উচ্চশিক্ষা ও বৃত্তিমূলক শিক্ষায় দিনটি শুভ। কর্মস্থলে বড় কোনও পরিবর্তন নেই। আর্থিক দিক অপেক্ষাকৃত শুভ। ... বিশদ
স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাকে যে নানাভাবেই বঞ্চনা করা হয়েছে সেই তথ্য সর্বজনবিদিত। কংগ্রেস, জনতা, যুক্তফ্রন্ট, বিজেপি কেউই বাংলাকে ঢেলে উন্নয়নের উপহার দিয়েছে এরকম হয়নি। কিন্তু কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় বাংলার প্রতিনিধিরা ছিলেন। ভারত সরকারের নীতি নির্ধারণ প্রক্রিয়ায় প্রত্যক্ষ অংশ নেওয়ার মতো বাঙালি আধিকারিকরা ছিলেন। কখনও কম। কখনও বেশি। কখনও গুরুত্বপূর্ণ। কখনও বা গুরুত্বহীন।
কিন্তু একটানা ১০ বছর ধরে ভারত সরকারে কোনও বাঙালি পূর্ণমন্ত্রী নেই এই রেকর্ড আর কোনও প্রধানমন্ত্রীর আমলে কি হয়েছে? মনে পড়ে না। মোদি ঠিক সেটাই করে দেখিয়েছেন। ২০১৪ সালে বিজেপি সরকারের নেতৃত্ব দেওয়া প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকে আজ পর্যন্ত কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় কোনও বাঙালি মন্ত্রী করা হয়নি। যাঁরাই মন্ত্রী হয়েছেন তাঁরা রাষ্ট্রমন্ত্রী। পূর্ণমন্ত্রী না হলে ভারত সরকারের কোনও সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় অংশ নেওয়া যায় না। এই যে প্রতি সপ্তাহে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার বৈঠক হয় এবং বিভিন্ন সিদ্ধান্ত অনুমোদিত হয়, সেই বৈঠকে অংশগ্রহণ করেন পূর্ণমন্ত্রীরা। পূর্ণমন্ত্রীরা সিংহভাগ ক্ষেত্রেই রাষ্ট্রমন্ত্রীদের গুরুত্বই দেন না। স্বয়ং মোদি বারংবার মন্ত্রীদের নির্দেশ দিয়েছেন যে, রাষ্ট্রমন্ত্রীদের দায়িত্ব দিন, তাঁদের কাছে ফাইল পাঠান, তাঁদের গুরুত্ব দিন। কিন্তু ভারত সরকারের মন্ত্রিসভায় সেই প্রথাই গড়ে ওঠেনি।
আর ঠিক সেই কারণেই লক্ষ করা যায় যে, মোদি সরকারের অন্দরে বাংলা সম্পর্কে দরবার করা, বাংলায় কোনও প্রকল্পকে বেশি করে দেওয়া, বাংলার জন্য বিশেষ কিছু উন্নয়ন পরিকল্পনা অথবা নতুন সরকারি লগ্নির ঘোষণা হয় না। এর পরোক্ষ প্রভাব হল, বৃহৎ কর্পোরেট সেক্টরও জেনে গিয়েছে যে, বাংলাকে এই সরকার বিশেষ গুরুত্ব দেয় না। তাই সেইসব শিল্পমহলও বাংলায় কিছু করার আগে দশবার ভাবে।
১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার ঠিক পরেই যে প্রথম মন্ত্রিসভা গঠন করেছিলেন জওহরলাল নেহরু, সেখানে নেহরুর চরম সমালোচক হওয়া সত্ত্বেও স্থান হয়েছিল হিন্দু মহাসভার শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় এবং ক্ষিতীশ চন্দ্র নিয়োগীর। কয়েক বছর পর তাঁরা পদত্যাগ করেন। শ্যামাপ্রসাদ ছিলেন শিল্পমন্ত্রী।
১৯৫২ সালে ভারতের প্রথম সাধারণ নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছিল। সেই নির্বাচনের পরও একক গরিষ্ঠতাপ্রাপ্ত কংগ্রেসের সরকার গঠিত হয়। নেহরুর এই দ্বিতীয় মন্ত্রিসভাতে একজন বাঙালি পূর্ণমন্ত্রী ছিলেন। চারুচন্দ্র বিশ্বাস। যিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন। এমনকী রাজ্যসভার নেতা ছিলেন তিনি। অর্থাৎ চেয়ারম্যানের পর যেটা সর্বোচ্চ পদ।
১৯৫৭ সালে আবার জওহরলাল নেহরুর নেতৃত্বেই কংগ্রেস সরকার ফিরে এল ক্ষমতায়। কিন্তু এই প্রথম পূর্ণমন্ত্রী পদে কোনও বাঙালিকে দেখা গেল না। তবে রাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে তিনজন বাঙালি রাজনীতিবিদের প্রবেশ ঘটল সেই সরকারে। এস কে দে। অশোক সেন। হুমায়ুন কবীর।
