ব্যবসাসূত্রে উপার্জন বৃদ্ধি। বিদ্যায় মানসিক চঞ্চলতা বাধার কারণ হতে পারে। গুরুজনদের শরীর-স্বাস্থ্য নিয়ে সচেতন থাকা ... বিশদ
দেশের কৃষিক্ষেত্রের ভোল বদলে ফেলা যায় এই টাকায়। ভারতের মতো কৃষি প্রধান দেশে ২০ হাজারেরও বেশি হেক্টর জমিতে সেচের কাজ করা যায়। প্রায় ১০০টি ছোট সেচ প্রকল্প মেরামত, রক্ষণাবেক্ষণ করা যায় এই টাকায়। এই টাকা খরচ করে ৪২৫টি ছোট বাঁধ তৈরি করা যায়। সেচের জল পেলে কৃষকদের আর হাহাকার করতে হতো না। ঋণের বোঝা ঘাড়ে নিয়ে আত্মহত্যাও করতে হতো না।
ক্ষুধা সূচকে ভারতের স্থান প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশ, নেপাল, ইরাকের থেকেও নীচে। অপুষ্টিতে ভুগছে ভবিষ্যত প্রজন্ম। এ দেশে খালি পেটে রোজ রাতে শুতে যাওয়া শিশুদের সংখ্যাটা ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। বাড়ছে অপুষ্টি। স্রেফ খেতে না পেয়ে কচি কচি মুখগুলির সংখ্যা বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। অথচ ওই ১৬০০ কোটি টাকায় দেশের পাঁচ হাজারের বেশি শিশুর দায়িত্ব নেওয়া যেত। ৭২৫টি গ্রামের উন্নতি করা যেত।
ওই টাকায় ঢেলে সাজানো যেত শিক্ষাক্ষেত্র। অন্তত একটি নতুন আইআইটি ক্যাম্পাস তৈরি করা যেত। একটা আইআইটি তৈরির খরচ প্রায় ১১৬৭ কোটি টাকা। তৈরি করা যেত একটি অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অব মেডিক্যাল সায়েন্সের (এইমস) ক্যাম্পাস। একটি এইমস তৈরির খরচ প্রায় ১১০৩ কোটি টাকা। তিনটি নতুন আইআইএম ক্যাম্পাস তৈরি করা যেত এই টাকায়। একটি আইআইএম ক্যাম্পাস তৈরির খরচ প্রায় ৫৩৯ কোটি টাকা।
অপ্রচলিত শক্তির ক্ষেত্রে আনা যেত জোয়ার। ৭৫ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন তিনটি নতুন সৌর বিদ্যুৎ প্রকল্প তৈরি করা যেত এই টাকা দিয়ে। যেখানে একটি তৈরিতে খরচ প্রায় ৫২৮ কোটি টাকা। অভাবনীয় উন্নতি করা যেত মহাকাশ গবেষণায়। অন্তত তিনটি মঙ্গল অভিযানের খরচের সমতুল ওই ১৬০০ কোটি টাকা। একটি অভিযানের খরচ প্রায় ৪৫০ কোটি টাকা। ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ইসরোর অধীনে দু’টি চন্দ্রাভিযানও করা যেত টাকায়। একটি অভিযানের খরচ মোটামুটি ৮০০ কোটি টাকা।
অথচ, অসমে এনআরসি আপডেটের জন্য, গত চার বছর ধরে সুপ্রিম কোর্টের নজরদারিতে ১৬০০ কোটি টাকা খরচ করে ফেলা হয়েছে। নিট ফল? শূন্য। অসমে আপডেটেড এনআরসি পাশ হয়েছিল গত বছর ৩১ আগস্ট। তাতে ১৯ লক্ষ মানুষ রাষ্ট্রহীন হয়েছেন। যার মধ্যে প্রায় ১২ লক্ষই হিন্দু। তাঁদের অধিকাংশই বাঙালি। এ ছাড়াও আছেন বহু গোর্খা, হিন্দিভাষী ও অসমের স্থানীয় মানুষ। অভিযোগ উঠেছে, অসমের আদি মুসলিম সম্প্রদায় ‘খিলঞ্জিয়া’কে নাগরিকপঞ্জি থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। খিলঞ্জিয়া মুসলিম সম্প্রদায় মোগল আমল থেকে অসমে বসবাস করে আসছে। তাদের বলা হয় অসমের ভূমিপুত্র। এবার তাঁরা রেজিস্টার থেকে বাদ যাওয়ার পর আবেদন করতে পারবেন, এবং তাতেও অসফল হলে ডিটেনশন ক্যাম্প তাঁদের ভবিতব্য। এনআরসির সীমাবদ্ধতা কতদূর, অসম তা স্পষ্ট করে দিয়েছে। এনআরসি এবং তার হাত ধরে আসা নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল পুরনো কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে সেই পশ্চাৎগতির কথা। অতীতে যা সমাজের একাংশকে অন্যদের বিরুদ্ধে লড়িয়ে দিয়েছিল। এনআরসির রসায়নাগার অসম অন্তত সেই ইঙ্গিত দিয়েছে। বাকি গোটা দেশ তা এখনও টেরই পায়নি।
