ব্যবসায় বাড়তি বিনিয়োগ প্রত্যাশিত সাফল্য নাও দিতে পারে। কর্মক্ষেত্রে পদোন্নতি শ্বাসকষ্ট ও বক্ষপীড়ায় শারীরিক ক্লেশ। ... বিশদ
দিল্লি সরকারের মতে, এ ধরনের ক্লাস বাড়াবে আত্ম-সচেতনতা, জাগ্রত করবে উদ্দীপনা, তৈরি করবে ভালো মানসিক স্বাস্থ্য ও চরিত্র। সেইসঙ্গে শিক্ষার্থীদের মধ্যে হ্রাস করবে উদ্বেগ, হতাশা এবং অসহিষ্ণুতা। বাড়াবে সহনশীলতা। তাদের তৈরি করবে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে। কিন্তু, এসবই কি সুখের চাবিকাঠি? ‘যাও সুখের সন্ধানে যাও’ ডাক তো দেওয়া হল, তবু সংশয় থেকেই যায়-- সুখ কারে কয়।
‘সুখ’ বলতে প্রথমেই মনে পরে আমেরিকা দেশটা প্রতিষ্ঠার ভিত্তির কথা। ১৭৭৬ সালে আমেরিকার স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের খসড়া প্রস্তুত করেন টমাস জেফারসন। তাতে কিন্তু প্রত্যেক নাগরিককে দেওয়া হয়েছে ‘পারসুট অব হ্যাপিনেস’ বা সুখের সন্ধানে ছোটার অধিকার। রাষ্ট্রের দায়িত্ব তাকে রক্ষা করে, এবং অবশ্যই নাগরিকদের এই সুখ-সাধনাকে সযত্নে লালন করা।
আজকের দুনিয়া ‘সুখ’-কে যথেষ্ট গুরুত্ব দেয় বইকি। অবশ্য ‘সুখ’ বলতে কে যে কী বোঝে, সে বিষয়ে বিস্তর অস্পষ্টতা থেকেই যায়। সুখ পরিমাপের ধারণাটা এসেছে আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভুটান থেকে। ১৯৭২ সালে বোম্বে এয়ারপোর্টে ‘ফিনান্সিয়াল টাইমস’ পত্রিকার এক ব্রিটিশ সাংবাদিককে ইন্টারভিউ দিতে গিয়ে ভুটানের তৎকালীন রাজা জিগমে সিংহে ওয়াংচুক বলেন, “গ্রস ন্যাশনাল প্রোডাক্টের থেকে গ্রস ন্যাশনাল হ্যাপিনেস অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।” ভুটান তাদের গ্রস ন্যাশনাল হ্যাপিনেসের সমীক্ষা শুরু করে অবশ্য অনেক পরে। ২০০৮ সালে। কিন্তু এই ধারণাটাকে লুফে নেয় গোট বিশ্ব। সুখ মাপার প্রচেষ্টা শুরু হয় দুনিয়ার নানা প্রান্তে। যেমন কানাডার ভিক্টোরিয়ায়, আমেরিকার সিয়াটেলে, ব্রাজিলের সাও পাওলোতে। এমনকী ২০১২ থেকে পৃথিবীর নানা দেশের সুখ মেপে এক ক্রমতালিকা বানানো শুরু করে রাষ্ট্রসঙ্ঘ, তাদের ‘ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস রিপোর্ট’-এর মধ্য দিয়ে। সুখ বৃদ্ধির প্রচেষ্টায় সুখ দফতরের মন্ত্রীও নিয়োগ করেছে ভেনিজুয়েলা, সংযুক্ত আরব আমীরশাহির মত দেশ।
