চ্যালেঞ্জটা নিয়েছিলেন ইন্দিরা গান্ধী। সালটা ১৯৭৮। তখন তিনি আর কংগ্রেসের নন... জরুরি অবস্থার আঘাতে পরাজিত, রাজনৈতিক একাকিত্বের শিকার। তাও নিয়েছিলেন চ্যালেঞ্জটা। আজমগড় সেই সময় চরণ সিংয়ের দুর্গ। জনতা সরকার তাই একটা নিশানাতেই স্থির ছিল, ইমেজে চোট লাগতে দেওয়া যাবে না। ইন্দিরা যেন এই লোকসভা উপনির্বাচনে কোনওভাবে মাথা তুলতে না পারেন। প্রিয়দর্শিনী শেষ... এটাই আরও একবার প্রমাণ করতে হবে। তেড়েফুঁড়ে নামলেন জর্জ ফার্নান্ডেজ, অটলবিহারী বাজপেয়ি, চন্দ্রশেখররা। ভোটারদের দরজায় দরজায় ঘুরলেন। জরুরি অবস্থার প্রসঙ্গ টেনে উস্কে দিলেন আজমগড়কে। বললেন, জনতা পার্টির হাতেই আপনাদের ভবিষ্যৎ নিরাপদ। ওঁকে একটাও ভোট দেবেন না। ‘ইন্দিরা কংগ্রেসে’র সুপ্রিমোও ততদিনে ঠিক করে ফেলেছেন তাঁর প্রার্থী—মহসিনা কিদোয়াই। সংখ্যালঘু, উত্তরপ্রদেশের আদি কংগ্রেসি পরিবার থেকে উঠে আসা। বেরিয়ে পড়লেন ইন্দিরা... হাতে-বোনা সুতির শাড়ি, লম্বা হাতা ব্লাউজ। আলতোভাবে মাথায় আঁচল টেনে ঘোমটা। হুডখোলা জিপে মহসিনাকে পাশে নিয়ে রওনা দিলেন ইন্দিরা... আজমগড় জয়ের লক্ষ্যে। ৩০ ঘণ্টারও কম সময়ে ২৪টা জনসভা করেছিলেন ইন্দিরা। তাঁর শিডিউলে কতগুলো ছিল? মাত্র ১৪টা। আপডেট করার মতো সময় বা সুযোগ, কোনওটাই পাচ্ছিলেন না দলের রেকর্ডধারীরা। ইন্দিরা ছুটছেন... প্রতিদিন ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা... আজমগড়ের এক প্রান্ত থেকে অন্য কোণায়। সফরসঙ্গীদের সঙ্গেই বসে যাচ্ছেন রাতের খাবার নিয়ে... বাকিরা যা খাচ্ছে, সেটাই বরাদ্দ হচ্ছে তাঁর জন্য। তারপর ডাকবাংলোয় সামান্য বিশ্রাম। বা বলা ভালো, ভোরের আলো ফোটার অপেক্ষা...। অঙ্ক পরিষ্কার ছিল ইন্দিরার... মুসলিম ও হরিজনদের ভোট নিশ্চিত করতে পারলেই আজমগড় তাঁর হবে। ইন্দিরার লড়াই শুধু জনতা পার্টির সঙ্গে ছিল না। প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল তাঁরই দল। কংগ্রেস। কেউ ছেড়ে যায়নি, কিন্তু তাঁকে বাধ্য করেছিল দল ছেড়ে যেতে। নতুন দল গড়তে।
আজ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের লড়াইও কতকটা তেমন। বিজেপি অবশ্যই তাঁর প্রতিপক্ষ। কিন্তু প্রধান নয়। সেই আসন অলঙ্কৃত করে রেখেছেন মমতারই একদা বিশ্বস্ত, এখনকার দলবদলুরা। বাংলায় এখন দলবদলের সিজন। শুভেন্দু অধিকারী এবং তাঁর সঙ্গে লাইন দিয়ে অনেকেই জামার রং বদলেছেন। বিজেপির দাবি, ভোটের আদর্শ আচরণবিধি চালু হলেই সংখ্যাটা হুড়মুড়িয়ে বাড়বে। রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ তো জনা পঞ্চাশেক বিধায়কের দাবিপত্র পেশ করে রেখেছেন। তাই আপাতত তাল ঠোকা চলছে। দরে না পোষালেই আসছে অন্য শিবিরে পালিয়ে যাওয়ার হুমকি। দিলীপবাবুর দাবি যদি ঠিক হয়, তাহলে রাজ্য বিজেপির ভবিষ্যৎ নিয়ে কিন্তু বেশ সংশয় আছে। এমনিতেই ইদানীং গেরুয়া শিবিরের যে সব কর্মসূচি নজরে আসছে, তাতে দিলীপবাবু ছাড়া মার্কামারা বিজেপির নেতা চোখে পড়ে না। মূলত শুভেন্দু অধিকারী, আর দলবদলের প্রত্যাশী তৃণমূলের নেতা-কর্মীতেই বিজেপির মঞ্চ ভরে যাচ্ছে। মানুষের মনে খুব স্বাভাবিকভাবেই এখন চূড়ান্ত ধন্দ, ‘এটা কি বিজেপি? নাকি তৃণমূল।’ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মঞ্চে থাকলে না হয় একটা নিশ্চিন্ত ভাব আসে... এটাই তৃণমূল। না হলে দলের জার্সি বুঝতে পারাটাই সাধারণ মানুষের কাছে এই দলবদলের খেলায় বিপদ হয়ে যাচ্ছে।
