বিশেষ কোনও কর্মের আর্থিক সংস্থান নিয়ে মানসিক চিন্তা বৃদ্ধি পাবে। আর্থিক ঝুঁকি নেবার আগে দুবার ... বিশদ
বারাণসী থেকে একটা গাড়ি ভাড়া করেছি। ড্রাইভার রাম সিং বেজায় ভালো মানুষ। সব কথাতেই হাসেন। বাংলায় সুন্দর কথা বলেন। কিছুক্ষণ ঘিঞ্জি বাড়িঘর পেরিয়ে সুন্দর রাস্তায় গিয়ে উঠলাম। হেমন্তের বাতাস বেশ শীতল। গাড়ির জানলা দিয়ে ঠান্ডা হাওয়ার ঝাপটা মারে। গায়ে রোদ পড়লে আরাম লাগে। দু’পাশে বাজরা, ভুট্টার খেত, ছোট ছোট গ্রাম। এ গ্রাম পশ্চিমবঙ্গের গ্রামের মতো নয়। একটু অন্য ধরনের। প্রতি গ্রামে একটা-দুটো করে বড় কুয়ো। কপিকলে জল উঠছে। বেশ কিছু কিলোমিটার যাওয়ার পর সামনের প্রকৃতি বদলে যেতে লাগল। সবুজ খেতখামার কমে আসতে লাগল। দূরে মেঘের মতো পাহাড় দেখা দিতে লাগল। মাটি রুক্ষ হল। রাস্তার দু’ধারে বড় বড় পাথর পড়ে আছে। শাল, সেগুন, পলাশ, মহুয়া আকাশমণি গাছের জঙ্গল কোথাও বা কুসুম, কেন্দু নজরে আসে। অল্প অল্প পাতা ঝরা শুরু হয়েছে। দমকা হাওয়ায় শুকনো পাতা উড়িয়ে নিয়ে যায়।
সুন্দর নয়নাভিরাম এই দৃশ্য দেখতে দেখতেই চলেছি চন্দ্রপ্রভা জাতীয় অরণ্যের দিকে। বিন্ধ্য পর্বত এই শুরু হয়ে চলে গিয়েছে মধ্যপ্রদেশের পূর্বদিক বরাবর। চারদিক নির্জন নিঃস্তব্ধ। কোথাও পর্যটক তেমন চোখে পড়েনি। ডানদিকে ঘুরে বিরাট ফটকের সামনে দাঁড়াই। এইখানে এন্ট্রি টিকিট কাটতে হল। মাথাপিছু পঞ্চাশ টাকা। এছাড়া গাড়ি ভেতরে ঢুকলে আরও একশো টাকা অতিরিক্ত। আর ক্যামেরার ভাড়া পাঁচশো টাকা! ছবি তুলব বলেই এপথে বেড়াতে এসছি। অতএব নগদ পাঁচশো টাকা দিয়ে ক্যামেরা নিয়ে প্রবেশ করলাম। গভীর জঙ্গল তার আন্দাজ পাই। শব্দের উৎসকে নিশানা করে এগিয়ে যাই। সামনে একটা বিরাট জলপ্রপাত। অনেক ওপর থেকে জল তীব্র বেগে নীচে পড়ছে। এক জায়গায় এসে দেখি খানিকটা চাতালের মতো সব দিক স্টিলের রেলিং দিয়ে ঘেরা, গাছের ছায়ায় ছায়াময়। রেলিং এর ধারে দাঁড়ালে নীচে গভীর খাদ চোখে পড়ে। বাঁদিকে একশো ফুট উঁচু থেকে জলধারা পাথরের গা বেয়ে নীচে আছড়ে পড়ছে। নীচে পড়ে বয়ে চলে যাচ্ছে পাথরের উপর দিয়ে এঁকেবেঁকে। দু’পাশে গভীর জঙ্গল। জলের শব্দের তীব্রতা এতই বেশি একটানা শুনলে কানে তালা লেগে যায়। পিছনেই একটি ইরিগেশন বাংলো রয়েছে। একজন স্থানীয় লোক