বিশেষ কোনও পারিবারিক কারণে মানসিক দুশ্চিন্তা বাড়তে পারে। কাজকর্মের ক্ষেত্রে বিশেষ সুখবর পেতে পারেন। ... বিশদ
শৈলশহর শিলংয়ে পৌঁছতে গুয়াহাটি থেকে ছয় নম্বর জাতীয় সড়ক ধরলে ঘণ্টা তিনেক সময় লাগবে। পথেই দেখা হল মেঘালয়ের বৃহত্তম হ্রদ উমিয়াম লেকের সঙ্গে। তবে স্থানীয়দের মুখে এই লেক বড়াপানি নামেই প্রচলিত। পড়ন্ত বেলার সূর্য কিরণে পশ্চিম আকাশ তখন আবির খেলায় মত্ত আর বড়াপানির সুবিশাল গাঢ় নীল জলরাশিতে তখন বেলা শেষের ক্লান্ত ছায়া। পূর্বের স্কটল্যান্ড নামে খ্যাত মেঘালয়ের দ্রষ্টব্য স্থানগুলো প্রধানত রাজধানী শিলং ও শোহরাকে ঘিরে অবস্থিত। শোহরা কিন্ত এখনও বিখ্যাত সেই চেরাপুঞ্জি নামেই। মেঘেদের এই রাজ্যে আছে একাধিক ঢেউ খেলানো পাহাড়, ছোট-ছোট ঝোরা, অপরূপ সুন্দর চোখজুড়ানো জলপ্রপাত, মালভূমি ও দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ প্রান্তর। গ্রীষ্ম, বর্ষা, শীত প্রতিটি ঋতুতে মেঘালয় সেজে ওঠে অচেনা নতুন সাজে। বৃষ্টি ভেজা চেরাপুঞ্জি বা কুয়াশা মাখা শিলং প্রতিদিনই তার সহজ সরল জনজীবনের এক নিটোল গল্প। আর এই গল্পের টানেই সবাই আসে মেঘ-পাহাড় ও ঝর্ণার দেশ মেঘালয়ে। সহজ-সরল মানুষগুলোর কঠিন সংগ্রাম ও জীবনাদর্শ কীভাবে একটি জাতিকে উন্নতির শিখরে
পৌঁছে দিতে পারে তা মেঘালয়ে
এলেই বোঝা যায়।
শিলংয়ের আকর্ষণীয় স্থানগুলোর মধ্যে এলিফ্যান্ট ফলস, শিলং পিক ও মূল শহর থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরের লাইটলুম ক্যানিয়ন প্রায় সবারই একটি স্বপ্নের গন্তব্য। শিলংয়ে একটি রাত কাটিয়ে পরদিন ভোরেই রওনা দিলাম ৮৪ কিমি দূরে ডাউকির পথে। উমগট নদীর তীরে ডাউকি ছাড়াও রয়েছে আর দু’টি সুন্দর গ্রাম দারাংগ ও শনংপেডং। রংবেরঙের সব নৌকা দাঁড়িয়ে নদীর পাড়ে, নির্ধারিত নৌকায় ভেসে পড়লাম এশিয়ার সবচেয়ে স্বচ্ছ নদীর জলে। শীতকালে কাচের মতো পরিষ্কার থাকে এই নদীর জল। মনে করা হয় এই নদীর স্বচ্ছতা সমগ্র মেঘালয়ের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, সতেজতা ও সার্বিক পরিচ্ছন্নতার নিদর্শন। ডাউকির কাছেই সীমান্তবর্তী তামাবিল চেকপোস্টের ওপারে বাংলাদেশের সিলেট শহর।
একটি সম্পূর্ণ দিন হাতে রাখতে হয় ডাউকি ও তার আশপাশের গ্রাম ঘুরে দেখার জন্য। উমগট নদীর হিমেল হাওয়ায় নৌকা বিহার মেঘালয়ের একটি স্মরণীয় উপহার।
