উত্তম বিদ্যালাভের যোগ আছে। কাজকর্মে উন্নতি ও কাজে আনন্দলাভ। অর্থাগমের উত্তম যোগ। ... বিশদ
অন্যদিনের মতো সেদিনও পুটুদি আমাদের গান শেখাচ্ছিল। আমরা কয়েকজন কিশোর-কিশোরী গান শিখতাম পুটুদির কাছে। দিদির হারমোনিয়ামের সুরের ওঠানামায় আমরা সমবেত স্বরে গাইছিলাম, ‘তুমি কেমন করে গান কর হে গুণী।’ হঠাৎ বাইরে বোমাবাজির শব্দ। অগ্নিগর্ভ সেই সত্তরের নকশাল আমলে উত্তর কলকাতার রাস্তায় যখন তখন শুরু হতো বোমাবাজি। সেদিনও একটা-দুটো বোমা পড়তে শুরু করেছে। আমরা গান থামিয়ে দিয়েছি। পুটুদি উঠে রাস্তার দিকের জানালা বন্ধ করতে গেল। তখনই রাস্তা থেকে ভেসে এল অন্য এক গানের কলি। ‘আমার এ ধূপ না পোড়ালে গন্ধ কিছুই নাহি ঢালে।’ আমরা জানি, আব্বাস দাদা গান গাইতে গাইতে চলেছে। সেই সমাজবদলের ভ্রান্ত স্বপ্নের সওয়ারি কয়েকজন যুবকের উদভ্রান্ত চারণের মধ্যেও আব্বাস দাদার অকম্পিত কণ্ঠ। ‘আমার এ দীপ না জ্বালালে দেয় না কিছুই আলো।’ দাদার এক হাতে কয়েকটা ধূপের প্যাকেট। অন্য হাতে ব্লাইন্ড স্টিক। কাঁধে একটা কাপড়ের ব্যাগ। তাতে রয়েছে কয়েকটি ধূপের প্যাকেট। আর একটা টিফিন বাক্স। তাতে আছে দুটো রুটি আর আলু বা বেগুন ভাজা। শহরের বিভিন্ন পাড়ায় ঘুরে ঘুরে আব্বাসদা গান গেয়ে ধূপ বেচে। সবাই তাকে চেনে। সেদিন আব্বাসদা যখন আমাদের পাড়ায় এল, তখনই শুরু হয় বোমাবাজি।
পুটুদি তাড়াতাড়ি বাড়ির বাইরে গিয়ে আব্বাসদাকে টেনে নিয়ে ঘরে এল। বলল, ‘দেখছ বোমাবাজি শুরু হয়েছে, তার মধ্যে তুমি হেঁটে চলেছ। যদি বিপদ ঘটে?’
আব্বাসদা মিটিমিটি হাসে। পুটুদি তাকে ঘরে বসিয়ে বলে, ‘আব্বাস তুমি তো বেশ ভালো গান গাও। কী করে শিখলে?’
‘মায়ের কাছে শিখেছি দিদিমণি। আপনি শুনবেন?’
‘কই গাও দেখি।’ ওই গানটাই আবার গায় আব্বাস দাদা। গানের ভেতর যেন একটা ধূপের নরম গন্ধ টের পাওয়া যায়। পুটুদি বলে, ‘আর একটা গাও না আব্বাস।’
আব্বাস বলে, ‘আর তো গান জানি না দিদিমণি। একটাই শিখেছি। আচ্ছা দিদিমণি আমাকে আপনি গান শেখাবেন? অনেক গান। ওই রবি ঠাকুরের গান। ওই গান শুনলেই আমার কেমন কান্না পায়।’
তারপর থেকে আব্বাসদা আসত পুটুদির কাছে। বেশ কয়েকটা গান সে শিখে নিল। ‘আমি পথভোলা এক পথিক এসেছি’, ‘পুরানো সেই দিনের কথা’, ‘তবু মনে রেখো।’ পুটুদিকে আগে আব্বাসদা ধূপ বিক্রি করত। এখন ধূপের প্যাকেট দেয়, কিন্তু পয়সা নেয় না। বলে, ‘ওটা আমার গুরুদক্ষিণা দিদিমণি।’
প্রতিবছর পুটুদির বাড়িতে ভাইফোঁটার আয়োজন হতো। আমাদের ফোঁটা দিত পুটুদি। যেসব মেয়ে গান শিখত, তারাও ফোঁটা দিত। সেবার আব্বাসদাকেও আসতে বলেছিল দিদি। আব্বাসদা এসেছিল ধুতি আর পাঞ্জাবি পরে। পুটুদি তাকে আসন পেতে বসতে দিল। আমরাও সবাই সারি দিয়ে বসলাম। সবার সামনে মিষ্টির প্লেট। সবার কপালে ফোঁটা দিল পুটুদি। আব্বাসদার কপালেও ফোঁটা দিয়ে পুটুদি বলল, ‘ভাইয়ের কপালে দিলাম ফোঁটা যম দুয়ারে পড়ল কাঁটা।’ মাথায় ধান-দুর্বা দিয়ে আশীর্বাদ করল। প্রদীপের ভাপ আঁচলে নিয়ে আব্বাস দাদার বুকে, পিঠে, মাথায় বুলিয়ে দিল। সেই প্রদীপের পবিত্র ভাপ দিল আব্বাসদার অন্ধ দুই চোখেও।
দাদার চোখ দিয়ে গড়িয়ে টপটপ করে জল পড়তে লাগল। পুটুদি আঁচল দিয়ে মুছিয়ে দিয়ে বলল, ‘কাঁদছ কেন আব্বাস?’ আব্বাসদা বলে, ‘যে চোখে দেখতে পাইনে, সেই চোখে এত জল কোত্থেকে আসে দিদিমণি!’
