উচ্চশিক্ষা ও বৃত্তিমূলক শিক্ষায় দিনটি শুভ। কর্মস্থলে বড় কোনও পরিবর্তন নেই। আর্থিক দিক অপেক্ষাকৃত শুভ। ... বিশদ
দিল্লি এবং বেশ কিছু ভারতীয় শহরের বাসিন্দাদের বছরের বিভিন্ন মরশুমে মোবাইলে সকালে উঠে আবহাওয়া কন্ডিশন দেখা অভ্যাস। শীতকালে আগ্রহ সহকারে নাগরিকরা দেখতে চায় আজ কত সর্বনিম্ন তাপমাত্রা। গ্রীষ্মকালে আগ্রহ তৈরি হয় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা কত হবে অথবা কত ছিল। যখন মোবাইল ছিল না, তখনও এই আগ্রহ পূরণ করা হতো টিভির নিউজ দেখে। কিন্তু দেশের রাজধানী শহর দিল্লি এবং অন্য কিছু নগরীতে শীতকাল আসার আগের এক দুমাস ধরে অন্যতম মোবাইল সার্চিং-এর বিষয়বস্তু হল, একিউআই কত আছে? একিউআই হল এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স। সাধারণ নিয়ম হল, ৫০-এর এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স থাকলে সেটা শ্বাসপ্রশ্বাসের জন্য সহনীয় এবং ওটাই মাপকাঠি হওয়া উচিত। কিন্তু আদতে কত থাকে দিল্লি ও দেশের বহু নগরীর একিউআই? পেরিয়ে যায় চারশো, পেরিয়ে যায় ৮০০। যা দিনে ৬০ থেকে ৮০ টা সিগারেট খাওয়ার সমান। দিল্লিজুড়ে শ্বাসকষ্ট চলে। সবথেকে কাদের ক্ষতি? যাদের পেশার জন্য বাইরে না বেরিয়ে উপায় নেই। সবথেকে কাদের লাভ? চিকিৎসা সংক্রান্ত ব্যবসায়ী এবং কর্পোরেট সংস্থার। কেন? হু হু করে এয়ার পিউরিফায়ার বিক্রি হয়। দেশের সবথেকে বড় এয়ার পিউরিফায়ার মার্কেট হল দিল্লি ও উত্তর ভারত। ঠিক যেভাবে দেশজুড়ে অসংখ্য নামী অনামী প্যাকেজড ওয়াটার কোম্পানির বাণিজ্য সবথেকে বেড়েছে বিগত ২০ বছরে, তেমনই বাড়ছে এয়ার পিউরিফায়ার। এবং ওষুধ কোম্পানি তথা নার্সিংহোমদের মুনাফা চরমে। এয়ার পিউরিফায়ার, মাস্ক, নিবুলাইজার এবং অ্যান্টি অ্যালার্জিক ওষুধ— এই হল সবথেকে লাভজনক ব্যবসা এখন।
ঠিক এখানেই প্রশ্ন ওঠে সরকারের ভূমিকা কী? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে ধন্দের জন্ম হয়। কারণ দূষণ নিয়ন্ত্রণের জন্য কেন্দ্রীয় সরকার নির্দিষ্ট টাকা বরাদ্দ করে। ২০২৪ সালের বাজেটে পরিবেশ মন্ত্রকের জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে, ৩৩৩০ কোটি টাকার কিছু বেশি। এই টাকার মধ্যে দূষণ নিয়ন্ত্রণের জন্য বরাদ্দ হয়েছে ৮৫৮ কোটি টাকা। গত আর্থিক বছরের বাজেটে বরাদ্দ করা হয়েছিল ৮৪৭ কোটি টাকা। যে টাকায় বিগত এক বছর ধরে কাজ হওয়ার কথা ছিল দূরণ নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষেত্রে। ওই টাকায় কী হল? কোথায় গেল সেই টাকা? দূষণ নিয়ন্ত্রণ খাতে কী কী ভাবে ব্যয় করা হয় টাকা? ৮৪৭ কোটি টাকা তো সামান্য নয়? কেন্দ্রীয় রাজকোষ থেকে এই টাকা কোথায় কোথায় গেল? কারা পেল? রাজ্যগুলি কীভাবে খরচ করল? এই তাবৎ প্রশ্নের একটি জবাব তো হওয়া উচিত যে, দূষণের হার কিছুটা কমেছে। কিন্তু সেটা তো হচ্ছে না! উল্টে বেড়ে গিয়েছে। যারা ট্যাক্স দিচ্ছে বছরের পর বছর, ভোট দিচ্ছে, তাদের আয়ু কমে যাচ্ছে। তাদের চিরস্থায়ী শ্বাসজনিত রোগ হয়ে যাচ্ছে। দিল্লির অফিসগুলি ওয়ার্ক ফ্রম হোম করে দিয়েছে। স্কুল কলেজ বন্ধ। কেন? কারণ দূষণ।