দলবদলুদের ঠেলায় রাজ্য বিজেপি এখন কার্যত তৃণমূল শাখা সংগঠনের রূপ নিয়েছে। আরও কয়েকজন বিক্ষুব্ধ-বেসুরো যোগ দিলেই কেল্লাফতে... বিজেপি নাম বদলে তৃণমূল (বি) করে ফেললেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। তখন মানুষ ভাববে... ভোটটা কাকে দেব! তৃণমূলকে? নাকি তৃণমূলের বিজেপি শাখাকে? তার উপর ভাষণ বিভীষিকা তো রয়েইছে। ঠিক এক বছর আগেই কেশিয়াড়ির মঞ্চ থেকে এক নেতা বলছিলেন, ‘আমি যদি নেতাই থেকে লাশ কুড়োতে পারি, তাহলে চাইলে বিজেপিকে পিঁপড়ের মতো পিষেও দিতে পারি’। সেই নেতাই এখন গেরুয়া মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে বলেন, ‘ভোটের আগে রামনবমী করব। নরেন্দ্র মোদি আসবেন। রাজ্যকে বিজেপির হাতে তুলে দিতে হবে। তৃণমূলকে বিদায় করতে হবে।’... বাংলার মানুষ মেলাতে পারছে না। একটা অস্বস্তি কাজ করে। যা দিলীপ ঘোষের বক্তৃতায় হয় না। মানুষ জানে, এই নেতা আদর্শগতভাবে বিজেপি তথা সঙ্ঘের অনুগত। তিনি বিরোধী আসনে বছর বছর বসে আছেন। শাসকের মুণ্ডপাত করছেন। এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ভোটের মরশুমে দলবদলের গামছা গলায় দিয়ে কেউ যদি সেই বুলি আওড়াতে শুরু করেন, তা ঠিক হজম হয় না। বিজেপি যতই আসন্ন পালাবদলের দাবি তুলুক না কেন, সমীকরণটা মোটেও অত সহজ নয়। কারণ, তাঁদের পথের কাঁটা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নামে এক চরিত্র। দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে তিনি আবার একটু বেশিই ভয়ঙ্কর। বিজেপি তাঁকে তেমনই একটা জায়গায় ঠেলার চেষ্টা শুরু করেছে। আর মমতাও পাল্টা হুঙ্কার দিয়েছেন। বিজেপিকে... দলবদলুদেরও। আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনে নন্দীগ্রাম থেকেও লড়বেন তিনি। ভবানীপুরের পাশাপাশি। এটা অবশ্যই মাস্টারস্ট্রোক। কেন? নিন্দুকে তো বলছে, একটি আসনে জয়ের নিশ্চয়তা নেই বলেই তিনি ভবানীপুরের পাশাপাশি নন্দীগ্রামকে বেছে নিয়েছেন। একটায় হেরে গেলে যাতে আর একটা অপশন হাতে থাকে। ঠিক যেমনটা রাহুল গান্ধী গত লোকসভা ভোটে করেছিলেন। সেখানে তিনি ‘পরিবারের’ সম্মান রক্ষার লড়াইয়ে হেরে আমেথি খুইয়েছেন। কংগ্রেসও সার্বিকভাবে বিজেপির অশ্বমেধের দৌড়ে দাঁত ফোটাতে পারেনি। প্রকট বিরোধীরা খোঁচা দিতে শুরু করেছেন, মমতারও একই হাল হবে না তো? তঁারা অবশ্য নরেন্দ্র মোদির প্রথম ইনিংসের কথা ভুলে যাচ্ছেন। ২০১৪ সালে মোদি দু’টি আসনে লড়েছিলেন। ফল? ইতিহাসের পাতায়। রাজনৈতিক বিশ্লেষণ নয়... মানুষ বলছে, মমতার ভবিষ্যৎ রাহুল গান্ধীর মতো হবে না। কারণ, তৃণমূল (বি) দলকে ভোট দেওয়ার থেকে অবশ্যই তৃণমূলে আস্থা রাখা ‘বেটার’। সেখানে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আছেন। মমতা আছেন বলেই দলটার নাম তৃণমূল। বাকি নেতানেত্রীরা