সুখ তবে কীসে? সুখের সন্ধানে আমাদের নিরন্তর এষণাও কিন্তু অব্যাহত। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানীরা গবেষণা করে চলেন। দাবি করেন, থিয়েটার দেখলে মন ভালো হয়, বন্ধু কিংবা পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে সময় কাটালে মনে সুখ আসে, কিংবা বই পড়লেও সুখী হওয়া যায়। জনহিতকর উদ্যোগে যুক্ত থাকাটাও নাকি আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে সুখী করে তোলে মানুষকে। কিন্তু দুনিয়ার সব হ্যাপি প্রিন্সের দল কি ‘হ্যাপি’ হতে পারছে এইভাবে? সুখের সন্ধানে শতাব্দীর তিন-চতুর্থাংশের বেশি ধরে গবেষণা হয়েছে হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয়ে। সুখী থাকার সব থেকে ভালো উপায় নাকি সবার সাথে ভালো সম্পর্ক রাখা। একটা সুখী ফ্যামিলিই নাকি সুখী থাকার প্রথম এবং মুখ্য ধাপ। মনস্তত্ত্ববিদ মার্টিন সেলিগ্যাম আবার সুখী থাকার পাঁচটা উপায় বাতলেছেন। খাওয়াদাওয়া, জীবনযাত্রায় নিয়ন্ত্রণ, পারিবারিক বন্ধন, ধর্ম, বিশ্বাস সবই জায়গা পেয়েছে সেই তালিকায়।
দর্শনশাস্ত্রে ‘হেডোনিজম’ বলে একটা ধারণা আছে। সুখের সন্ধান বা পারস্যুট অব হ্যাপিনেসটাই সেখানে জীবনের উদ্দেশ্য। তবে ‘হেডোনিজম’ কিন্তু ভাববাদী সুখ নিয়ে মাথা ঘামায় না বড় একটা, বস্তুবাদী সুখই সেখানে মুখ্য। কিন্তু কেমন বস্তু এই ‘সুখ’? একে কি সত্যিই সংজ্ঞায়িত করা যায়?
মাস্টারকার্ডের একটা বিজ্ঞাপন ছিল, ‘দেয়ার ইজ সামথিং দ্যাট মানি ক্যানট বাই; ফর এভরিথিং এলস, দেয়ার ইজ মাস্টারকার্ড’। আচ্ছা, ওই ‘এভরিথিং এলস’-টাই কি সুখ? নাকি টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না সেই অমৃতটাই সুখের রেসিপি? কে দেবে এর উত্তর? সুকুমার রায়ের ‘রাজার অসুখ’-এর রাজা মশায়ের অসুখ তো সারে না টাকা-পয়সা আর ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও। ওদিকে কপর্দকশূন্য চালচুলোহীন ফকিরের গায়ে জামা নেই, শোবার বিছানা নাই। আর তার সুখেরও শেষ নেই। তা বলে দারিদ্র্যই কি সুখ? হাজার হাজার দরিদ্র কৃষক অর্থাভাবে আত্মহত্যা করে প্রতি বছর। অত্যন্ত ধনী পরিবারের সন্তানের আত্মহত্যার নজিরেরও অভাব নেই। কলকাতার অভিজাত ধনী পরিবারের গৃহবধূর আত্মহত্যার অভিঘাত তো দেড়শ’ বছর ধরে তাড়িয়ে চলেছে বাঙালিকে। তাই সুখের সঙ্গে সম্পদের সত্যিই কোনও সম্পর্ক আছে?
