‘শঙ্খ বাজা তোরা উলুধ্বনি দে, অধিবাসে সখীর মুখে ফুটলো হাসি যে’— বিয়ে নিয়ে সমস্ত ছেলেমেয়ের মনে একটা স্বপ্ন থাকে। আর সেই স্বপ্ন বাস্তব হয় বৈদিক মন্ত্র উচ্চারণে আর লৌকিক আচারের মাধ্যমে।
 গায়ে হলুদ: গায়ে হলুদ বিয়ের একটা প্রধান স্ত্রী আচার। এই গায়ে-হলুদ ব্যাপারটা সব ধর্মের বিয়ের মধ্যেই আছে। হলুদ মাখানো ব্যাপারটার মাধ্যমে দেহশুদ্ধি করা হয়। মনে করা হয় বিয়ের মাধ্যমে দুটো ভিন্ন গোত্রের ছেলেমেয়ের দৈহিক মিলন হয়। এরফলে অনায়াসে এক দেহের জীবাণু অন্য দেহে প্রবেশ করতে পারে। আর যাতে এমনটা না হয়, তার জন্য দেহশুদ্ধির প্রয়োজন এবং গায়ে হলুদ অনুষ্ঠান। হলুদকে আয়ুর্বেদিক মতে অ্যান্টিসেপ্টিক হিসেবে ভাবা হয়।
 জলসহা: এটি গ্রামবাংলার একটি অাঞ্চলিক স্ত্রী আচার। মনে করা হয় ছেলে বা মেয়ের বিয়েতে পাড়াপ্রতিবেশীদের শুভেচ্ছা সন্তোষ এবং অনুমোদন পাওয়ার জন্যই এই স্ত্রী আচারটি পালিত হয়। শুধু নিজেদের সমাজ নয়, আশেপাশে অবস্থিত সকল সম্প্রদায়ের বাড়ি থেকে শুভেচ্ছাপূর্ণ জল সংগ্রহ করাই জলসহা। এবং এই জল দিয়ে গায়ে হলুদের পর পুত্র বা কন্যাকে স্নান করানোর রীতি আজও চলে আসছে। আবার কোন কোন অঞ্চলে বিয়ের দিন দুপুরে এয়োস্ত্রীরা বর বা কনের কপালে হলুদ বাটা ছুঁইয়ে জলপাত্র নিয়ে কোন দেবতার মন্দিরে যান। মন্দিরে যাওয়ার আগে কোনও জলাশয় থেকে পাত্রটিতে জল ভরে নেন এবং সেই জল ঢালতে ঢালতে মন্দিরে যান। মন্দিরে গিয়ে সেখানকার একজন এয়োস্ত্রীকে আলতা সিঁদুর পড়িয়ে দেন অন্যান্য এয়োরা এবং তাকে পান-সুপারি দিয়ে আমন্ত্রণ জানান। সেই এয়ো তখন তাদের জলপাত্রে জল দেন। এরপর এয়োরা সেই জল পাত্র নিয়ে প্রতিবেশীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে তাদের কাছ থেকে জল নেন এবং এই জল দিয়ে বর, কনেকে স্নান করানো হয়।
 জলভরা: অনেক অঞ্চলে বর বা কনেকে স্নান করানোর জন্য কলসী নিয়ে এয়োরা মিলে কোনও পুকুর বা নদীতে যান। এবং বিভিন্ন ধরনের বাজনা বাজাতে বাজাতে যাওয়া হয়। সেখানে গিয়ে শঙ্খ-ধ্বনি আর উলুধ্বনি সহযোগে কলসী ভরা হয়। এরপর জলপূর্ণ কলসটিকে বাড়িতে এনে একটা আলপনা দেওয়া জায়গায় রাখা হয় এবং তাতে আমের পল্লব আর সিঁদুরের ফোটা লাগানো হয়। এই জল দিয়ে কন্যার বাড়িতে কন্যাকে এবং বরের বাড়িতে বরকে স্নান করানো হয়।
 চোরাপানি: বিয়ের দিন ভোরবেলা কনের বাড়িতে চোরাপানি নামে এই জল তোলার স্ত্রী আচারটি অনুষ্ঠিত হয়। এই আচারটি পালন করার জন্য ভোররাতে এয়োস্ত্রীরা কোনও পুকুর বা নদীতে জল তুলতে যায়। তারা জলে নেমে কোনও লোহর বস্তু দিয়ে জলে যোগ চিহ্ন কাটে। মনে করা হয় লোহার স্পর্শে জল শুদ্ধ হয় এবং অপদেবতা বিতারিত হয়। সেখান থেকে জল ভরে নেওয়া হয়। বাড়িতে ফিরে কলসীতে পাঁচটি ফল ও একছড়া মালা রেখে নতুন কাপড় দিয়ে কলসীর মুখ বেঁধে দেওয়া হয়। বিয়ের পর রাত্রিবেলায় স্ত্রী আচারের সময় বর ওই কলসীটির মুখ খোলে এবং এয়োস্ত্রীদের কথামত ওইসব ফল মালা একটা একটা করে তুলে ধরে। এগুলো তোলার সময় এয়োরা বরকে ‘এটা কি’ এ ধরনের প্রশ্ন করেন। বর যথার্থ উত্তর দিলেও সেটার অন্য মানে করে এয়োরা বরকে নিয়ে বিভিন্ন রঙ্গ-তামাসা করে থাকে।  