তাঁরই জার্সি পরে ভোটের ময়দান কাঁপাতে নামেন। সেই জার্সি খুলে দিলে কী হতে পারে, তা আগামী ভোটের ফলে বোঝা যাবে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও জার্সি বদলেছিলেন, কিন্তু অন্য কোনও দলে যোগ দিয়ে নয়। নিজের দল গড়ে। সেই দল আজও শুধু তাঁকেই সামনে রেখে চলে। ২৯৪টি আসনে তৃণমূল প্রার্থী দিলেও ভোটাররা শুধু একটিই নাম মাথায় রেখে ইভিএমের বোতামে চাপ দেন—মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এরকম একটি ছাতার নীচ থেকে বেরিয়ে পালাবদলের স্বপ্ন দেখা ভালো। কিন্তু ওভার কনফিডেন্স? ধৃষ্টতা। ভোট এবং কামাইয়ের গন্ধে জেলায় জেলায় বহু নেতাই আজ দলবদলু। কিন্তু তাঁদের দেখে কতজন পঞ্চায়েত সমিতির সদস্য বা জেলা কর্মাধ্যক্ষ বিজেপিতে লাইন দিয়েছেন? কতজন সাধারণ কর্মী মনে করছেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আর পারবেন না? সংখ্যাটা বিন্দুতে সিন্ধুর সমতুল। ভোট কিন্তু নেতাদের দিয়ে হয় না! ভোট হয় সংগঠনে, কর্মীদের আপ্রাণ চেষ্টায়। বিশ্বাসে। সেই বিশ্বাস কি দলবদলুরা তৃণমূল থেকে ভাঙিয়ে নিয়ে যেতে পেরেছেন? সেই গ্যারান্টি স্বয়ং নরেন্দ্র মোদিও দিতে পারছেন না। হতে পারে বাংলার ভোট প্রধানমন্ত্রীর কর্তৃত্ব কায়েমের অ্যাসিড টেস্ট। কিন্তু একুশ যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়েরও প্রেস্টিজ ফাইট! কেন্দ্রের সরকারে থেকেই বা বাংলার মানুষের জন্য বিজেপি কী করেছে? দাঁড়িপাল্লার একদিকে কেন্দ্র, আর অন্যদিকে মমতার সরকারকে রাখলে উন্নয়ন এবং বেনিফিশিয়ারির নিরিখেই বিজেপি অনেক নীচে নেমে যাবে। তারপরও হাওয়া চলছে। বিজেপি ক্যাডার ভিত্তিক পার্টি। সঙ্ঘের বিরাট ছাতার তলায় তাদের দিন গুজরান। সেই অনুশাসন, একাগ্রতা এবং লক্ষ্যে স্থির মানসিকতাই এ ধরনের প্রচারে সঙ্ঘ পরিবার তথা বিজেপির পালে হাওয়া দিচ্ছে। লড়াই এবার কঠিন... সে ব্যাপারে সংশয় নেই। কিন্তু মমতাও যে চ্যালেঞ্জটা নিয়ে ফেলেছেন! ঠিক যেভাবে নিয়েছিলেন ইন্দিরা গান্ধী। জয় হয়েছিল মহসিনা কিদোয়াইয়ের। পেরেছিলেন ইন্দিরা। ১৯৮০ সালের লোকসভা নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গড়েছিল ইন্দিরা কংগ্রেস। আর শেষমেশ তাঁর দলকেই ‘আসল’ কংগ্রেসের মান্যতা দিতে বাধ্য হয়েছিল নির্বাচন কমিশন। এই ‘হার না মানা’ লড়াইয়ে আজমগড় ছিল তাঁর ঘুরে দাঁড়ানোর জমি। সেই ১৯৭৮... সেই উপনির্বাচন। নন্দীগ্রামের আন্দোলন বামফ্রন্ট সরকারের বিরুদ্ধে জমি দিয়েছিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। সেই মাটিকেই আরও একবার বেছে নিয়েছেন তিনি। গত ভোটে এই আসনে জিতে আসা তৃণমূল প্রার্থীর নাম? শুভেন্দু অধিকারী। এবারও চ্যালেঞ্জ নিলেন তিনি। লড়বেন তিনি তৃণমূল (বি) দলের হয়ে। মমতার বিরুদ্ধে... নন্দীগ্রাম থেকেই। উপায়ও ছিল না তঁার। জিততে পারলে রাজনৈতিক অস্তিত্ব থাকবে। আর হারলে? ইতিহাসের পাতায়। এই ‘যুদ্ধে’ প্রতি পদে তঁার সঙ্গী হবে একটা অনুভূতি... মাথার উপর একটা ছাতা কিন্তু আজ আর নেই। সেই ছাতার নামটাই যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।