মেঘালয়ের আসল সৌন্দর্য যা সকলকে বিমোহিত করে তা হল চেরাপুঞ্জির জলপ্রপাত। মৌসিনরামের পূর্বে চেরাপুঞ্জি ছিল পৃথিবীর সর্বাধিক বৃষ্টিপাতের স্থান তবে বৃষ্টির পরিমাণ নির্ণয়ে কম বেশি কিছুটা হলেও চেরাপুঞ্জির জলপ্রপাতগুলো বর্ষায় হয়ে ওঠে প্রাণবন্ত। তার শব্দ শোনা যার বহুদূর থেকে পাহাড়ের বাঁকে বাঁকে। শিলং থেকে চেরাপুঞ্জি যাওয়ার পথেই দেখে নিলাম ডেইনথেলেন জলপ্রপাত, সেভেন সিস্টার্স ওয়াটার ফলস ও ওয়া-কাবা ফলস যার দিকে শুধু তাকিয়ে থাকা যায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা ভাষাহীন নিষ্পলক চোখে। চেরাপুঞ্জির কাছে মাওসমাই গুহা মেঘালয়ের আবিষ্কৃত সেরা গুহাগুলোর মধ্যে অন্যতম।
অন্ধকার সংকীর্ণ গুহাপথে কখনও হামাগুড়ি দিয়ে কখনও বা নিচু হয়ে বেঁকে আলতো করে শরীরকে দুটো পাহাড়ের মধ্যে দিয়ে এলিয়ে কোনওমতে এগিয়ে গেলাম গুহাপথের অন্দরে, অবাক নয়নে দেখলাম চুনাপাথরের রাসায়নিক বিক্রিয়ায় তৈরি হওয়া অপূর্ব এক প্রাকৃতিক ভাস্কর্য।
চেরাপুঞ্জিতে আজ আমাদের দ্বিতীয় দিন। সকালে জলখাবার খেয়ে রওনা দিলাম আমাদের মেঘালয় ভ্রমণের উইশলিস্ট-এর সেরা আকর্ষণ, ডাবল ডেকার লিভিং রুট ব্রিজের উদ্দেশ্যে। চেরাপুঞ্জি থেকে প্রায় ১৫ কিমি দূরত্ব তিরনী গ্রামের। রুট ব্রিজের প্রবেশদ্বার। এখানে পৌঁছতে সময় লেগেছিল প্রায় এক ঘণ্টা। সরু পথের দু’ধারের ঘন জঙ্গল। পথে যেতে যেতে দেখতে পেলাম ঘোমটা পরা মেঘেদের আকাশ জুড়ে জাদুর খেলা। বাতাসের ছন্দে, কখনও মৃদু আন্দলনে, কখনও বা বাতাসের তীব্র গতির আলিঙ্গনে মেঘেদের আশ্চর্য সব মায়াবী রূপ। নীল আকাশে ধবল মেঘেদের এই ইন্দ্রজাল মেঘালয়ে এলেই শুধু
দেখা যায়।
গোটা মেঘালয় জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে প্রচুর রুট ব্রিজ। তবে নংরিয়াট গ্রামে উমশিয়াং নদীর ওপর এই জীবন্ত ডাবল ডেকার সেতুটি মেঘালয় ছাড়া পৃথিবীর আর অন্য কোনও দেশে আছে কিনা, আমার জানা নেই।
রাবার গাছের শরীর থেকে বেরিয়ে আসা শক্তপোক্ত শেকড় দ্বারা তৈরি হয় এই সেতুগুলো। কখনও ফাঁপা গাছের গুঁড়ির মধ্যে দিয়ে, কখনও
বা দু’পারের দু’টি গাছের শিকড় টানটান করে বিনুনির মতো একে অপরের সঙ্গে জড়ানো হয়। এই শিকড়গুলোর দৈর্ঘ্য একশো ফুটের বেশি বই কম নয়।
গাড়ি আমাদের নামিয়ে দিল একটি তোরণের সামনে। সেখান থেকে জঙ্গল পথে অন্ততপক্ষে সাড়ে তিন হাজার সিঁড়ি ভেঙে পৌঁছতে হবে আশ্চর্যের সন্ধানে। সামনের দোকান থেকে সবাই একটা করে বাঁশের লাঠি সংগ্রহ করলাম। শুরু হল পথ চলা। নামা ওঠা সব মিলিয়ে মোট ৭০০০ সিঁড়ি। দূর থেকে দেখলে মনে হয় শেষ সিঁড়িটা বুঝি পৌছে দেবে মহিরাবনের পাতালে।
