কর্মক্ষেত্রে অতিরিক্ত পরিশ্রমে শারীরিক ও মানসিক কষ্ট। দূর ভ্রমণের সুযোগ। অর্থ প্রাপ্তির যোগ। যে কোনও ... বিশদ
কিন্তু তাতেই বা কী! পুজো শুরু হয়ে গেল এবং আসমুদ্র হিমাচল বাংলায় বাঙালির সংবৎসরের মহানন্দের উৎসবের ঢাক বাজতে শুরু করে দিয়েছে। এখন আগামী পাঁচ দিন শোক দুঃখ অভাব অভিযোগ রাজনীতির লড়াই ঝামেলার ঘরে তালা মেরে আপামর বাঙালি নেমে পড়বে পথে। উৎসবের ভিড় স্রোতের আশ্চর্য আলোড়নে উদ্বেল হবে নগর মহানগর গ্রাম মফস্সল, বড়লোকের প্রাসাদ থেকে গরিবের পর্ণকুটির। মধ্যবিত্তের প্রায় বৈচিত্র্যহীন নিত্যযাত্রাতেও লাগবে অভিনবত্বের টান, মল থেকে মণ্ডপে তাঁদের সেই অভিনবত্ব কোথাও প্রতিমা ছাপিয়ে চোখ টানলেও আশ্চর্যের কিছু নেই! বাংলার পুজো মানেই তো চকঝমকের পাল্লাদারি, ‘আধুনিকতা’র নতুন নতুন দিগন্তের উন্মোচন, আর কে কত ‘প্রগতিশীল’ সাজ পোশাকে খাওয়াদাওয়ায় আদবকায়দায় আর খোলামেলা মেলামেশায় তার কম্পিটিশন! তাই নয় কি? তাই। পুজোর লড়াইয়ের চেয়ে আজকের বাঙালিজনের (!) সেইসব লড়াই তো কম আকর্ষণীয় নয়। এবং বলতে কী কখনও কখনও বঙ্গজীবনের সেই অদৃষ্টপূর্ব অনির্বচনীয় দৃশ্যরূপ আমাদের মতো অকিঞ্চিৎকর সাধারণের নয়ন প্রকৃত অর্থেই ভুলিয়ে ছাড়ে! দেখার আবেশ কাটতেই মন বলে ওঠে অহো! আমি কী হেরিলাম নয়ন মেলে!
আজ বলে নয়, বিগত বেশ কয়েকবছরের পুজো অভিজ্ঞতা তাই বলে। বলে না কি? আমি এর ভালোমন্দের ব্যাখ্যায় যাচ্ছি না। ওটা সমাজতাত্ত্বিক পণ্ডিতজনের বিবেচ্য। কিন্তু অস্বীকার করার উপায় নেই যে বাঙালির এই সর্বাত্মক কম্পিটিশন প্রবণতা পুজোরসিকের চিত্তে আনন্দের বাড়তি ভোজ জোটায়, চিরকালের পুজোর পরিসরের চাঁদোয়ার চারদিকে একটা যেমন খুশি সাজো ‘কার্নিভালে’র বর্ণচ্ছটা যোগ করে। পথেঘাটে রেস্তোরাঁয় মলে আর মণ্ডপে মণ্ডপে তো অবশ্যই—এই বিচিত্র বাঙালি মনোরঞ্জনের এক নয়া রেসিপি। এবার তাতে অভিনবত্বের নতুন কোন মাত্রা যুক্ত হয় তা দেখার জন্য এখন আমাদের মতো অসংখ্য কৌতূহলী আর পাঁচটা বছরের মতো এবারও মনে মনে অধীর। আমার এক রসিক বন্ধুর কথায়, জুড়াইতে চাই কোথায় জুড়াই বলে প্রতিদিনের বুকচাপা কান্না দমফাটা হাসিতে ভরিয়ে দিতে এমন দাওয়াই মহামায়ার চেম্বারেও মেলে না! লক্ষ্মী গণেশ কার্তিক সরস্বতী মায় মা দুর্গাও এই নয়া বাঙালির কাছে সাজপোশাকেই বল কি হাবেভাবে খানাপিনায় একদম ডাহা ফেল! শিব ঠাকুর খানিকটা হয়তো পাল্লা দিতে পারতেন কিন্তু তিনি তো ত্রিগুণাতীত হয়ে ঘুমিয়ে ঝিমিয়েই দিন কটা কাটিয়ে দেন! তাই