কাজকর্মের ক্ষেত্রে দিনটি বিশেষ শুভ। নতুন যোগাযোগ ও উপার্জন বৃদ্ধির ক্ষেত্র প্রস্তুত হতে পারে। বিদ্যায় ... বিশদ
বেনারস থেকে বেরিয়ে এলাহাবাদ পৌঁছতে বিকেল হয়ে গেল। নিজেদের মতো গেলে যা হয় আর কী! এই জায়গায় আরও দুটো ফোটো তো ওই জায়গায় আর একটু বেশি কেনাকাটা চলতেই থাকে। তাছাড়া মন্দিরের শহর, ঘাটের শহর, প্রাচীন ঐতিহ্যের বারাণসীর মায়া ছেড়ে যাওয়া বেশ কঠিন।
যাই হোক পৌঁছলাম প্রয়াগরাজে। হোটেলে লাগেজ রেখে সবাই বসে আগামী দিনের পরিকল্পনাটা সাজিয়ে নিলাম। ঠিক হল ভোর ভোর বেরিয়ে সঙ্গমে যাওয়া হবে। সেই উদ্দেশ্যেই আসা।
সঙ্গমের যাত্রাপথে দেখতে দেখতে শুনে চলেছি অটো ড্রাইভারের ধারাভাষ্য। ‘মাইজি, কুম্ভ মেলা মে বহুত জাদা ভিড় হোতা হ্যায়। গাড়ি বন্ধ হো যাতা হ্যায়। পয়দল চলতে হ্যায় লোক।’
এমনিও দেখলাম বহু মানুষ পুণ্য সঞ্চয়ের উদ্দেশ্যে হেঁটে চলেছেন সঙ্গমের দিকে। রাস্তার দুইপাশে ফুল আর প্রদীপের পসরা সাজিয়ে দোকানিরা।
নদীর তীরের কাছে পৌঁছতে না পৌঁছতেই মাঝিদের হাঁকডাক শুরু হল। সারি সারি নৌকা বেশ বাধ্য ছেলের মতো দাঁড়িয়ে। দরদাম সেরে একটায় উঠে বসলাম। চলল পানসি। পাশাপাশি চলতে থাকল মাঝি ভাইয়ের কথা ও কাহিনি।
নৌকা দু’রকম— পান্ডা সহ প্রাইভেট নৌকো। পান্ডা ছাড়া পাবলিক নৌকো।
গঙ্গা, যমুনা আর সরস্বতীর সঙ্গমস্থলে পৌঁছে দেখলাম গঙ্গার জল অনেকটা তেজপাতার মতো, যমুনা খানিকটা নীল। দুটো রং একেবারে স্পষ্ট বোঝা যায়। হাল্কা সবুজ রঙের সবস্বতী এখানে অন্তঃসলিলা।
গঙ্গা-যমুনা আর লুপ্ত সরস্বতীর ধর্মীয় সাংস্কৃতিক গুরুত্বের পাশাপাশি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্যও এই জায়গাটি পরিচিত। লক্ষ লক্ষ ভক্তের বিশ্বাস, প্রার্থনা আর ভক্তিই প্রয়াগরাজের বৈশিষ্ট্য। এই বিরল ত্রিবেণী সঙ্গম সারা বিশ্বে বিখ্যাত।
প্রতি বারো বছর অন্তর এখানে কুম্ভ মেলা হয়। সেটা হল পূর্ণ কুম্ভ। আর ছ’বছর অন্তর হয় অর্ধ কুম্ভ হয়।
পৌরাণিক মতে, সমুদ্র মন্থনের সময় যে অমৃতপূর্ণ কলস উঠেছিল, তা নিয়ে যাওয়ার সময় কিছুটা ছলকে পড়ে। প্রয়াগ, হরিদ্বার, উজ্জয়িনী আর নাসিক এই চারটি জায়গায় অমৃত পড়েছিল। তাই এই জায়গায় কুম্ভমেলা হয়।
ঋগ্বেদে সরস্বতী নদীকে অন্নবতী অর্থাৎ পুষ্টির উৎস, হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। এছাড়াও মোগল আমলে সম্রাট আকবর ত্রিবেণী সঙ্গমের কাছে এলাহাবাদ দুর্গ নির্মাণ করেন। যা মোগল সাম্রাজ্যের প্রশাসনিক কেন্দ্র হিসেবে কাজ করেছিল।
সঙ্গমে পৌঁছে মাঝি এবং পান্ডা বললেন— ডুবকি লাগাও। অর্থাৎ ডুব দাও। বহু মানুষ সঙ্গমে ডুব দিয়ে স্নান করছে।
দেখলাম ব্যবস্থাপনা এইরকম যে, দুটো নৌকার মাঝখানে একটা কাঠের পাটাতন দড়ি দিয়ে বেঁধে খানিকটা প্ল্যাটফর্মের মতো করা। ওই পাটাতনে দাঁড়িয়েই হাতে ঘটিতে রাখা দুধ এবং সিঁদুর ছোঁয়ানো নারকেল দিয়ে পান্ডা মন্ত্র বলছেন। এরপর মনের বাসনা জানিয়ে সেটা গঙ্গায় ছুড়ে তারপর ডুব দিতে হবে। স্বামী-স্ত্রী হলে দু’জনে হাত ধরাধরি করে ডুব দেওয়ার নিয়ম। এতে নাকি এ জন্মের তো বটেই, গত জন্মের পাপও ধুয়ে যাবে!
বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহু দূর। দেখলাম বহু মানুষ স্নান সারছেন পুণ্যলাভের আশায় অথবা ‘যস্মিন দেশে যদাচার’ মেনে নিয়ে।
কেউ বা কৌতূহলে কিংবা রোমাঞ্চ থেকে জলে পয়সা ও নারকেল ছুড়ছে। যাই হোক সঙ্গমে দাঁড়িয়ে পুরোহিতের মন্ত্রোচ্চারণ কানে নিয়ে হাবুডুবু খাওয়ার এমন অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতা উপভোগ করে বেশ আনন্দই হল মনে। নৌকার উপরে দু’পাশের লম্বা লম্বা কাপড় দিয়ে পর্দা ঘেরা। মহিলাদের জামাকাপড় পরিবর্তন করার ব্যবস্থা।
শীতকালে সাইবেরিয়া থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে পরিযায়ী পাখি আসে। পাখিদের খাবারও কিনতে পাওয়া যায়। নৌকায় বসে পাখিদের জন্য খাবার ছুড়ে দিলে অসংখ্য পাখি উড়ে আসে। সে এক অনবদ্য অভিজ্ঞতাই শুধু নয়, মনোরম দৃশ্যপটও।
পরিযায়ী পাখি ও পরিযায়ী মানুষের ভিড়ের মাঝে ফিরে চলল আমাদের নৌকা। সঙ্গমের খুব কাছেই রয়েছে এলাহাবাদ ফোর্ট। মোগল সম্রাট আকবরের তৈরি। এর ভিতরে ক্যামেরার প্রবেশ নিষেধ। এখানে রয়েছে অক্ষয় বট আর পাতালপুরী মন্দির।
আকবর ফোর্ট দর্শন করে বেরিয়ে পথে পড়ল বড়ে হনুমানজির মন্দির। মাটি থেকে ছ’-সাত ফুট নীচে হনুমানজির শায়িত মূর্তি রয়েছে। যার একদিক নদীর জলে নিমজ্জিত। খুব ভিড় হয় এই মন্দির দর্শনে।
এলাহাবাদে আরও দর্শনীয় কিছু স্থান হল আনন্দ ভবন মিউজিয়াম। পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুর জীবনস্মৃতির সংগ্রহশালা। এছাড়াও রয়েছে মহাত্মা গান্ধীর ব্যবহৃত চেয়ার, কংগ্রেস অধিবেশনের কক্ষ।
টিকিটের ব্যবস্থা রয়েছে। একতলা দোতলা দেখলে মোট ৭০ টাকা টিকিট।
বিস্তীর্ণ সবুজে সবুজে ঢাকা পার্ক খসরু বাগ স্টেশনের খুব কাছেই, তাও ঘুরে দেখতে পারেন। এইখানে জাহাঙ্গিরের স্ত্রী পুত্র ও বোনের সমাধি রয়েছে। এছাড়া রয়েছে চন্দ্রশেখর আজাদ পার্ক। ১৩৩ বিঘা জমির উপর তৈরি এই পার্ক। ১৯৩৩ সালে বিপ্লবী চন্দ্রশেখর ব্রিটিশের গুলিতে নিহত হন। তাঁর স্মৃতিতেই নির্মিত এই পার্ক।
এটি বিশ্বের এক প্রাচীন জনপদ। হিন্দু ধর্মগ্রন্থ ‘বেদ’-এ এর উল্লেখ রয়েছে ‘প্রয়াগ’ বলে। সেই সুপ্রাচীন শহরের ইতিহাসকে ছুঁয়ে দেখা একই সঙ্গে যেমন উপভোগ্য তেমনই রোমাঞ্চকর।
কীভাবে যাবেন: হাওড়া শিয়ালদহ ও কলকাতা স্টেশন থেকে বিভিন্ন সময়ে এলাহাবাদ বা প্রয়াগরাজ যাওয়ার বহু ট্রেন ছাড়ে। পৌঁছানো যায় বিমান পথেও।
কোথায় থাকবেন: সরকারি ও বেসরকারি দু’রকমের থাকার জায়গা রয়েছে।