কর্মরতদের উপার্জন বৃদ্ধি পাবে। শরীর-স্বাস্থ্য ভালোই যাবে। পেশাগত পরিবর্তন ঘটতে পারে। শিল্পী কলাকুশলীদের ক্ষেত্রে শুভ। ... বিশদ
গোড়ার কথা
পরমা আর পাঁচটা মেয়ের মতো আঁকা শিখেছিলেন ছোটবেলায়। পড়াশোনার চেয়েও আঁকতেই তাঁর বেশি ভালো লাগত। স্কুলের পড়া শেষ করে চেয়েছিলেন আঁকাজোকা নিয়েই এগবেন। কিন্তু উকিলের পরিবারের মেয়ে ওসব করবে, বাবা মানেননি। অনিচ্ছা সত্ত্বেও আইন নিয়ে পড়াশোনা। কিন্তু রেজাল্টটা হল সেরা। পরমা তাই বাবাকে বোঝাতে পারেননি যে আইনের কচকচি ভালো লাগছে না। তবু টানা দশ বছর তাই নিয়ে কাজ করেছেন। তাতে লাভ হয়েছিল একটাই। ভালো রোজগার। কিন্তু মনটা ভরছিল না। এই ভাবনা থেকেই আইনের দুনিয়া ছেড়ে নিজের পছন্দের কাজে মনোনিবেশ করেছিলেন। ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে তাঁর নিজের নামের ব্র্যান্ডের পথ চলা শুরু। শুরুর গল্পটা এত অল্পে বলা হলেও পথটা মোটেই মসৃণ ছিল না। বাঙালি বাড়ি থেকে কোনও মহিলার ব্যবসা করার ধারণাটাই যে ধাক্কা দেওয়ার মতো। সেসব পাশ কাটিয়ে পরমা আজ প্রতিষ্ঠিত। প্রথমে কিছু দিন আইন আর ডিজাইনিং একসঙ্গে চলছিল। সেটা একসঙ্গে টানা সম্ভব নয়, অচিরেই বুঝেছিলেন তিনি। তাই ‘পরমা’-কেই শেষমেশ বেছে নেওয়া।
কোথায় আলাদা
সবরকম পোশাকে নকশা দিয়েই শুরু করেছিলেন এই তরুণী। তবে তাঁর করা ব্লাউজের পিছনের ব্যতিক্রমী কাজ জনপ্রিয়তা পায় দ্রুত। পলাশ ফুলের নকশা দিয়েই সে কাজের শুরু। একগুচ্ছ লালের সে সমারোহ মানুষের মন এতটা ছুঁয়ে যাবে, ভাবতে পারেননি তিনি। পলাশের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়নি, এমন লোক কমই রয়েছে। তবে পরমার মতে, গোলাপ বা পদ্মের মতো পলাশ নয়। সেটা সাধারণ হয়েও অনন্য। আর সেই সাধারণকে অসাধারণ করে তোলাটাই শিল্পীর কাজ। চোখে লাগা সাধারণ জিনিস নিয়েই পরীক্ষানিরীক্ষা করেন তিনি। তার সঙ্গে সঙ্গে মিশে যায় বাংলার সংস্কৃতি আর ঐতিহ্যের ছবিও। সত্যজিৎ রায়ের ছবি ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’-তে মেমরি গেমের একটি দৃশ্যে অভিনেত্রী কাবেরী বসু যে ঢাকাই শাড়িটি পরেছিলেন, সেটির পাড়ের নকশা পরমা তুলে এনেছিলেন তাঁর তৈরি করা ব্লাউজে। নাম দেন, ‘কাবেরী বসু ব্লাউজ’। তিনি জানাচ্ছেন, বাঙালি তো বটেই, কত অবাঙালি মহিলা যে তাঁর ওই নকশার জন্য ব্লাউজটি কিনেছেন, ভাবা যায় না! পরমা বলেন, ‘তাঁরা কাবেরী বসু নামেই ব্লাউজটি চান। ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ তাঁরা দেখেননি। তবুও সেটির চাহিদা এতটাই তাঁদের কাছে।’ পরমা জানালেন, তাঁরা শুধু রিলেট করেছেন। সেটাই অনেক।
সংস্কৃতি বা ঐতিহ্য কেন
ফ্যাশন ডিজাইনিংয়ের বাঁধাধরা পড়াশোনা নেই তাঁর। তাই ব্যাকরণ মেনে কিছু করার কথা মনে হয়নি পরমার। আইনের পেশায় থাকার সুবাদে সবসময় পিঠের দিকে পুরোটা ঢাকা ব্লাউজ, যাকে বলে এয়ারহোস্টেস স্টাইল, সেটাই ছিল দস্তুর। তাই থেকে তাঁর মনে হয়েছিল, টি-শার্টের সামনে যেমন নানারকম স্টেটমেন্ট বা নকশা থাকে, ব্লাউজের পিছনে তেমনটা করা যায় কি? বিশেষ করে তিনি নিজে শাড়ি পরতে খুবই পছন্দ করেন। বাঙালি মেয়েদের এমন নকশা নিশ্চয়ই চোখ টানবে। তা না হলে একঢালা রঙের ব্লাউজে বৈচিত্র কোথা থেকে আসবে? আর সংস্কৃতিকে এই ডিজাইনে মিশিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে তিনি বলেন,‘আমরা যখন টি-শার্টে লেখা ‘আই লভ নিউ ইয়র্ক’ পরি, তখন কি সেই শহরেই থাকি বলে পরি? গল্পটা যদি এমন হয়, কলকাতার না হয়েও কেউ আমার ডিজাইন পরে সেটার সঙ্গে রিলেট করতে পারেন, সেখানেই তো সার্থকতা। কারণ কিছু জিনিস এভাবেই বিশ্বজনীন।’ কলকাতা স্কাইলাইনকেও তিনি তুলে এনেছেন নকশায়। সেটিও বাঙালির পাশাপাশি অবাঙালিদের মধ্যে যথেষ্ট সমাদর পেয়েছে। তেমনই আছে তাঁর বিনোদিনী ব্লাউজ। ঋতুপর্ণ ঘোষ তাঁর ‘চোখের বালি’ ছবিতে বিয়ের দৃশ্যে ঐশ্বর্য রাই বচ্চনের কপালে যে চন্দনের নকশা নিজে হাতে এঁকেছিলেন, বিনোদিনী ব্লাউজে রয়েছে তারই ছোঁয়া। তাছাড়া কলকাতা শহরটাও পরমার কাছে এতটাই প্রিয় যে, তাঁর অনুপ্রেরণার অভাব হয় না।
সৃষ্টিকে লালন
এই শিল্পী মনে করেন, যে কাজটা প্যাশন থেকে শুরু করা, তাকে তো আলাদা করে লালন করতে হয় না। এমনিই এসে যায় সেটা। পরমা তাই নিজের যে কোনও সৃষ্টির পিছনের গল্পটাকেও খুব সুন্দর করে সোশ্যাল মিডিয়ায় তুলে ধরেন। অর্থাৎ বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে যিনি খুব ওয়াকিবহাল নন, তিনিও একঝলক পড়েই তার মাহাত্ম্য বুঝে যাবেন। ব্র্যান্ড পরমা তাই ‘স্টোরিজ অন ফ্যাব্রিক।’ তিনি গল্পটা বলেন বলেই ঢাকাই পাড়ের সাধারণ একটা ব্লাউজ তৈরি হয় না, তৈরি হয় ‘কাবেরী বসু ব্লাউজ।’ তাঁর আরও বড় পাওয়া, কাবেরী বসুর মেয়ের সঙ্গে আলাপের পরে তিনি নিজেই জানতে চেয়েছিলেন, আপনিই সেই পরমা, যিনি আমার মায়ের নামে একটা ব্লাউজ ডিজাইন করেছেন? সেখান থেকে শুরু হয় ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ নিয়ে তাঁদের কথোপকথন। পরমা বলেন, ‘ব্লাউজের নকশা থেকে এই যে একটা আলাপচারিতার শুরু, এর মূল্য অতুলনীয়।’
এটা একজন সাধারণ ক্রেতার ক্ষেত্রেও তাই। ব্লাউজটা কিনলাম, পরলাম আর ভুলে গেলাম, সেখানে শেষ করতে দিতে চাননি তিনি। তাঁর সৃষ্টিটা যেন বংশপরম্পরায় গল্প হিসেবে ছুঁয়ে থাকে সবার মনে। তাই ফিরে আসে জামদানি, হ্যান্ড এমব্রয়ডারি, কাঁথা স্টিচ। সাধারণত তাঁর নিজের মন ছুঁয়ে যায় যেটা, সেটাই সৃষ্টিতে ফুটিয়ে তোলেন। তাতে একটা ব্যাপার ঘটে। তাঁর কাছে যেটার আবেদন রয়েছে, সাধারণ ক্রেতা সেটা ততটা পছন্দ না-ও করতে পারেন। আবার তিনি নিজেই ডিজাইনার হিসেবে যে নকশাকে ততটা মনের কাছাকাছি রাখেননি, সেটাই হয়তো জনপ্রিয়তা বেশি পেল। মন থেকে কাজ করলে এটা হয় বলে মনে করেন পরমা। তাই ‘নায়ক’ ছবির সংলাপ ধরে তিনি ‘মনে রেখে দেব’ কথাটি এঁকেছিলেন ব্লাউজের পিছনে। আর সামনের দিকে ছিল ফাউন্টেন পেন গোঁজা আর চশমার নকশা। তাঁর নিজের কাছে বাংলা ছবির অন্যতম সেরা রোম্যান্টিক দৃশ্য মনে হতো ওটা। কিন্তু সেটা সাধারণ ক্রেতার মনে ততটা দাগ কাটেনি। পরমা সেটা মেনে নিতে প্রস্তুত। কারণ তাঁর প্যাশন অনুযায়ী কাজটা তো করতে পেরেছেন। এত দিনে ব্লাউজে অন্তত ৩০০-র ওপরে নকশা করে ফেলেছেন তিনি। সেগুলোর আবার নকলও ছেয়ে গিয়েছে বাজারে! নিজেই জানালেন সেটা। পাশাপাশি শাড়ি আর বাচ্চাদের পোশাকও অল্পবিস্তর করেন তিনি। রোগা-মোটা সবরকম গড়পরতা সাইজের ব্লাউজ পাওয়া যাবে তাঁর কাছে। মাপে একটু এদিক-ওদিক হলে ঠিক করেও দেন তাঁরা। ভবিষ্যতে ফিল্মের জন্যও পোশাক ডিজাইন করার ইচ্ছে তাঁর রয়েছে। এ শহরের লেক টেরেসে তাঁর নিজস্ব স্টুডিওয় গেলেও নিজে চোখে নিতে পারেন পরমার সৃষ্টি।