‘সব ঠিক হয়ে যাবে ভাই। কেঁদো না। এখন মিষ্টি খাও। আর দুপুরে এখানেই খাওয়াদাওয়া করবে।’ পুটুদি তার ভাইদের নানা ধরনের গিফট দিল। পেন্সিল, রবার, রং পেন্সিল ইত্যাদি। আব্বাসদাকে দিল একটা ব্যাগ আর টিফিন কৌটো। বলল, আব্বাস এবার থেকে এই ব্যাগটা নিয়ে বেরবে।
আব্বাস দাদা তার কাঁধের কাপড়ের ব্যাগটা থেকে একটা টিফিন কৌটো সঙ্কোচের সঙ্গে বের করে দিদির দিকে বাড়িয়ে বলল, ‘দিদি তুমি এটা নেবে?’
পুটুদি বলে, ‘কী আছে আব্বাস এতে?’
আব্বাস বলে, ‘কয়েকটা নাড়ু আছে। মা বানিয়েছে। বলেছে তোমাকে দিতে। তোমার মতো ভগবানকে নিবেদন করে আমার মন ভরে যাচ্ছে গো দিদিমণি।’
আবার চোখ দিয়ে জল পড়ে আব্বাস দাদার। পুটুদির চোখও ভিজে যায়। কোনওরকমে আমাদের আড়াল করে কাপড়ের খুঁট দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে উঠে যায় দিদি। রান্নাঘরের দিকে হাঁক পেড়ে বলে, ‘মালতি মাংসটা কষা হয়েছে?’
খাওয়ার পর বসল গানের আসর। সবাই একটা একটা করে গান গাইল। আব্বাসদা গাইল পুটুদির কাছে নতুন শেখা একটা গান, ‘ক্লান্তি আমার ক্ষমা করো প্রভু।’ গানের শেষে দাদা বলল, ‘জানো দিদিমণি, মা আমাকে পূর্ণিমার রাতে ঘরের দাওয়ায় বসিয়ে দেয়। আমি জোছনার মধ্যে চন্দনের গন্ধ পাই। তখন বসে বসে তোমার শেখানো গান গাই। মনে খুব আনন্দ হয়। মনে হয় আমাদের আল্লা আর তোমাদের ঠাকুর আমাকে আশীর্বাদ করছেন। কী শান্তি যে লাগে! তখন তোমার কথা মনে হয়। মনে হয় তুমি সরস্বতী ঠাকুরের মতো।’
পুটুদি আব্বাসের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে, ‘ধুর পাগল, আমি ঠাকুর হতে যাব কেন? আমি তো তোর দিদি। শোন আব্বাস, যেখানেই থাকিস, প্রতি বছর আমার কাছে ভাইফোঁটার দিন এসে ফোঁটা নিয়ে যাবি কিন্তু।’
‘আচ্ছা। কিন্তু তুমি শ্বশুরবাড়ি গেলে কী হবে?’
‘আমি প্রতি বছর ভাইফোঁটার দিনে তোদের সবাইকে ফোঁটা দিতে এ বাড়িতেই আসব। যতদিন আছি, প্রত্যেক মাসে আমার কাছে একটা করে গান তুলবি।’
সেই ভাইফোঁটা আমি কোনওদিন ভুলব না। তার কারণ সেটাই ছিল পুটুদির বাড়িতে শেষ ভাইফোঁটা। ওই দিনের পর আব্বাস বেশ কয়েকদিন আর আসেনি। শেষে একদিন পুটুদি দুধের ডিপোতে দুধ আনতে গিয়ে শুনতে পায়, আব্বাসদা হেদুয়ার কাছে রাস্তা পেরনোর সময় একটা গাড়ির ধাক্কায় জখম হয়। পরে হাসপাতালে তার মৃত্যু হয়। সেদিন পুটুদি ঘর বন্ধ করে তার আব্বাস ভাইয়ের জন্য খুব কেঁদেছিল। মাঝেমাঝেই দিদি একটা গান গাইত, ‘এই করেছ ভালো নিঠুর হে।’ তারপর থেকে পুটুদি আর কাউকে কোনওদিন ভাইফোঁটা দেয়নি।