বেশি বন্ধু-বান্ধব রাখা ঠিক হবে না। প্রেম-ভালোবাসায় সাফল্য আসবে। বিবাহ যোগ আছে। কর্ম পরিবেশ পরিবর্তন ... বিশদ
জন্ম, মৃত্যু, এবং বিয়ে, জীবনের তিনটি অবশ্যম্ভাবী ঘটনা। জন্ম আর মৃত্যু নিয়ে প্রশ্ন চলে না –পৃথিবীর বিভিন্ন সমাজে এই দুটির মধ্যে কোনও পার্থক্য নেই। কিন্তু নানান দেশের বিয়ের অনুষ্ঠান ভিন্নতার জমকে চমক লাগায়। সব দেশেই বিয়ের প্রধান উদ্দেশ্য, দুটি হৃদয়কে সামাজিক স্বীকৃতি দিয়ে বেঁধে দেওয়া। আমাদের দেশে বিয়ের পোশাকের রকমফের দেখলেই এই বৈচিত্র্যের কিছুটা স্বাদ পাওয়া যায়। বিয়ের সময় হিন্দু বাঙালি কনে লাল শাড়ি পরে, তামিল কনে পরে সরষে-হলুদ, কেরল এবং আসামের কনের সাজ হয় সাদা আর সোনালি মেশানো। সারা বিশ্বের ক্রিশ্চান সমাজে কনে পরে সাদা রঙের বেশ। রাজস্থানের বিয়ের অনুষ্ঠানে পুরুষেরা মাথায় লাল বাঁধনি কাপড়ের পাগড়ি জড়ায়।
বাঙালি মুসলমান বিয়ের মুখ্য রীতিগুলি ইসলাম ধর্ম অনুযায়ী হলেও আনুষঙ্গিক আচারগুলির সঙ্গে হিন্দু বৈবাহিক অনুষ্ঠানের মিল রয়েছে। পাকাদেখা, আইবুড়ো ভাত, গায়ে হলুদ, বরযাত্রা, কন্যা-বিদায়, বউ-বরণ, বাসর, ইত্যাদি বহু ঐতিহ্যগত লোকপ্রথাই হিন্দু এবং মুসলমান, দুই সমাজে প্রচলিত।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিজের দিদিমা/ঠাকুমা বা মায়ের বিয়ের ড্রেস পরে চার্চে বিয়ে করতে যাওয়া কনের জন্যে সৌভাগ্যজনক। অবশ্য সেই পোশাক যদি মোটামুটি ভালো অবস্থায় থাকে। এছাড়া বিয়ের কনের সাজের মধ্যে থাকতে হবে ‘সামথিং ওল্ড, সামথিং নিউ, সামথিং বোরোড অ্যান্ড সামথিং ব্লু’। বিয়ের শেষে হাতে ধরা ফুলের গুচ্ছটি কনে পিছন ফিরে ছুঁড়ে দেয় জমায়েত হওয়া কুমারী মেয়েদের ভিড়ে। যে ধরতে পারবে, এর পরের বিয়ে তার। আর নিজের অবিবাহিত বন্ধুদের মধ্যে বর ছুঁড়ে দেয় সদ্যবিবাহিত স্ত্রীর গার্টার অর্থাৎ মোজা-বন্ধনী। দুটি লোকাচার জমে ওঠে কমবয়সীদের আনন্দ হুল্লোড়ে।
সব দেশেই নানান মজাদার লোকাচার বিয়ের উৎসবকে সমৃদ্ধ করে তোলে। সুইডেনে নতুন বউ ঘরের বাইরে গেলেই মহিলা অতিথিরা চটপট বরকে চুমু খান। অবশ্য সব দেশের লোকপ্রথা এত মিষ্টিমধুর নয়। বিয়ের দিন কঙ্গোর বর-কনের হাসা বারণ। হেসে ফেললে সকলে মনে করে বিয়ে নিয়ে তারা ছেলেখেলা করছে। অর্থাৎ এ জুটি টিঁকবে না। মঙ্গোলিয়ার বাগদত্ত দম্পতিকে একটা মুরগি মেরে সেটার যকৃৎ সংগ্রহ করে গুরুজনকে দেখাতে হয়। কাজটা না পারলে বিয়ে বন্ধ। ছাদনাতলায় যাওয়ার আগে দক্ষিণ কোরিয়ায় কনের আত্মীয়স্বজন বরের পায়ের তলায় গাছের ডাল, চাবুক বা অন্য হাতিয়ার দিয়ে মারে। সেই মার হবু জামাইকে মুখ বুজে সহ্য করতে হয়। এ হল কৃচ্ছ্রসাধনের প্রমাণ।
জীবনসঙ্গী কেমন হবে, পুরুষ-নারী নির্বিশেষে বিয়ের আগে এই চিন্তা সকলের মনেই জাগে। আর্মেনিয়ায় বিবাহযোগ্য ছেলেমেয়েদের এই কৌতূহল মেটাবার ব্যবস্থা করা আছে। একজন সুখী, বিবাহিত, মধ্যবয়স্কা মহিলা বা ছেলেমেয়ের দিদিমা প্রচুর নুন দিয়ে রুটি সেঁকে রাখে। হবু বর-কনেরা সেই রুটি সোনামুখ করে খায়। কারণ, নুনে-কাটা রুটি খেলে ভবিষ্যৎ জীবনের সঙ্গী রাতে স্বপ্নে ধরা দেবে।
বিয়ের পরে রিসেপশনের উৎসবে ফরাসী বর-কনে চকোলেট এবং শ্যাম্পেন খাবে এটাই রেওয়াজ। চকোলেট আর শ্যাম্পেন? সে তো দারুণ জিনিস! দুঃখের বিষয় দুটিই তাদের খেতে হবে টয়লেট বোল বা কমোড থেকে। বিয়ের আনন্দের বদলে ব্যাপারটা সদ্য বিবাহিতের জন্যে বিভীষিকা হয়ে দাঁড়ায়। তাই আধুনিক যুগে নতুন আর অব্যবহৃত কমোড দিয়ে প্রাচীন নিয়মরক্ষা চলে। বুনো ওল হলে বাঘা তেঁতুল তো থাকবেই!