বলছি, মানো ইয়া না মানো—মৃত্যুঞ্জয়ী বাঙালির মতো এই চির-রঞ্জিত বাঙালিও আমাদের গর্ব আমাদের ঐশ্বর্য! প্যান্ডেল প্রতিমা আলোর কারুকাজের অসাধারণত্ব কোথায় কেমন তা দেখতে মানুষ যখন উত্তর থেকে পশ্চিম দক্ষিণ থেকে পুব রাত দিন ভুলে আড়ে বেড়ে তোলপাড় করে তখন তাঁদের পরিশ্রান্ত ঘর্মাক্ত ক্ষুধাকাতর শরীরে-মনে নতুন জোশ জাগিয়ে দিতে অব্যর্থ এই নয়া বাঙালি দাওয়াই। কথা শেষ করেই বন্ধুটি চোখ মটকে হাসলেন। তাৎপর্য ব্যাখ্যা বাহুল্য।
পুজোর দিনে এমন মজা স্বাভাবিক। কিন্তু, এবার সব কিছুর পরও কোথায় যেন একটা কিন্তুর কাঁটা ফুটছে, ফুটেই চলেছে! ফলে, জমজমাট পুজোর মজার আবহটা যেন এখনও ঠিক জমাট বাঁধতেই পারছে না। কী সেই কাঁটা? এনআরসি? বাজারদর? কাজ হারানো? মাসের পর মাস বেতনবিহীনতা, অভাব? দেশ জুড়ে হাজার হাজার লাখ লাখের কাজ হারানোর আতঙ্ক? —তালিকা শেষ হবার নয়। ক’দিন আগে বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ রাজ্যের পুজো উদ্বোধনে এসে ফের একবার এনআরসি লাগু করার সন্দেশ দিয়ে গেলেন। উদ্বাস্তু নয় অনুপ্রবেশকারীদের বিরুদ্ধেই যে খড়্গহস্ত হবে এনআরসি সেটা অমিতজিরা বোঝানোর পরও বঙ্গজনের আতঙ্ক যে কাটছে না!
রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও প্রথম থেকে বলে আসছেন, কোনও অবস্থাতেই বাংলায় এনআরসি হতে দেবেন না তিনি। বলছেন, পশ্চিমবঙ্গে বসবাসকারী প্রতিটি মানুষের নাগরিক অধিকার সুরক্ষিত থাকবে। কারও ক্ষেত্রে কোনও নড়চড় হবে না। তা সত্ত্বেও আতঙ্কের একটা বাতাবরণ যেন ছেয়ে আছে উত্তর দক্ষিণ উভয় বঙ্গেই! এনআরসি আতঙ্কে একের পর এক আত্মহত্যার ঘটনা ঘটছে, দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে সে তালিকা—এমন অভিযোগে ভারী হচ্ছে পুজোর বাতাস। আর এনআরসি চিন্তায় যাঁদের ঘর ইতিমধ্যেই শূন্য হয়েছে, স্বজন হারিয়েছেন প্রিয়জন, পুজোর আনন্দ তাঁদের প্রাণ কতটা ছুঁয়ে যাবে তা নিয়ে সংশয় থাকে বইকি! আর বউবাজার কাণ্ডে ঘর হারানো হোটেলবাসী পরিবারগুলি? তাঁরাও কি পারবেন মন প্রাণ এক করে আগামী কটা দিন পুজোর স্রোতে গা ভাসাতে? মহামায়ার জাদুতে অনেক মনই বাড়তি বল পেয়ে অনেক কঠিন দুঃখ দূরে ঠেলে এই আনন্দে শামিল হন। কিন্তু! ওই একটা কিন্তুর কাঁটা এখানেও রয়ে যায়—সবাই পারেন না, পারেন না সঙ্গত কারণেই। এদিকে বছর ঘুরলেই কলকাতা পুরভোট। আর তারপরই রাজ্য বিধানসভা দখলের লড়াইয়ের সাজগোজ শুরু। ফলে চলতি বছরটাতে পশ্চিমবঙ্গে কিছু বেশি রাজনৈতিক সক্রিয়তা অস্বাভাবিক নয়। বিশেষ করে