আমরা ভারতীয়রা কতটা সুখী? রাষ্ট্রসঙ্ঘের সূচকের নিরিখে আমরা পিছিয়ে বেশ। একেবারে পিছনের দিকে। হয়তো সত্যিই তাই, হয়তো নয়। আসলে এই সূচক কতটা নিখুঁত, কতটা ‘সুখ’ মাপা গেল এই সূচক দিয়ে, সে নিয়ে আমার বিস্তর সন্দেহ।
সুখের সন্ধানও কি আর আজকের নাকি? মহাভারতের বনপর্বে দেখি যক্ষ প্রশ্ন করছেন প্রাজ্ঞ যুধিষ্ঠিরকে, কী ত্যাগ করলে ‘সুখ’ পাওয়া যায়? যুধিষ্ঠির উত্তর দিচ্ছেন, ‘অর্থলিপ্সা’। যক্ষ তারপর আবার জিজ্ঞেস করছেন, সুখী কে? যুধিষ্ঠির উত্তর দিয়েছেন, যার ঋণ নেই সে-ই সুখী। দিনান্তে যিনি পরিবারের সদস্যদের নিয়ে শাকান্ন ভোজন করেন, তিনিই সুখী।
যাই হোক, এত আয়োজন, এত পরিকল্পনা, এত গবেষণা করেও সুখকে কি আদপে ধরা গেল? যুধিষ্ঠির থেকে হার্ভার্ডের গবেষণা যাই বলুক না কেন, আড়াই হাজার বছর আগে হিমালয়ের এক ছোট্ট পাহাড়ি রাজ্যের ‘অসুখী’ রাজকুমার স্ত্রী, পুত্র, পরিবার, রাজ্য, জাগতিক সমস্ত আরাম এবং নিশ্চয়তা ছেড়ে পারি দিয়েছিল কোন সে ‘সুখ’-এর সন্ধানে? সেই আলোকবর্ত্তিকার কোনও হদিশ কিন্তু রাষ্ট্রসঙ্ঘের হ্যাপিনেস ইনডেক্স কিংবা ভুটানের গ্রস ন্যাশনাল হ্যাপিনেস মাপার মাল-মসলার মধ্যে একেবারেই নেই। সুজাতার পরমান্ন সিদ্ধার্থকে করে তোলে বুদ্ধ, আর সেই সঙ্গে জগতকে দিশা দেখাতে শুরু হয় অমিতাভর এক অনন্য জীবন। সংসার ত্যাগ করেন সিদ্ধার্থের প্রায় সমসাময়িক বর্ধমান নামের আর এক রাজকুমারও। যদিও মহাবীর জৈনের সেই যাত্রাপথের দর্শন ছিল খানিকটা ভিন্ন।
আবার সবাই যে ‘সুখ’ খুঁজে ফেরে বা ফিরবে, তেমনটাও হয়তো নয়। রবীন্দ্রনাথের দুর্যোধন যেমন সুখকে ঠেলে ফেলে ছুটেছিল জয়ের পিছনে। বাস্তবে আমরা অধিকাংশ মানুষ হয়তো তাইই করি। কেউ না বুঝে, কেউ হয়তো বা বুঝেও করে চলি আত্মপ্রবঞ্চনা। অধিকাংশ ক্ষেত্রে অবশ্য ‘জয়’-কেই মনে করি ‘সুখ’। জার্মান দার্শনিক ফ্রেডরিখ নিৎসেও কিন্তু মনে করেন নি, সুখই জীবনের অন্তিম লক্ষ্য।
সব আলোচনার মধ্যেও প্রশ্ন তাই থেকেই যাবে, ‘সুখ’-এর অনুশীলন কি করানো সম্ভব? স্কুলের চৌহদ্দিতে? রীতিমত ক্লাস করিয়ে? ‘সুখ’ কি একান্তই ব্যক্তিগত কোনও উপলব্ধি নয়? তাই দিল্লির স্কুলের ছোট ছোট বাচ্চাদের ৪৫ মিনিটের ক্লাসের মাধ্যমে আখেরে যা হচ্ছে তা হয়তো তাদের রিল্যাক্স করতে শেখানো, মানসিক চাপ কমানোর অনুশীলন। ছাত্রদের পক্ষে, তাদের ভবিষ্যৎ জীবনের দিশায় এগুলিও কিন্তু খুবই গুরুত্বপূর্ণ, নিঃসন্দেহে। কিন্তু এসব কি আদপেই ‘সুখ’?
সুখের সন্ধান তাই চলতেই থাকবে।
ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট, কলকাতার রাশিবিজ্ঞানের অধ্যাপক। মতামত ব্যক্তিগত