প্রায় দেড় হাজার সিঁড়ি অতিক্রম করে পৌঁছলাম নংথিম্মাই গ্রামে । জঙ্গল ও পাহাড়ের ঘেরাটোপে নদীর পাশে গড়ে উঠা সুন্দর এই গ্রামের চারদিকে শুধু ফুলের মেলা। গ্রামের মধ্যে দিয়ে কিছুটা এগিয়ে পৌঁছে গেলাম একটি জীবন্ত সেতুর কাছে যার নীচ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে পাহাড়ি নদী। সেতু পার করে, নদীর পিচ্ছিল
পাথরে পা ফেলে ফেলে মিলিত হলাম আবার সিঁড়ি পথের সঙ্গে। এভাবে সিঁড়ি পথ বেশ কিছুটা কম হল বটে তবে জীবন সংশয়ের মারাত্মক ঝুঁকি নিয়েছিলাম আমরা।
এরপরের পথটুকু কখনও প্রাণান্তকর চড়াই আবার কখনও বা উতরাই। সিঁড়ি পথ ধরে নামা, ওঠার চেয়ে সহজ মনে হলেও দীর্ঘ সিঁড়ি পথে নামার ফলে পায়ে জড়তা
আসে, তাই মাঝে মাঝে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে আমরা চলতে থাকি। শারীরিক শক্তি বজায় রাখতে সঙ্গে নিয়ে এসেছিলাম কিছু শুকনো খাবার ও জল। সিঁড়ি ও নদী পথে নীচে নামতে আমাদের লেগেছিল প্রায় আড়াই ঘণ্টা ও পুনরায় উঠে আসতে সারে তিন ঘণ্টার মতো। অবশেষে পৌঁছলাম সেই স্বপ্নের গন্তব্যে। দেখলাম বহুকাঙ্ক্ষিত সেই দৃশ্য। সবুজ বনে ঢাকা পাহাড় থেকে বেরিয়ে আসা ঝর্ণার জল জমা হচ্ছে একটি কুণ্ডে। তারপর সেখান থেকে উমশিয়াং নদী হয়ে বয়ে চলেছে সেতুর নীচ দিয়ে। কুণ্ডের জলে পা ডুবিয়ে বসতেই ছেঁকে ধরল মাছেদের দল। অনেকেই বসে আছে, আমরাও কিছুক্ষণ বসলাম ন্যাচারাল পেডিকিওরের আশায়। অরণ্য মাঝে গড়ে উঠা এই সেতু শুধু প্রকৃতির বিরল উপহারই নয়, মানুষ ও প্রকৃতির নিবিড় বন্ধনের অটুট সাক্ষী। মানুষের যত্নে তিল তিল করে বেড়ে ওঠা শিকড় সেতু স্থায়ী হয় দীর্ঘ বছর। মানুষ ও প্রকৃতির একে অপরের প্রতি বিশ্বাস, নির্ভরশীলতা ও আজীবন একসঙ্গে পথ চলার গল্প শোনায়।
পাহাড়ে শীতের সন্ধ্যা নামে বড্ড তাড়াতাড়ি। তাই বিকেল থাকতেই ফেরার পথ ধরলাম, একরাশ ভালোলাগা ও স্বপ্ন পূরণের আনন্দে উচ্ছ্বসিত হয়ে।
কীভাবে যাবেন, কোথায় থাকবেন: প্রথমে ট্রেনে অথবা প্লেনে গুয়াহাটি আসতে হবে ও সেখান থেকে বাস, শেয়ার কিংবা রিজার্ভ গাড়িতে শিলং আসা যায়। শিলংয়ের পুলিস বাজারে রয়েছে প্রচুর বাজেট ফ্রেন্ডলি হোটেল। তবে অনলাইন বুকিং করে আসাই ভালো। চেরাপুঞ্জিতে হোম স্টে, হোটেল উভয়ই উন্নত মানের, নিজের পছন্দের যে কোনওটাতে থাকা যায়।