যাচ্ছিলেন। তাঁকে জিজ্ঞেস করতে জবাব দিলেন, সেটি পিডব্লুডি-র বাংলো। মিরজাপুর থেকে বুকিং হয়, বর্তমানে বন্ধ। অনেকক্ষণ দাঁড়ানোর পর একটু না বসলেই নয়। হেমন্তের বেলা ছোট হয়ে আসছে। গাছের ছায়া দীর্ঘতর হচ্ছে। একটু দূরে একটা ছোট ক্যান্টিন। জোরে বাতাস বইছে। ছোট রেস্তরাঁ থেকে চা আর ডাবল ডিমের ওমলেট খেয়ে গাড়ির দিকে এগই। রাম সিংকে জিজ্ঞেস করি এই জলপ্রপাতের কোনও নাম দেখছি না। ও উত্তর দেয় রাজধারি জলপ্রপাত। ভারতের মোটামুটি নামী জলপ্রপাতগুলির অন্যতম। শালের এই জঙ্গলে মহুয়া, পলাশ, কুসুমও রয়েছে। কোথাও বুনো জাম গাছ। খানিকটা যাওয়ার পর এক জায়গায় নামতে হয়। গাড়ির রাস্তা এই অবধি। এরপর হেঁটে যাই সামনের দিকে দূরে নজরে আসে সিঁড়ি। তা দিয়ে উপরে উঠতেই আবারও একটি জলপ্রপাত। তার নীচে জলাধার তৈরি হয়েছে। দূর থেকে দেখলে জলের রং পান্না সবুজ লাগে। চারদিক পাহাড় জঙ্গল দিয়ে ঘেরা নিঃস্তব্ধ পরিবেশ। এখানে একটা ফলক নজরে আসে। এই জলপ্রপাতের নাম দেবদারি জলপ্রপাত। এই জলপ্রপাতের তীব্রতা অবশ্য রাজধারি জলপ্রপাতের চেয়ে অনেক কম।
এত সুন্দর জায়গায় এলাম অথচ থাকতে পারব না। এদিকে থাকার ইচ্ছাটা তীব্র হচ্ছে। রাম সিংকে সেকথা জানালে সে সুন্দর এক রিসর্টের সন্ধান দিল। কয়েকটা কটেজ আর টেন্ট মিলে থাকার বন্দোবস্ত। ওখানে একটা খাওয়ার ব্যবস্থাও আছে। এত দূর এসেছি যখন চেষ্টা করতে দোষ কী? কেয়ারটেকার এদিকেই আসছিল ওর দিকে এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘রহনে কা কুছ ব্যবস্থা হোগা?’
কেয়ারটেকার উত্তর দেয়— ‘জি এক কটেজ খালি হ্যায়।’ সঙ্গে সঙ্গে বুকিংয়ের অনুরোধ করতেই সে আমাকে তার সঙ্গে যেতে বলে। রেজিস্টারে সই করে টাকা দিয়ে দিই। ডিনারের মেনু আগে থেকেই জানিয়ে দেয় কেয়ারটেকার ভাত, ডাল, গরম বেগুন ভাজা, আলু-ফুলকপির তরকারি আর মুরগির ঝোল।
ছায়া দীর্ঘ হচ্ছে, ক্রমশ অন্ধকার নেমে আসছে। রিসর্টের সামনের বারান্দায় গিয়ে বসি। অজস্র পাখির ডাক, বিচিত্র সব শব্দ। এতক্ষণ বিদ্যুৎ ছিল না, জেনারেটারের সাহায্যে বিদ্যুৎ সংযোগ চালু হতে মোবাইল, ক্যামেরার ব্যাটারি চার্জে বসালাম। এর মধ্যে চলে এল চিকেন পকোড়া আর কফি। কেয়ারটেকারের সঙ্গে পরিচয় হয়ে যায়। গয়াতে বাড়ি, মাসে একবার বাড়ি যায়। রাত আটটার মধ্যে খাবার দিয়ে যায়। এত আগে তো খিদে পায় না। কিন্তু যস্মিন দেশে যদাচার। তাছাড়া এখানকার কর্মীদের বাড়ি আট দশ কিলোমিটার দূরে। এই নিঝুম সন্ধ্যায় জঙ্গলের পথে যেতে হবে।