চীনের এক প্রদেশের নিয়ম, বিয়ে আরম্ভ হওয়ার আগে ভাবী স্ত্রীকে লক্ষ্য করে বর বেশ কয়েকটি তীর ছুঁড়বে। সেই তীর পুনর্সংগ্রহ করার পর বিয়ের অনুষ্ঠান আরম্ভ হয়। বিয়ে চলাকালীন লম্বা, সুখী জীবনের প্রতীক হিসেবে বর নিজের হাতে তীরগুলো দু’ টুকরো করে ভেঙে ফেলে। হয়তো সেই সঙ্গে কনেকে একটি বার্তাও পাঠায় — বিয়ের পরে সে আর কখনও স্ত্রীকে অত্যাচার করবে না।
ফিজি দ্বীপে কোনও কন্যাকে পছন্দ হলে তার বাবা বা পুরুষ অভিভাবকের কাছে ভাবী বরকে অনুমতি চাইতে হয়। কন্যার পিতাকে সম্মান জানানোর জন্যে এই প্রথাটি পাশ্চাত্যের অনেক দেশেই প্রচলিত। হবু জামাইয়ের কাছে এই অনুমতি চাওয়া এক ভীতিপ্রদ অভিজ্ঞতা। কিন্তু ফিজি দ্বীপে এই অনুমতি ভিক্ষা সত্যি সত্যিই প্রাণঘাতী হয়ে উঠতে পারে। মুগ্ধ যুবককে সমুদ্রে ডুব দিয়ে, তিমির দাঁত জোগাড় করে, সেটি হাতে নিয়ে ভবিষ্যৎ শ্বশুরের কাছে তাঁর কন্যার পাণীগ্রহণের ইচ্ছে প্রকাশ করতে হয়! ফিজির প্রথাটি খুঁটিয়ে দেখলে বোঝা যায় এ হল ভাবী স্বামীর সংসার পালনের দক্ষতা ও সাহসিকতার পরীক্ষা।
রাশিয়ায় বিয়ের আগে বরের বান্ধবীরা কনেকে উলঙ্গ করে তার দেহ পরীক্ষা করে শরীরের সব খুঁত গুনে বরের কাছে তালিকা পেশ করে। গোপন বার্তা ‘এখনও সময় আছে – পালাও!’ বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর নবদম্পতী উৎসবে যোগ দিতে পারে, কিন্তু কিছু খেতে পারে না। রিসেপশনে নাচগানের পর জমায়েত নিমন্ত্রিতরা বর-কনেকে নিয়ে তাদের শোবার ঘরের দরজা অবধি পৌঁছে দেয়। সেখানে বউয়ের প্রথম কাজ হল স্বামীর বুটজুতো খোলা। ইতিমধ্যে বরের জুতোর এক পাটিতে একটি ছোট চাবুক এবং অন্যটিতে একটি উপহার লুকিয়ে রাখা হয়েছে। স্ত্রী যে পাটি আগে খুলবে, ভবিষ্যতে তার সেটাই লাভ হবে। অর্থাৎ প্রথমে চাবুক শুদ্ধু বুটের পাটি খুললে সারা জীবন তার স্বামীর কাছে নির্যাতনই পাওনা।
বাঙালি বিয়েতে বিয়ের পরের দিন সকালে, শ্যালিকাবৃন্দ নতুন বরের জুতো লুকিয়ে ফেলে। বেশ কিছু টাকা মুক্তিপণ দিয়ে সেই জুতো উদ্ধার করতে হয়। পাকিস্তানেও এই লোকাচার প্রচলিত। ভারতীয় বিয়েতে কনে কাঁদবে না, তা যেন ভাবাই যায় না। ছেলেমেয়ে বড় বয়সে, নিজেরা ভালোবেসে বিয়ে করলে কী হবে, বিদায়ের সময় কনের কাঁদা দস্তুর হয়ে গেছে। তবে চীনের টুজিয়া সম্প্রদায় এই কান্নার রীতিকে অন্য এক লেভেলে পৌঁছে দিয়েছে। বিয়ের এক মাস আগে থেকে টুজিয়া কনে প্রতিদিন এক ঘণ্টা করে কাঁদতে আরম্ভ করে। সেই কান্না আরম্ভের