ব্যবসায় বাড়তি বিনিয়োগ প্রত্যাশিত সাফল্য নাও দিতে পারে। কর্মক্ষেত্রে পদোন্নতি শ্বাসকষ্ট ও বক্ষপীড়ায় শারীরিক ক্লেশ। ... বিশদ
লকডাউন ঘোষণার পর শহর, গ্রাম হামলে পড়েছিল মুদির দোকানে। দোকানে দোকানে জমেছিল মেলার ভিড়। দু’দিনেই স্টক ফাঁকা। সকলেই করোনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য তৈরি হয়ে গিয়েছিলেন। মানুষকে ঘরবন্দি করতে পুলিসের সক্রিয়তা নজর কেড়েছিল। কোথাও কোথাও অতিসক্রিয়তার অভিযোগ উঠেছিল ঠিকই। কিন্তু, লকডাউন মানার সবক শেখানোর ক্ষেত্রে পুলিসের সেই ভূমিকাকে বেশিরভাগ মানুষই কুর্নিশ করেছিলেন। দিন দুয়েক পর থেকেই পুলিস ‘মানবিক আচরণ’ শুরু করতেই রাস্তায় রাস্তায় বেয়াদপির বাড়বাড়ন্ত। সরকারের নরম মনোভাবকে কাজে লাগিয়ে শহরের রাস্তায় মজা লুটেরাদের ভিড়। ভাবখানা এমন, মওকা যখন মিলেছে ফায়দা তুলতে হবে পুরো।
অপ্রিয় হলেও সত্যি, কলকাতা শহর, শহরতলি এবং বিভিন্ন জেলার শহরগুলিতেই লকডাউনকে ‘ডাউন’ করার প্রবণতা বেশি। বিশেষ করে এক শ্রেণীর শিক্ষিত মানুষজনের ‘ডোন্ট কেয়ার’ মনোভাব বিপদ বাড়াচ্ছে। এ রাজ্যে মারণ ভাইরাস পা রেখেছিল সেই ‘ডোন্ট কেয়ার’ মনোভাবের হাত ধরেই। সেই ট্র্যাডিশন বজায় রয়েছে। এখনও পর্যন্ত তথাকথিত শিক্ষিত এবং শহুরে মানুষের একাংশই লকডাউন ভাঙছেন প্রতিদিন, প্রতিনিয়ত। এনিয়ে রাজ্যের বহু বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক থেকে শুরু করে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বারবার সতর্ক করছেন। এমনকী, প্রধানমন্ত্রী, মুখ্যমন্ত্রী হাতজোড় করে অপ্রয়োজনে ঘর থেকে বেরতে বারণ করছেন। তবুও কাজ হচ্ছে না। তাই অনেকেই বলছেন, অনুরোধে কাজ না হলে ‘ঢেঁকি গেলানোর’ জন্য যা দরকার, সেটাই করতে হবে। কারণ জনস্বার্থে সবই আইনসিদ্ধ। কুইনাইন যতই তেতো হোক না কেন, প্রয়োজনে জোর করে খাওয়াতে হয়। তাতে মঙ্গল রোগীরই।
বাস, ট্রেন, উড়ান বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ‘ভ্রমণ পিপাসু বাঙালি’র হৃদয় যেন ছটফট করছে। বাইরে যাওয়ার রাস্তা বন্ধ। বন্ধ শহরের মল, সিনেমা হল, রেস্তরাঁ। টিভি সিরিয়ালের আপডেটও বন্ধ হয়ে গিয়েছে। সবেতন লম্বা ছুটির জীবনে যখন বিনোদনের সব রাস্তাই যখন বন্ধ, তখন হাতের কাছে যা পাওয়া যাচ্ছে তা থেকেই ফায়দা লোটার চেষ্টা। এমন শুনশান শহর দেখার সুযোগ হয়তো আসবে আবার ১০০ বছর পর। সুতরাং ওই বোদ্ধাদের বিচারে লকডাউনের ‘লাইভ পিকচার’ দেখার সুযোগ হাতছাড়া করা নেহাতই মূর্খামি। তাই তাঁরা করোনাকে সাধারণ এলেবেলে ফ্লু বলে ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়ে নামছেন রাস্তায়। তারপর দুপুরে খ্যাঁটনের পর লম্বা ঘুম শেষে সান্ধ্য আড্ডায় লকডাউন শহরের বর্ণনা। এইভাবেই সবেতন ছুটির পুরোটা উসুলের চেষ্টা।