সন্ধ্যা নামলে চন্দ্রালোকিত অরণ্য এক অপরূপ রূপ ধারণ করল। আলো আকাশ থেকে চুঁইয়ে পড়ছে। আলোর তীব্রতা এতই বেশি কাছের গাছপালা পায়ের তলার রাস্তা সব কিছুই স্পষ্ট। গাছের তলায় আলো আঁধারির অদ্ভুত এক নকশা। বেশ কিছুটা দূরে উপজাতিদের গ্রাম। শবর, মাহাতো, হাঁসদা, সাঁওতাল গ্রাম। কাল পূর্ণিমা, আজ ওরা উৎসবের আনন্দে মাতোয়ারা। ভেসে আসে ধামসা মাদলের শব্দ। নির্জন প্রান্তরে সেই শব্দ কেমন অপার্থিব মনে হয়। তাড়াতাড়ি খেয়ে নিই, সারাদিনের ধকল গিয়েছে।
ভোরবেলা ঘুম ভেঙে যায়। অন্ধকার তখনও মুছে যায়নি। আকাশে হালকা আলোর রেখা ফুটেছে। বেরিয়ে পড়ি জঙ্গলের পথে। বুনো সোঁদা গন্ধ আসে নাকে। ভোরবেলা অরণ্যের পথে শুকনো ঝরাপাতা মাড়িয়ে হেঁটে যাওয়ার আনন্দই আলাদা। হাঁটতে হাঁটতে অনেকটা চলে এসেছি। সবই একরকম রাস্তা, ভয় হয় যদি গুলিয়ে ফেলি। আকাশ ফর্সা হয়েছে। হালকা ঠান্ডা হাওয়া দিচ্ছে। আকাশের দিকে তাকাই ধনুকের মতো মেঘ প্রথম আলোয় অদ্ভুত এক মাধুরী ফুটিয়েছে। ফিরে আসতে খুব একটা অসুবিধে হয় না। প্রথম রোদ এসে পড়েছে বারান্দায়। দারুণ লাগছে সেই ওম।
রাম সিং আজ আমাদের নিয়ে যাবেন চন্দ্রপ্রভা ড্যাম দেখতে। উঁচু নিচু পাথুরে রাস্তা, লাফাতে লাফাতে চলেছে আমাদের গাড়ি। রাস্তায় দু’টি নেকড়ে বাঘ চোখে পড়ে। ক্যামেরা তাক করার মুহূর্তে রাস্তা পেরিয়ে জঙ্গলের পথে অদৃশ্য হয়ে যায়। চন্দ্রপ্রভা ড্যাম সত্যিই অসাধারণ, নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। ছোট ছোট টিলা আর অরণ্য ঘেরা পরিবেশ এখানে। ফিরে এসে আবার বারান্দায় ইজি চেয়ারে বসি। ঠান্ডা হাওয়া দিচ্ছে সেই সঙ্গে বাতাসের মর্মরধ্বনি। আরও একটা দিন কেটে যায়। পরদিন সকালে লুচি আলুর তরকারি খেয়ে বেরিয়ে পড়ি বারাণসীর উদ্দেশ্যে।
কীভাবে যাবেন: ট্রেনে বা বিমানে বারাণসী এসে গাড়ি বুক করে আসতে হবে চন্দ্রপ্রভা। দূরত্ব মোটামুটি ৭০ কিলোমিটার। থাকার জন্য রাজধারি রিসর্ট বুক করা যায়। লগ ইন করুন www.rajdhariresort.com। ইমেল আইডি: rajdariresort@gmail.com