দশ দিনের মাথায় কনের মা মেয়ের সঙ্গে যোগ দেন। তার দশদিন পরে কনের ঠাকুরমা / দিদিমা কাঁদুনের দল ভারি করেন। এক মাস কাটতে কাটতে পরিবারের সব মহিলাই একসঙ্গে কাঁদতে বসেন। প্রত্যেক মহিলা নানান সুরে কাঁদেন, ফলে এই সমবেত কান্না শুনতে লাগে গানের মতন। টুজিয়া সম্প্রদায়ের মতে নারীর চোখের জলই নবদম্পতীর আগামী পথ সুগম করবে। দেশ-বিদেশে বিয়ের নানান রীতি ও লোকাচারের মধ্যে সবচেয়ে সমস্যাজনক বোধহয় অপহরণ করে বিয়ে করা। হিন্দু বিবাহ রীতির মধ্যে পিশাচ বিবাহে কন্যা অপহরণ করে বিয়ের বিবরণ রয়েছে।
যে সব সমাজে বিয়ে করতে হলে জামাইয়ের থেকে কন্যাপণ দাবী করা হয়, সেখানে অপহরণ করে বিয়ে করলে টাকা দেওয়ার দায়িত্ব এড়ানো যায়। চীন ও জাপানে একসময় এই জন্যেই অপহরণ বিয়ে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। ইদানীং চীনে অপহরণ-বিয়ে আবার মাথা চাড়া দিয়েছে অন্য কারণে। চীনের এক-সন্তান নীতির ফলে কন্যাভ্রূণ হত্যা ও কন্যা সন্তান পরিত্যাগের হার বৃদ্ধি হয়ে পুরুষের অনুপাতে নারীর সংখ্যা খুবই কমে গিয়েছে। ফলে বিয়ের জন্যে চীনের বিভিন্ন প্রদেশে কনে পাওয়া যায় না। তাই বহু অঞ্চলে অপহরণ করে বিয়ে করার প্রচলন আবার বাড়ছে।
বিয়ের লোকাচারের লক্ষ্য নবদম্পতিকে যৌথ জীবনের পাঠ পড়ানো। এছাড়া শুভানুধ্যায়ীরা চেষ্টা করে পথের সব বাধা সরিয়ে দম্পতির সুষ্ঠু, সুদীর্ঘ বিবাহিত জীবন সুনিশ্চিত করতে। স্কটল্যান্ডে সেই জন্যে বর-কনেকে প্রাকবিবাহ আমন্ত্রণ জানিয়ে প্রচুর মদ খাইয়ে, বন্ধুবান্ধবেরা তাদের সর্বাঙ্গে ছাই, পালক, আটা, গুড়, ইত্যাদি ভালো করে মাখিয়ে দেয়। এই অনুষ্ঠানের নাম ব্ল্যাকেনিং। উদ্দেশ্য নবদম্পতির জীবন থেকে অপদেবতার অভিশাপ সরানো।
বিয়ের অনুষ্ঠান ঘিরে যা লোকপ্রথা, তাই স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক বিশ্বস্ততার প্রতিশ্রুতির উৎসব। সব সমাজই বিয়ের অনুষ্ঠানকে বিশেষ মর্যাদা দেয়। যে কৃষ্ণাঙ্গদের ক্রীতদাস হিসেবে আফ্রিকা থেকে অ্যামেরিকায় আমদানি করা হয়েছিল, বহুদিন তাদের আইনি বিয়ে করার কোনও অধিকার ছিল না। ফলে তারা বিয়ের একটি সহজ প্রথা সৃষ্টি করেছিল। বাড়িতে ঢোকার দরজায় আড়াআড়িভাবে একটি ঝাড়ু শুইয়ে রেখে বর-কনে সেটিকে লাফিয়ে ডিঙোলেই বিয়ে সম্পূর্ণ। প্রথাটি ব্রুম-জাম্পিং নামে বিখ্যাত। এই প্রথাটি এখন অ্যামেরিকার কৃষ্ণাঙ্গ সমাজের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। অনেকেই এই রীতি মেনে চলেন।