শহরের তুলনায় গ্রামের মানুষ কিছুটা হলেও বেশি করে লকডাউন মানছেন। তবে নজির গড়েছে পুরুলিয়ার বলরামপুর। বলরামপুরের গেঁড়ুয়া পঞ্চায়েতের ভাঙ্গিডি গ্রামের ৭জন শ্রমিক গিয়েছিলেন চেন্নাই। লকডাউন ঘোষণা হতেই তাঁরা গ্রামে ফেরেন। গ্রামে ফিরলেও ফিরতে পারেননি বাড়িতে। কারণ ততদিনে ভাঙ্গিডি জেনে গিয়েছে করোনার বিপদ। কেউ মারণ ভাইরাস নিয়ে ঢুকলে গোটা গ্রাম উজাড় হয়ে যাবে... উপলব্ধি করেছেন গ্রামবাসী। তাই ৭জনের ফেরার খবর পেতেই গ্রামের ও পরিবারের লোকজন একযোগে সিদ্ধান্ত নেন, সরকারি নির্দেশ মেনে ১৪দিন আলাদা থাকতে হবে। বাড়িতে ঘরের অভাব। তাই হোম কোয়ারেন্টাইনের সুযোগ নেই। বিকল্প পথ, গাছে থাকবেন তাঁরা। গ্রামে ঢোকার মুখে আমগাছে খাটিয়া বেঁধে অস্থায়ী গৃহ নির্মাণ। গ্রামবাসীদের কথা অমান্য করেননি চেন্নাই ফেরত সুনীল সিং লায়া, বিজয় সিং লায়া ও তাঁর সঙ্গীরা। তাঁদের সঙ্গে থাকা থালা, বাটিতেই খাবার দিয়ে গিয়েছেন বাড়ির লোকজন। সেই খাবার খেয়ে রাতভর গাছে কাটিয়ে ‘সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিং’ তাঁরা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছেন। পরিবারকে, গ্রামকে, গ্রামের মানুষকে সুরক্ষিত রাখতে তাঁদের আন্তরিক প্রয়াস লকডাউন ভঙ্গকারী ‘শহুরে পণ্ডিত’দের গালে কষিয়ে থাপ্পড় মারার জন্য যথেষ্ট। কিন্তু, তাতেও শিক্ষা হচ্ছে না।
এ প্রসঙ্গে পুরুলিয়ার একটি আদিবাসী গ্রামের কথা উল্লেখ করা খুবই প্রাসঙ্গিক। অযোধ্যা পাহাড়ের ভুঁইঘাড়া গ্রাম। সম্পূর্ণ আদিবাসী গ্রাম। সরকার থেকে বিনা পয়সায় রেশন চালুর আগে পর্যন্ত তাঁদের দিন কেটেছে কার্যত নুনে ভাতে। তবুও গ্রামের সকলে লকডাউন মেনে বাড়িতেই থেকেছেন। গ্রামের যুবক ধীরেন চঁড়ে বলেন, করোনার মতো মারাত্মক ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য সরকার লকডাউন ঘোষণা করতেই আমরা গ্রামের মোড়লকে নিয়ে মিটিং করি। সিদ্ধান্ত নিই, অসুস্থতা ছাড়া কেউ গ্রাম থেকে বেরব না। গ্রামে ঢোকার রাস্তা বাঁশ দিয়ে আটকে দিয়েছি। আমরা সবাইকে বোঝাতে পেরেছি, একবার গ্রামে মারণ ভাইরাস ঢুকলে কেউ রক্ষা পাব না। পেটে বিদ্যে থাক বা না থাক, গ্রামের সবাই বিপদটা বুঝেছে।