গোটা বিশ্বের সর্বোচ্চ দূষণ যেসব শহরে সেই ১০০টি শহরের মধ্যে ৬০টি ভারতে। ন্যাশনাল মিশন ফর গ্রিন ইন্ডিয়া। এই ব্যাপারটি ঠিক কী? কাদের কাছে এ বছরও ১৭০ কোটি টাকা গিয়েছে? তাদের কী করতে হয়? সাধারণ মানুষ কিন্তু জানে না। সাধারণ মানুষ শুধু জানতে চাইছে আমরা যে জিএসটি, ইনকাম ট্যাক্স কিংবা সেস বাবদ বিভিন্ন টাকা প্রতিদিন দিয়ে থাকি সেইসব টাকায় এই বরাদ্দগুলি করা হয়। তাহলে কোনও লাভ পাচ্ছি না কেন? ১৪৫ কোটি জনসংখ্যার দেশে নানাবিধ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে দেওয়া ট্যাক্সের টাকা কারা ভাগাভাগি করে নিয়ে নিচ্ছে? ১০ বছর আগে আমাদের চারদিকের পরিবেশ যেমন ছিল, তার থেকে দারুণ উন্নত হয়ে গিয়েছে এরকম তো হচ্ছে না? ঝকঝকে রাস্তা, পরিচ্ছন্ন ফুটপাত এবং প্রচুর পার্ক পেতে হলে আমাদের নতুন গড়ে ওঠা স্যাটেলাইট টাউনশিপে ৫০ লক্ষ অথবা ১ কোটি টাকার বেশি দামের ফ্ল্যাট কিনে যেতে হবে কেন? আমার সাধারণ পাড়ার বাড়িঘরের পার্শ্ববর্তী এলাকাকে বাসযোগ্য এবং উন্নত করে তোলার জন্য সরকার কী করছে? বিশুদ্ধ বাতাসই দিতে পারছে না? কোভিডের সময় যেমন অক্সিজেন দিতে পারেনি?
এই যে এত বড় একটা ওলিম্পিক্স হয়ে গেল। আর কত বছর ধরে হা হুতাশ করব আমরা যে চীন পারে, আমেরিকা পারে, রাশিয়া পারে আমরা কেন পারি না। ৪০ বছর আগেও যা হতাশা ছিল, এখনও তাই। কিছু সোনার ছেলেমেয়ের উজ্জ্বল ব্যক্তিগত অবদানের জন্য আমাদের মুখ এক দুদিনের জন্য উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। সামগ্রিকভাবে প্রথম সারিতে উঠে আসা আর হয় না ভারতের। কেন? ভারত সরকার ক্রীড়া মন্ত্রকের জন্য ৩৪৪২ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছিল গত বছরে। আর এই বছরে ওলিম্পক্স হয়েছে। ওই টাকা কোথায় গেল? কারা পেল? কারা পেল না? কাদের মাধ্যমে খরচ হয়েছে? প্রত্যেকটি প্রশ্নের উত্তর আছে। কারণ ওই উত্তর প্রোটোকল অনুযায়ী প্রযোজ্য। অর্থাৎ কীভাবে বরাদ্দকৃত অর্থ ব্যয় করা হয়। কিন্তু প্রশ্ন হল, সরকার কি তৃণমূল স্তরে অডিট করছে? খেলো ইন্ডিয়া নামক একটি প্রকল্প আছে। যা বর্তমান ভারত সরকারের কাছে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ। গত বছর এই ‘খেলো ইন্ডিয়া’ প্রকল্পে ভারত সরকার দিয়েছে ৮৮০ কোটি টাকা। এই বছরের বাজেটে কত টাকা বাড়ানো হয়েছে? মাত্র ২০ কোটি টাকা! ভারত কেন আন্তর্জাতিক ক্রীড়া চ্যাম্পিয়নশিপে প্রথম সারির জায়গা করে নিতে পারছে না? এই প্রশ্ন সকল দেশবাসীর। সেই প্রশ্নের সামনে একটি তথ্য জানা দরকার। ভারতে গত বছরের ক্রীড়া বাজেটের তুলনায় এই বছরের বাজেট বেড়েছে ৪৫ কোটি টাকা। দিল্লির তিলক মার্গ অথবা সুন্দরনগরে একটি বাংলোর দাম কত? ১০০ কোটি টাকা!