ঠিক পরের নির্বাচন অর্থাৎ ১৯৬২ সালে এক ধাক্কায় নেহরু মন্ত্রিসভার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দুই পূর্ণমন্ত্রী বাংলা পেয়ে গেল। কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী হলেন হুমায়ুন কবীর। কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী অশোক কুমার সেন। এক বছরের মধ্যেই হুমায়ুন কবীরকে দেওয়া হয়েছিল পেট্রলিয়াম মন্ত্রকের দায়িত্ব।
ইন্দিরা গান্ধী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর প্রথম নির্বাচনের সম্মুখীন হয়েছিলেন ১৯৬৭ সালে। সেই ১৯৬৭ সালের নির্বাচনে জয়ী হওয়া ইন্দিরা গান্ধীর মন্ত্রিসভায় প্রথমে বাঙালি মন্ত্রী কেউ ছিলেন না। ১৯৬৯ সালে একের পর এক গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রকের পূর্ণমন্ত্রীর পদে বসেন শিক্ষাবিদ ত্রিগুণা সেন। শিক্ষামন্ত্রী, পেট্রলিয়াম মন্ত্রী, খনি মন্ত্রী। ত্রিগুণা সেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হওয়ার কয়েক বছর আগে পর্যন্ত ছিলেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। ইন্দিরা গান্ধীর মন্ত্রিসভায় ক্রমেই পরবর্তী নির্বাচনে স্থান করে নিয়েছিলেন সিদ্ধার্থশংকর রায়, দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়রা।
১৯৭৭ সালে ইন্দিরা গান্ধীকে পরাস্ত করে ভারতে স্বাধীনতার পর প্রথম কংগ্রেসহীন ভারত সরকার গঠন করে জনতা পার্টি। মোরারজি দেশাইয়ের আমলে কিন্তু বাঙালি পূর্ণমন্ত্রী পায়নি বাংলা। ঠিক এই পর্ব থেকেই ক্রমেই বাংলার একঝাঁক রাজনীতিবিদ জাতীয় রাজনীতি তথা দিল্লির ক্ষমতার অলিন্দে উঠে আসেন স্বমহিমায়। এমনকী তাঁরা কংগ্রেসের সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারণ প্রক্রিয়াতেও প্রবেশ করেন। এই তালিকায় রয়েছেন প্রণব মুখোপাধ্যায়, এ বি এ গনি খান চৌধুরী, প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি, সন্তোষমোহন দেব, অজিত পাঁজারা। অজিত পাঁজা রাজীব গান্ধীর সরকারে স্বাধীন দায়িত্বপ্রাপ্ত রাষ্ট্রমন্ত্রীর পদে বসেছিলেন। এবং ক্রমেই প্রণববাবু, প্রিয়বাবু এবং সন্তোষমোহন দেব রাজ্য নেতা হয়েও কেন্দ্রীয় রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হয়ে ওঠেন।
বাঙালি পূর্ণমন্ত্রী হলে বাংলার কী লাভ হতে পারে সেই ইতিহাস বই লিখে গিয়েছেন সর্বপ্রথম এ বি এ গনি খান চৌধুরী। তাঁর রেলমন্ত্রিত্বের আমলে উজাড় করে দিয়েছেন তিনি বাংলাকে। যেমন রেলে চাকরি পেয়েছে বহু ছেলেমেয়ে, তেমনই আবার প্রকল্প ও ট্রেন।
আর গনি খান চৌধুরীর রেকর্ডও ভেঙে দিয়ে বাংলার জন্য কল্পতরু হওয়ার উদাহরণ স্থাপন করেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রথমে অটলবিহারী বাজপেয়ির সরকারে এবং তারপর মনমোহন সিং সরকারে দফায় দফায় রেলমন্ত্রী হয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলার জন্য অসংখ্য প্রকল্প এবং ট্রেন উপহার দিয়েছেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রণব মুখোপাধ্যায় এবং প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সির পর দিল্লিতে বাংলার প্রভাবশালী এবং গুরুত্বপূর্ণ প্রতিনিধিত্ব শূন্য।