তবে, সব গ্রামকে এক ছাঁচে ফেললে ভুল হবে। পশ্চিম মেদিনীপুরের দাসপুরে আবার অন্য ছবি। লকডাউন ঘোষণা হতেই দাসপুরের নিজামপুরের কয়েকজন যুবক বাড়ি ফিরলেন। তাঁদের মধ্যে এক যুবক অসুস্থ হতে ভর্তি হলেন হাসপাতালে। নমুনা পরীক্ষায় দেখা গেল, তিনি করোনায় আক্রান্ত। খবরটা রটতেই ভিড়ে গম গম করা হাট আধ ঘণ্টার মধ্যে ফাঁকা। নেমে এল শ্মশানের নিস্তব্ধতা। কিন্তু, ২৪ ঘণ্টা কাটতে না কাটতেই মাংসের দোকানে লম্বা লাইন, বিকেলে খেলার মাঠে জোরদার আড্ডা।
এক স্বাস্থ্যকর্মী মানুষকে সতর্ক করার জন্য একটি পোস্ট করে জানালেন, ‘নিজামপুরের করোনা পজিটিভ ছেলেটি যে ট্রেনের কামরায় চেপে মুম্বই থেকে বাড়ি ফিরেছিল, জোতঘনশ্যাম গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকার চারজন ছেলেও সেই কামরাতেই ২২ মার্চ বাড়ি ফিরেছিল।’ সামাজিক দায়িত্ববোধের তাড়না থেকেই তিনি এই পোস্টটি করেছিলেন।
তাঁর পোস্টটিতে কোনও নাম ছিল না। কিন্তু, সেই ঠাকুর ঘরে কে, আমি তো কলা খাইনি! ওই চার যুবকের একটি পরিবার থেকে স্বাস্থ্যকর্মীকে ফোনে রীতিমতো হুমকি। বক্তব্য, পোস্টটি তাঁদের সম্মানহানি ঘটিয়েছে। হুমকির ভাষা এতটাই কর্কশ ছিল যে ওই স্বাস্থ্যকর্মী ফের পোস্ট করে ‘ভুল স্বীকার’ করতে বাধ্য হন। তিনি লিখেছেন, খুব অসহায় বোধ করছি। যদি ভুলবশত কারো সম্মানহানি করে থাকি, তবে নিঃশর্ত ক্ষমাপ্রার্থী আমি।
নিজামপুরের করোনায় আক্রান্ত যুবকের বাবার নমুনাও পজিটিভ এসেছে। তাঁর মা এবং স্ত্রী এখন আইসোলেশন ওয়ার্ডে। আরও জানা গিয়েছে, ওই যুবকের বাবা হাটে শসা বিক্রি করতে গিয়েছিলেন। সুতরাং তিনি আর কউকে সংক্রামিত করেছেন কি না এখনই বোঝা যাচ্ছে না। এমনকী, ওই যুবকের সঙ্গে মুম্বই থেকে আসা সঙ্গীরা এখনও নিজেদের আড়াল করতে ব্যস্ত। কতদিন গোপন করতে পারবেন, তা ঈশ্বরই জানেন।
একটা কথা মাথায় রাখা দরকার, করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার পিছনে কোনও অপরাধ নেই। এটা এইডস নয়, যে লোকজন জানতে পারলেই নষ্ট হবে সামাজিক সম্মান। বরং ভিন রাজ্য বা দেশ থেকে আসা লোকজন নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখলে তিনি যেমন বাঁচবেন, বাঁচাতে পারবেন তাঁর পরিবারকেও। নিজামপুরের ওই যুবক যদি প্রথমেই নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলতেন, তাহলে গোটা পরিবারকে এভাবে বিপদে পড়তে হতো না।
এভাবে সর্বত্রই ‘শাক দিয়ে মাছ ঢাকার’ চেষ্টার ফল অত্যন্ত মারাত্মক। মাছের আঁশটে গন্ধ ছড়াবেই। আজ না হয় দু’দিন পর। আর এই চেষ্টা জারি থাকলে বুঝতে হবে, বিপদ বেশি দূরে নেই। হাজির ঘরের দোরগোড়ায়। আমরা নিজেদের অজান্তেই যুক্ত হয়ে যাচ্ছি এক আত্মঘাতী খেলায়। সেখান থেকে বাঁচানোর ক্ষমতা কোনও মন্দির, মসজিদ বা গির্জার নেই। এমনকী, চিকিৎসক, নার্সদেরও নেই। কারণ তাঁরাও সংখ্যায় বড়ই কম।