিক কী চাইছেন? কয়েকশো ঘণ্টার জিবি বৈঠকের মোদ্দা নির্যাস কী? বোধহয় এই মুহূর্তে স্বয়ং ঈশ্বরও তা জানেন না। বিচার চাওয়ার দাবিতে যে আন্দোলনের শুরু তা আজ পথ হারাইয়াছে ব্যক্তিগত ইগো আর রাজনীতির কানাগলিতে। চিড় ধরতে শুরু করেছে। সিনিয়র ডাক্তাররাও বেশ বুঝতে পারছেন নিজেদের অজান্তেই তাঁরা ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন তৈরি করে ফেলেছেন। সুপ্রিম কোর্ট বারংবার সম্পূর্ণভাবে কাজে ফিরতে বলেছে। শিক্ষানবিশ চিকিৎসকরা তা মানেননি। উল্টে সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশ অগ্রাহ্য করেই লক্ষ লক্ষ রোগীকে ভয়াবহ দুর্ভোগে ফেলেছেন। রাজ্য সরকার তাঁদের অধিকাংশ দাবি মেনে নিয়েছেন। অত্যন্ত নমনীয়ভাবে মুখ্যমন্ত্রী তাঁদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। তার আগে জুনিয়র ডাক্তারদের ধর্না মঞ্চে গিয়েছেন। তাঁদের কৌঁসুলি প্রখ্যাত আইনজীবী ইন্দিরা জয় সিং সুপ্রিম কোর্টে দাঁড়িয়ে বলেছেন, তাঁরা কাজে ফিরেছেন। এবং স্বাস্থ্য পরিষেবা স্বাভাবিক করার চেষ্টা হচ্ছে। কিন্তু তারপরও নতুন করে এতদিন টানা এই কর্মবিরতি চালিয়ে যাওয়ার অর্থ কী? প্রথমে যে সিনিয়র ডাক্তাররা সহানুভূতি জানিয়েছিলেন, তাঁরাও আজ বিরক্ত। তাঁরা প্রথমে সমর্থন জানিয়েছিলেন, মদত দিয়েছিলেন। জুনিয়র চিকিৎসকরা কর্মবিরতিতে যাওয়ায় তাঁদের অতিরিক্ত ডিউটিও করতে হয়েছে গত দু’মাস ধরে। কিন্তু নানা বাহানায় রাজ্যের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে পঙ্গু করার চেষ্টা কেউ সমর্থন করে না। এটা ঠিক জুনিয়রদের পক্ষে শুরুতে একটা জনসমর্থন ছিল বলেই সরকারও সুপ্রিম কোর্ট বলার পরও অত্যন্ত সংযতভাবে পদক্ষেপ করছিল। কিন্তু তরুণ চিকিৎসকদের বাড়াবাড়িতে সেই নৈতিক জায়গাটা দ্রুত নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এটা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, এই আন্দোলন আর শুধু হাসপাতালের নিরাপত্তা এবং অভয়ার বিচারে সীমাবদ্ধ নেই, বৃহত্তর কোনও চক্রান্ত ও ব্লুপ্রিন্টের অঙ্গ। তাই এনআইএ পর্যন্ত আসরে নেমেছে।
ছোটবেলা থেকে জেনে আসছি, হাসপাতাল, দমকল, দুগ্ধ সরবরাহ, সংবাদপত্র জরুরি পরিষেবার অধীন। হাজারো সমস্যা, বিরোধ, মন কষাকষি, দাবিদাওয়া নিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে মতভেদ হলেও পরিষেবা বন্ধ রাখা যায় না। পরিষেবা দিতে পারব না বলে কখনও কাউকে ফিরিয়ে দেওয়া যায় না। এমনিতেই উৎসবের সময় হাসপাতালে সিনিয়র চিকিৎসকদের পাওয়া যায় না। কারও পরিবারে পুজোর মধ্যে কেউ গুরুতর অসুস্থ হলে উদ্বেগ ও চিন্তা স্বভাবতই বেড়ে যায় কয়েক গুণ। তার উপর যদি সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ‘ব্যাকবোন’ জুনিয়ররাই পূর্ণ উদ্যমে না থাকেন তাহলে পরিণতি কতটা শোচনীয় হতে পারে, তা সহজেই অনুমান করা যায়। এবারও বহু ডাক্তারের বিমান ও হোটেল বুকিং অনেক আগে থেকেই সারা। কিন্তু ওই যে বললাম, আন্দোলনের রাশ এখন সিনিয়রদের হাতেও নেই, সম্পূর্ণ জুনিয়রদের হাতেও নেই। অরাজনৈতিক মঞ্চ থেকে একটা পৈশাচিক ঘটনার প্রতিবাদে যে আন্দোলন আপামর বাঙালির আবেগ ও সমর্থনে শুরু হয়েছিল তা আজ কুটিল রাজনীতির হাতে বন্দি। আর বন্দি বলেই সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ, রাজ্য সরকারের সহানুভূতি, সাধারণ মানুষের অপরিসীম দুর্ভোগ কোনও কিছুতেই কুছ পরোয়া নেই। শিক্ষানবিশ চিকিৎসকদের এই ভূমিকা মোটেই সমর্থনযোগ্য নয়।
কিন্তু এতে দু’মাস ধরে শাপে বর হল কাদের? ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা মাঝারি মাপের নার্সিংহোমের। শহরের পাঁচতারা কর্পোরেট হাসপাতাল মালিকদের। মার খেতে খেতে কোণঠাসা গরিব মানুষ যে তিমিরে সেই তিমিরেই। এই কি বিচারের নমুনা? আর টানা দু’মাস ধরে যারা বাংলার দুর্নাম করলেন তাঁরা কতটা লাভবান হলেন? বিচার এখনও মেলেনি। সিবিআই লক্ষ্যভেদ করতে ব্যর্থ। নানা সম্ভাবনা হাতড়ে বেড়াচ্ছেন মাত্র। আর বাম, অতি বাম মিলে বিচারের আড়ালে বাংলার বদনাম করতেই ব্যস্ত। গোটা বিশ্ব বাংলার সমালোচনা করলে শূন্য হয়ে যাওয়াদের বুক যদি গর্বে ফুলে ওঠে,
তাহলে তাই করুন। কিন্তু বাম ও অতি বামদের এই চক্রান্তে পা দিয়ে আপনার আমার লাভ কতটা? বাংলা ও বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব এসে গিয়েছে। রাজনীতি, সমালোচনা, বদনামের জন্য তো বাকি বছরটা পড়ে আছে। এই ক’টা দিন ছেড়ে দিলে কি মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যেত? নাকি বিচারের
আড়ালে বৃহত্তর কোনও রাজনৈতিক এজেন্ডা আছে? মানুষ কিন্তু বোকা নয়। উৎসবটা ভালোয় ভালোয় কেটে যাক। ঠিক সময়ে আবারও জবাব দেবে আম জনতা। ফেসবুক, ইউটিউব, ইনস্টাগ্রামে নয়, সরাসরি ভোটযন্ত্রে।