সম্প্রতি আইসিসিআর অডিটোরিয়ামে একদিনের নাট্যোৎসবে প্রজ্ঞা মঞ্চস্থ করল দুটি নাটক, ‘নাইন মাইলস টু গো’ এবং ‘পতি গয়ে রে কাটিয়াহার’। দুটি নাটকে দুটি ভিন্ন ধরনের বার্তা দেওয়া হয়েছে, যেগুলি সর্বকালের ও সময়ের জন্য খুবই অর্থবহ ও প্রাসঙ্গিক। পশ্চিমবঙ্গ নাট্য অ্যাকাডেমির সহযোগিতায় আয়োজিত এই নাট্যোৎসবের প্রথমটির পরিচালক জয়শ্রী ভট্টাচার্য। স্বাধীনতা সংগ্রামী বাঘাযতীনের নাতি পৃথীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের গবেষণা অবলম্বনে তৈরি হয়েছে নাটকটি। একজন সাধারণ ঘরের ছেলে ব্রিটিশ সরকারের অধীনে কাজ করেও দেশের সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করে কীভাবে স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখেন তার বর্ণনা দেখা যায় এখানে। কুষ্টিয়ায় বেড়ে ওঠা যতীন ছোটবেলাতেই তাঁর বাবাকে হারায়। মা শরৎশশিদেবী ও দিদি বিনোদাবালার সাহচর্যে মামার বাড়িতে বড় হয়ে ওঠেন। খুব অল্প বয়সেই বিয়ে হয় ইন্দুবালার সঙ্গে। কিন্তু দেশ স্বাধীনের স্বপ্নে বিভোর যতীন স্ত্রীকে প্রথমদিনেই জানিয়ে দেন তাঁর কর্তব্যের কথা। স্ত্রীও মেনে নেন তাঁর এই সংকল্পের ইচ্ছাকে। এরপর যতীন কলকাতায় থেকে শুরু করেন তাঁর রাজনৈতিক কার্যকলাপ। কর্মসূত্রে তাঁকে বিভিন্ন জেলায় যাতায়াত করতে হতো সেইসময়। তখনই তিনি বিভিন্ন জায়গায় তাঁর রাজনৈতিক সংগঠন তৈরির কাজ শুরু করেন। সেখান থেকে তিনি ওড়িশার বারিপদা অঞ্চলে গোপালগিহিতে যান। মণীন্দ্র চক্রবর্তীর সাহায্যে গা ঢাকা দেওয়ার জন্য একটা কুটির তৈরি করে রামানন্দ স্বামী নাম নিয়ে থাকতে শুরু করেন। তিনি বেশ বড় পরিচিত হয়ে ওঠেন সেখানে। ব্রিটিশ পুলিসের নজরে আসেন। তাঁর নামে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়। যতীন তাঁর এক সঙ্গীকে নিয়ে গোপালডিহিতে থাকলেও ৯ কিমি দূরে গভীর জঙ্গলে অপর দুইজনকে তালডিহি পাঠিয়ে দেন। সকলে অপেক্ষা করতে থাকেন বিদেশ থেকে যুদ্ধ চালানোর অস্ত্রশস্ত্র আসার। কিন্তু দিন অতিক্রান্ত হয়ে গেলেও কোনও অস্ত্রই আসে না। খবর আসে ব্রিটিশরা জাহাজসমেত সবকিছু আটক করে নিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে তাঁর সঙ্গীরা সকলেই যতীনকে বলে দাদা তুমি এগিয়ে যাও, না হলে খুব বিপদ হবে। তোমার কিছু হলে আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার কেউ থাকবে না। আগামী দিনে দেশকে পরাধীনতার কবল থেকে মুক্ত করার জন্য তোমার মতো নেতার প্রয়োজন। কিন্তু যতীন সে কথায় কর্ণপাত করেন না। তিনি বলেন, তোমরা আমার ডাকে ঘর ছেড়ে চলে এসেছ আমি তোমাদের স্বাধীন ভারতের স্বপ্ন দেখিয়েছি। আজ আমি চলে যেতে পারি না। এটা কোনও নেতার কাজ নয়। যে কোনও মুহূর্তে পুলিস তাঁদের আক্রমণ করতে পারে ভেবে ওই জায়গাটা ছেড়ে চলে আসার সিদ্ধান্ত নেন যতীন। ৯ মাইল পথ হেঁটে ক্লান্ত তাঁর সঙ্গীরা। পথে গ্রামবাসীরা তাঁকে দেখে ডাকাত বলেও তাড়া করেন। এইভাবেই তাঁরা পৌঁছে যান তাঁদের গন্তব্যে। সেখানে ব্রিটিশ সৈন্যরা আক্রমণ করে। দু’দলের মধ্যে গুলি বিনিয়ম হয়। আহত হন যতীন। কিন্তু দমে যাওয়ার পাত্র নন তিনি। যখন তাঁর দল ব্রিটিশ সৈন্যদের দ্বারা প্রতিহত হয় এবং যতীনের স্ট্র্যাটেজি ভ্রান্ত প্রমাণিত হয় তখন তিনি প্রশ্ন করেন ভারতীয় দর্শনে সত্যিকারের নেতা কাকে বলে?