১০ বছর ধরে একটানা ভারত সরকারে একজনও বাঙালি পূর্ণমন্ত্রী নেই, এরকম ৭৭ বছরের ইতিহাসে হয়নি। বঞ্চনার সেরা রেকর্ড। ২০১৯ সালে বাংলা ১৮ জন বিজেপি এমপি উপহার দিয়েছিল নরেন্দ্র মোদিকে। কিন্তু মোদি ও অমিত শাহের একবারও মনে হয়নি যে, বাংলার কাউকে পূর্ণমন্ত্রী করা হোক। ২০২৪ সালেও একই প্রবণতা। ১২ জন বিজেপি এমপি। অথচ কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব কাউকেই পূর্ণমন্ত্রী হওয়ার যোগ্য মনে করেনি এখনও পর্যন্ত। আর তাই অনায়াসে বাংলা বঞ্চিত হয়ে চলেছে। বাংলায় বিগত ১০ বছরে কোনও বৃহৎ শিল্প লগ্নি আসেনি। নেই কোনও বড়সড় প্রকল্প। কেন্দ্রীয় সরকার বাংলাকে বৃহৎ কিছু উপহার দিয়েছে এরকম একটিও উদাহরণ নেই। এটা সবথেকে বেশি সমস্যায় ফেলেছে বঙ্গবিজেপিকেই। একজন পূর্ণমন্ত্রী হলে তাদেরও রাজনীতি করতে সুবিধা হতো। ১০ বছরে যেমন কোনও পূর্ণমন্ত্রীও নেই, তেমনই কংগ্রেস, বিজেপি, সিপিএম ইত্যাদি সর্বভারতীয় দলগুলিতে এখন আর বাঙালি কোনও নেতা জাতীয় রাজনীতির সর্বোচ্চ স্তরে নেই। কোনও দলের সিদ্ধান্ত গ্রহণ, নীতি নির্ধারণ, সরকারকে প্রভাবিত করা, বাংলার জন্য কোনও প্রকল্প কিংবা লগ্নি আদায় করে নিয়ে আসার মতো শক্তিশালী নেতা-নেত্রী নেই। বর্তমানে এইসব দলের বাঙালি নেতানেত্রীরা নিছক দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের অনুগামী, অনুগত এবং নির্দেশ পালনকারী। নিজেদের শক্তি নেই। প্রভাব নেই। গুরুত্বও নেই। আজকের বাঙালি নেতা-নেত্রীরা শুধুই তাঁদের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে তুষ্ট করতে চান।
আর তাই দাদাসাহেব ফালকের নামাঙ্কিত সর্বোচ্চ মানের পুরস্কার পাওয়া প্রাক্তন এক হিন্দি সিনেমার বাঙালি স্টার বিজেপি নেতা হয়ে গিয়ে কলকাতায় বসে অনায়াসে মঞ্চে থাকা কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে খুশি করতে হিন্দি ভাষায় সংলাপ বলতে পারেন, কেটে ভাগীরথী নদীতে ভাসাব না...ভাগীরথী আমাদের মা। কেটে মাটিতে পুঁতে দেব...। এর আগে একবার ভোটের প্রাক্কালে তিনি ব্রিগেডে আর একটি জনপ্রিয় সংলাপ বলেছিলেন, আমি জাত গোখরো...এক ছোবলেই ছবি...। কিন্তু সেটা ছিল এই পুরস্কার পাওয়ার অনেক আগে। পুরস্কার পাওয়ার পর তো সেই সম্মান বহনের দায়িত্ব অনেক বেড়ে যায়। সেটাই বুঝলেন না তিনি!
দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার পাওয়ার যে ওজন, যে সম্মান, যে ঐতিহ্য, যে আভিজাত্য সেটা বহন করার জন্যও একটি উচ্চমার্গের চিন্তাশক্তি এবং আত্মসম্মানবোধ এবং সামাজিক সংযমের প্রয়োজন হয়। যার মধ্যে বাকসংযম অন্যতম। এর আগে কারা পেয়েছেন এই পুরস্কার? সবথেকে বেশি পেয়েছে বাঙালিই। রাইচাঁদ বড়াল, বীরেন্দ্র নাথ সরকার, ধীরেন্দ্র নাথ গাঙ্গুলি, কানন দেবী, পঙ্কজ মল্লিক, হৃষিকেশ মুখার্জি, অশোক কুমার, সত্যজিৎ রায়, মান্না দে, হৃষিকেশ মুখার্জি, অশোক কুমার, সত্যজিৎ রায়, তপন সিনহা, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, মৃণাল সেন। এই ঐতিহ্যের শেষতম প্রতিনিধির মুখে ওই ভাষা কিন্তু বাঙালিকে দুঃখই দিয়েছে। মঞ্চে থাকা অমিত শাহ খুশি হয়েছেন কি না জানা নেই। তবে বাঙালি খুশি হয়নি।
বাংলা অর্থবরাদ্দ পায়নি। বাংলা উন্নয়ন পায়নি। বাংলা শিল্প পায়নি। বাংলা মনোযোগ পায়নি। একটিও পূর্ণমন্ত্রক পায়নি। ১০ বছর ধরে এই প্রবণতা কি সবথেকে বড় অপমান নয়? বঙ্গবিজেপির কিন্তু এবার ভাবার সময় এসেছে যে, তাদের রাজনীতি কোনদিকে অগ্রসর হওয়া উচিত! তাদের সবথেকে বড় শত্রু তৃণমূল হতে পারে। কিন্তু তাদের অগ্রগতি ও সম্মানের সবথেকে বড় প্রতিবন্ধকতা তাদেরই কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। যারা বাংলাকে গুরুত্বই দেয় না।