সোহাজ জল: চোরাপানির সময়ই একটা মাটির হাঁড়িতেও জল ভরে আনেন এয়োস্ত্রীরা। ওই জলভর্তি মাটির হাড়ি বিয়ের পর কনের সামনে রাখতে হয়। এবং এয়োস্ত্রীদের সামনে কনে একটা ছোট পাত্রের সাহায্যে একবার হাঁড়ি থেকে জল তোলে এবং একবার ঢেলে দেয়। তাকে তখন এয়োরা ‘কি করছে’ জিজ্ঞাসা করলে কনে বলে শ্বশুর বাড়ির সোহাগ মাপছি। আর এটাকেই সোহাজ জল বলা হয়। মনে করা হয় এর মাধ্যমে কনের শ্বশুরবাড়ি সম্পর্কে ভীতি কাটে।
 দধি মঙ্গল: চোরাপানি নামক স্ত্রী আচারটি সম্পন্ন করে এসে কন্যার বাড়িতে কন্যার মাতা এবং বরের বাড়িতে বরের মাতা এয়োস্ত্রীদের সঙ্গে নিয়ে দই-চিঁড়ে একত্রে মেখে খাইয়ে দেন। এরপরে কন্যা বা বরকে আর কিছু ভারি খাবার খেতে দেওয়া হয়।
 বরবরণ: বরবরণ সম্পূর্ণরূপে একটি স্ত্রী আচার। বর বিয়ে করতে কনের দ্বারে উপস্থিত হলে কনের মা এয়োস্ত্রীদের সঙ্গে করে বরকে বরণ করেন এবং মিষ্টি মুখ করান। বরণ করার ডালাটা মাঙ্গলিক দ্রব্য দিয়ে সাজানো থাকে। সেই ডালা থেকে দুটো দ্রব্য উঠিয়ে বরের মাথা ও শরীরে ছুঁইয়ে দু’দিকে ফেলে দেয়। এটা অনেকটা নজর কাটানোর মতো ব্যাপার। অনেক ক্ষেত্রে ছাদনাতলায় কন্যাদাতা বরকে বস্ত্র আর উত্তরীয় দান করার পর এয়োস্ত্রীরা এসে উলুধ্বনি সহ বরকে বরণ করেন।
 মোনামুনি ভাসানো: এটাও একটা স্ত্রী আচার বিশেষ। বিয়ের দিন কন্যার স্নানের পর এয়োস্ত্রীরা একটি জলের গামলায় দুটো মোনামুনি ছেড়ে দেয়। ওগুলো ভাসতে ভাসতে যদি মিলিত হয় তবে ধরে নেওয়া হয় যে ভাবি দম্পতির দাম্পত্য জীবন সুখের হবে। আবার কোথাও কোথাও বিয়ের আগের দিন সন্ধেবেলা পুকুর বা নদীতে দুটো প্রদীপ ভাসানো হয়। প্রদীপ দুটো মিলিত হলে সেটা শুভ বলে মানা হয়।
 কনকাঞ্জলি: এটি একটি স্ত্রী আচারের মধ্যে পরে। কন্যা যখন বরের বাড়ি যায় তখন মায়ের আচলে সোনা, রূপোর মুদ্রা দিয়ে যায়। এটা দানের একটা আঞ্চলিক প্রথা। মা মেয়ের কাছ থেকে এই দান আঁচল পেতে নেন।
 বধূবরণ: নববধূ শ্বশুরবাড়ি পদার্পণ করলে অঞ্চল অনুযায়ী বিভিন্নভাবে তাকে বরণ করা হয়। কোনও জায়গায় বর বধূকে একসঙ্গে রেখে শাশুড়ি মা বিজোর সংখ্যক এয়োকে নিয়ে তাদের প্রদক্ষীণ করেন এবং এরপর বড়নডালা দিয়ে বরণ করেন। কোথাও দুধে আলতাগোলা থালাতে পা রেখে এক হাতে মাছ আর এক হাতে ধানের কুনকে নিয়ে ঘরের দরজায় এসে দাঁড়ালে শাশুড়ি বা শাশুড়ি স্থানীয় মহিলারা বউকে বরণ করে ঘরে তোলে। কোথাও কোথাও আবার বরণ করার পর শাশুড়ি মা বউয়ের মুখে বা কানে মধু ছোঁয়ান। মনে করা হয় এতে বউ মিষ্টি কথা শুনবে এবং মিষ্টি কথা বলবে। প্রতিটি স্ত্রী আচারেরই একটাই লক্ষ্য, বৈবাহিক জীবনের সুখ।
তথ্য সহায়তা: বিবাহের লোকাচার
নীহাররঞ্জন রায়
কাকলি পাল বিশ্বাস