অজিত চৌধুরীর নির্দেশনায় দ্বিতীয় প্রযোজনা ‘পতি গয়ি রে কাটিয়াহার’ একটি কমেডি নাটক। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের বুনিয়াদ বিশ্বাস। এই বিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করেই দাঁড়িয়ে থাকে সম্পর্ক। কিন্তু কোনও কিছু হলেই সমাজ সংসার স্ত্রীকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দেয়। তাঁকে বিশ্বাস করাতে পরীক্ষা দিতে হয়। যদি সে কোনও ভুল করে তাহলে তাকে চরিত্রহীনের তকমা এঁটে দেওয়া হয়। অথচ প্রতিজ্ঞাবদ্ধ থাকাকালীন যদি সেই একই ভুল পুরুষমানুষ করে তবে সেও ছাড় পেয়ে যায়।
নাটকে মহারাষ্ট্রের একটি গ্রামের ছবি তুলে ধরা হয়। পুনের সুবেদার সুন্দরী, মিষ্টি, ত্যাগী স্ত্রী জানকিকে রেখে সারা বছরের কর আদায় করতে গ্রামে যান। স্বামী ছাড়া দীর্ঘ এই সময় কাজে ব্যস্ত থাকতে পারলে সময়টা কেটে যাবে ভেবে জানকি তাকে কাজ দিয়ে যাওয়ার জন্য বলে। যাতে দিনগুলি কাটাতে তাঁর কোনও কষ্ট না হয়। সুবেদার মজার ছলে তাকে বলেন, ঠিক আছে তুমি পকেট থেকে কোনও অর্থ খরচ না করে একটা কাচের মহল তৈরি করতে পারবে? মজা করে বললেও তাঁর স্ত্রী জানকি এটাকে সত্যি ভেবে রাজি হয়ে যায়। এছাড়া আরও একটি শর্ত দেয় যে, আমি একটা উত্তরাধিকার চাই, যার জন্ম হবে আমার অনুপস্থিতিতেই। এটাতেও জানকি সম্মত হয়। এরপর সে চলে যায়। তবে জানকির কাছ থেকে বিদায় নেওয়ার সময় সে তার স্বামীর পাগড়িতে একটা ফুলের মালা আটকে দিয়ে বলে, যতদিন এই ফুলের মালা তাজা থাকবে তুমি জানবে তোমার স্ত্রীর কোনও ক্ষতি হয়নি। আমি যে পতিব্রতা স্ত্রী তাঁর প্রমাণ হবে সেটাই। শর্তদুটি বাস্তবে রূপায়ণ করতে জানকি ও তার সখী দু’জনে মিলে একটা মজার খেলায় মেতে ওঠে। শেষ পর্যন্ত নানা কৌশলে জানকি জিতে যায়।
প্রথম নাটকটিতে যতীনের চরিত্রে সুমন সাহাকে দারুণ মানিয়েছে। তাঁর সহজ, সাবলীল প্রাণবন্ত অভিনয়ে সকলের হৃদয় স্পর্শ করে। অন্যান্যদের মধ্যে সম্রাট রায় (চিত্তপ্রিয়), অর্ঘ রায় (যতীশ), সৌম ভট্টাচার্য (নীরেন), অর্করঞ্জন ভট্টাচার্য (মনোরঞ্জন) যতীনের চরিত্রটিকে সুন্দর করে তুলতে যোগ্য সহযোগিতা করেছেন।
দ্বিতীয় নাটকটি হিন্দিতে উপস্থাপিত হলেও বুঝতে অসুবিধা হয় না। গানগুলি অত্যন্ত মনোগ্রাহী গল্পোপযোগী। অভিনয়ে জানকির ভূমিকায় শুচিতা মাহিন্দু, সুবেদারের চরিত্রে অজিত চৌধুরি, শাহির চরিত্রে দীপক রানা এককথায় অনবদ্য। অন্যান্যদের মধ্যে নূপুর শ্যকর, রাজিন্দর শর্মা, ধীরেন্দ্র গুপ্তাও চরিত্রচিত্রণে ও অভিব্যক্তিতে এতটাই স্বতঃস্ফূর্ত যে, দর্শকরা সহজেই নাটকের গভীরে ঢুকে পড়ে সময়ের কথা ভুলেই যান। জমজমাট দুটি নাটকই খুব উপভোগ্য।
কলি ঘোষ