লোকসভা ভোটে বিজেপির সাম্প্রতিক উত্থানের পর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রায় বিরোধীবিহীন এই একাধিপত্যের রাজ্যে যে বিরোধীর আবির্ভাব ঘটেছে তাতে সন্দেহ নেই। সাংগঠনিক কিছু দুর্বলতা ও মমতার দলের সঙ্গে সমানে সমানে যুঝতে পারার মতো নেতাকর্মীর অভাব সত্ত্বেও পদ্ম-সেনাপতি দিলীপ ঘোষ ও তাঁর সঙ্গীসাথীরা এর মধ্যেই দফায় দফায় যথেষ্ট উত্তেজনার আমদানি ঘটিয়েছেন বঙ্গ রাজনীতিতে। বোঝাই যাচ্ছে, লক্ষ্য তাঁদের ২০২১। গেরুয়া শিবিরের এই জঙ্গি মনোভাবে এখনও তেমন ভাবিত না হলেই প্রশান্ত কিশোরের দাওয়াই নিয়ে তৃণমূল নেত্রী মমতাও রাজনৈতিক শত্রুদমনে প্রয়োজনীয় কর্মসূচি রূপায়ণে তৎপর হয়েছেন। রাজীব কুমারের জামিন তাতে হয়তো স্বস্তির অতিরিক্ত ইন্ধন দিয়েছে। কিন্তু সব মিলিয়ে এনআরসির মতো রাজনীতির এই টানাপোড়েনও যেন কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে পুজোর বাসরে! পুজো উদ্বোধনে এসে অমিত শাহের বক্তব্যে রাজনীতি উঠে আসায় কাঁটার তীক্ষ্ণতা বেড়েছে নিঃসন্দেহে! যাদবপুর কাণ্ডে রাজ্যপালের ভূমিকা ও পুজো উদ্বোধনে তাঁর বক্তব্য নিয়েও বিতর্ক! সাধারণজনের মহলেও তার ছায়া পড়েছে! এবং এসব কিছু ছাপিয়ে বাজারের আগুনে চেহারা তো আছেই! বন্ধুর কথায়—বাজার তো না যেন হাড়িকাঠ! রোজ বলি হতে হচ্ছে! অথচ, যে সরকার পশু বলি বন্ধে সক্রিয় সে সরকার কেন বাজারে বলি ঠেকাতে নামে না! আসলে সরকারও জানে, আমরা গরিব মধ্যবিত্ত সব অমর। শতবার বলি দিলেও আমরা ফিরে ফিরে বলিকাঠের কাছে যেতে ডরাব না! সেদিক থেকে দেখলে আমরা কেবল পুজোর আনন্দ উপভোক্তাই নই একটা আবশ্যিক উপকরণও বটে—কী বলেন? আর এই নিত্যযন্ত্রণার কথা মাথায় রাখলে বলতেই হয়, মা, আমরা তো ভুলেই আছি। তাহলে আর কেন নতুন করে নয়ন ভোলাতে আসো?
বন্ধুর এই সকৌতুক প্রশ্নের কোনও সোজাসাপটা উত্তর যে হয় না সেটা সকলেই বোঝেন। কারণ, আমরা সকলেই মানি মা দুর্গা প্রতি বছর এসে এই সময়টায় আমাদের যন্ত্রণা অভাব সব ভুলিয়ে দেন বলেই আমরা বছরভর লড়াই করার রসদ পাই। অনাদরে অবহেলায় আর উচ্চকিত উৎকেন্দ্রিকতায় বাঙালির গিয়েছে তা অনেক কিছুই, সভ্যতায় সংস্কৃতিতে ভাষায় ভাবে আকারে প্রকারে। তবু এখনও তো আছে কিছু—অমূল্য মহৎ মহানন্দময়। দিনের বাজারে আগুনে ঝলসানো কি দরের বলির যন্ত্রণার চেয়ে শত সহস্র নিযুত কোটিগুণ সে আনন্দে বছরে একবার স্নান ছাড়া বাঙালির অবশিষ্টটুকু বাঁচবে কীভাবে! অতএব মহামায়ার বোধনের প্রাক্লগ্নে স্বাগত মহাপঞ্চমীর আনন্দস্নান।