দূষণ কমাতে কি আদৌ সরকার পক্ষ চায়? টাকা কত বরাদ্দ করা হল, সেই টাকা কীভাবে ব্যয় করা হয়, কারা আসলে নানাবিধ পরিকল্পনা পেশ করে সিংহভাগ টাকা হস্তগত করল, কারা গোপনে গোপনে আত্মসাৎ করে নেয় বছরের পর বছর ধরে হাজার কোটি টাকা— এসব তো বৃহৎ প্রশ্ন! ক্ষুদ্র প্রশ্ন হল, সরকারের পক্ষ থেকে দূষণ কমানো, নিজেদের ভোটারদের, নাগরিকদের অন্তত স্বস্তি ও শান্তিতে থাকতে দেওয়ার কোনও ইচ্ছা ও আগ্রহ আছে? নেই। থাকলে এতদিনে পার্লামেন্টে আইন সংশোধন করে যত্রতত্র তারস্বরে মাইক বাজানো, ডিজে বাজানো কিন্তু বন্ধ হয়ে যেত। আইন এনে বলা হতো যে বাজি ফাটানো যাবে না। আইন আনলে কী হতো? পুলিসকে দায়বদ্ধ করা যেত যে, তারা চোখের সামনে বছরের পর বছর আইন অমান্য হচ্ছে দেখেও কিছু বলছে না। কোনও সরকার কিন্তু এসব বন্ধ করার কোনও উদ্যোগ মন থেকে করে না। আর তাই প্রতি বছর স্রেফ লোকদেখানো কিছু প্রহসন হয়। কেমন প্রহসন?
উৎসবের মরশুমের আগে সুপ্রিম কোর্ট কড়া নির্দেশিকা দেয় বাজি ফাটানো নিয়ে। প্রবল নিষেধাজ্ঞা জারি হয়। সেটা বড় বড় হেডলাইন হয় সংবাদপত্রে। পুলিস নিয়ম করে দেখায় যে তারা কোথা থেকে কত বাজি বাজেয়াপ্ত করেছে। আর পাশাপাশি সর্বত্র নিষিদ্ধ বাজি তৈরি হয়। বিক্রি হয়। কেনাকাটা হয়। যে কোনও ধর্মীয় উৎসবের সময় যথারীতি বাজি ফাটে। মানুষ অসুস্থ হয়ে যায়। দিল্লি ও উত্তর ভারত দূষণের ধোঁয়ায় ঢেকে যায়। পাশাপাশি চলে ফসলের অবশেষে নাড়া পোড়ানো। সেই ধোঁয়া ঢোকে। সুপ্রিম কোর্ট সরকারদের বকাবকি করে। আবার হেডলাইন হয় সংবাদমাধ্যমে। কিন্তু দূষণ কমে না। মানুষ অসুস্থ হয়। মাস্ক কেনে। এয়ার পিউরিফায়ার কেনে। ওয়ার্ক ফ্রম হোম হয়। এরপর বাতাস বইতে শুরু করে। কমতে থাকে একটু দূষণ। সবাই সব কিছু ভুলে যায়। আবার আসছে বছর আবার হবের প্রস্তুতি চলে। এভাবেই বছরের পর বছর ধরে চলছে।
বিগত ২০ অথবা ৩০ বছরে কী হয়েছে সেই হিসাব বাইরে রাখছি। শুধু বিগত পাঁচ বছরে দিল্লির যমুনা নদীকে দূষণমুক্ত ও বিষাক্ত পদার্থমুক্ত করতে প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে। এক বিন্দুও পরিবর্তন হয়নি। কোথায় গেল সেই টাকা? দূষণমুক্ত করার জন্য গঙ্গা অ্যাকশন প্ল্যান অথবা নমামি গঙ্গে প্রকল্প। কখনও বরাদ্দ হয়েছে ৩০ হাজার কোটি টাকা! কখনও ২৬ হাজার কোটি টাকা। কোথায় গেল সেইসব টাকা? গঙ্গা কতটা পরিচ্ছন্ন হয়েছে গঙ্গোত্রী থেকে সাগর পর্যন্ত?
সারাবছর কাদের ঘুম নিশ্চিন্তে হয়? ভিআইপিদের। নেতা, মন্ত্রী, কর্পোরেট। যাদের বাড়ির আশপাশে সারারাত ধরে বাজি ফাটে না। উচ্চস্বরে মাইক বাজে না। বাড়ি এবং হৃদপিণ্ড কাঁপিয়ে ডিজে বাজে না। অসুস্থ বোধ করলে অক্সিজেন পাওয়া যায়। যখন তখন রক্ত পাওয়া যায় যে কোনও ব্লাডগ্রুপের। মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে কিছু এসে যায় না। আর পক্ষান্তরে এসব কাদের ভাগ্যে নেই? যারা আম জনতা নামে পরিচিত, তারা এসব পায় না। তারা কী পায়? প্রতিশ্রুতি, আশ্বাস এবং বঞ্চনা। কারা বছরভর স্বস্তি, শান্তি এবং নিরুপদ্রব এক জীবনযাপন করে? যারা ভোট পায়। কারা শান্তির জীবন পায় না? যারা ভোট দেয়!