আর শুধুমাত্র অসমে এনআরসি প্রক্রিয়া করতে গিয়েই সরকার খরচ করে ফেলেছে ১৬০০ কোটি টাকা! এত টাকা কীভাবে খরচ হল সেটা খতিয়ে দেখতে দাবি উঠেছে সিবিআই তদন্তের। শুধু তাই-ই নয়, এই এনআরসি করতে বিপুল আর্থিক দুর্নীতি হয়েছে, এই অভিযোগ তুলেছেন অসমের বিজেপি নেতা তথা অর্থমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা। সেই দুর্নীতির কথা ধরা পড়েছে ক্যাগের প্রতিবেদনেও। এনআরসির মুখ্য সমন্বয়কারী প্রতীক হাজেলাকে মধ্যপ্রদেশে বদলি করে দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। মুখ লুকোনোর জায়গা পাচ্ছে না বিজেপি। ভারতের সব রাজ্যে নাগরিকপঞ্জি তৈরির দাবি জানিয়ে তারা এখন বলছে, অসমের চূড়ান্ত নাগরিক তালিকা ভুলে ভরা নথি ছাড়া আর কিছু নয়। কারণ, হিন্দুস্তানে কোনও হিন্দু কখনও ‘বিদেশি’ হতে পারে না। অসমের বিজেপির নেতারা বলতে শুরু করেছেন, এনআরসির নামে রাজ্যে যা হয়েছে, তা পর্বতের মূষিক প্রসব। শিলচর বিধানসভা কেন্দ্রের বিজেপির বিধায়ক দিলীপ কুমার পাল বলেছেন, ভুলে ভরা এই তালিকা বিজেপি কিছুতেই মেনে নেবে না। তালিকায় নাম নেই বিজেপি বিধায়ক রামকান্ত দেউড়ির। সংবাদমাধ্যমকে তিনি বলেছিলেন, ‘জন্মসূত্রে আমি ভারতীয়। কয়েক পুরুষের বসবাস। আমি বৈধ ভূমিপুত্র। তাই কোনও আবেদনই করব না।’ তাহলে এবার কী হবে? আবার এনআরসি? আবার বিপুল টাকা খরচ? যদি ধরেও নেওয়া যায় যে বিজেপি আসলে দেশের মঙ্গল করতে চাইছে, সেই মঙ্গলের খরচ আপাতত বাজারের সব্জির মতই চড়া।
২০১১ সালের জনগণনা অনুসারে অসমের মোট জনসংখ্যা ৩ কোটি ১১ লাখের কিছু বেশি। এই জনসংখ্যাকে এনআরসির প্রক্রিয়ায় আনতে খরচ হয়েছে ১৬০০ কোটি টাকা। পশ্চিমবঙ্গের মোট জনসংখ্যা ৯ কোটি ১২ লাখের কিছু বেশি। ভাবুন একবার, এই জনসংখ্যাকে এনআরসির প্রক্রিয়ায় আনতে সরকারের কোষাগার কতটা ফাঁকা হবে। আর গোটা দেশের কথা তো ছেড়েই দিলাম। এই এনআরসি প্রক্রিয়ায় নাম তোলাতে সাধারণ মানুষের খসেছে মোটা অঙ্কের গাঁটের কড়ি। সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, এই বাদ পড়া মানুষের পকেট থেকে মোট ৭,৮৩৬ কোটি টাকা খরচ হয়েছে শুধুমাত্র নাম তোলার প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যেতে। মানবাধিকার নিয়ে কাজ করা গোষ্ঠী রাইটস অ্যান্ড রিস্কস অ্যানালিসিস (আরআরএজি) গ্রুপ সম্প্রতি প্রকাশ করেছে এমনই একটি সমীক্ষা রিপোর্ট। ‘The Economic Cost of Draft NRC: Poor Made Extremely Poor’ শীর্ষক রিপোর্টের জন্য সমীক্ষা চালানো হয়েছে অসমের বাকসা, গোয়ালপাড়া এবং কামরূপ জেলায়। ৬২ জনের এনআরসিতে নাম তোলার জন্য খরচ হওয়া টাকার অঙ্কের হিসেব নেওয়া হয়েছে। রিপোর্ট বলছে, ওই ৬২ জনের মোট খরচ হয়েছে ১১,৮২,০০০ টাকা, অর্থাৎ মাথা পিছু ১৯,০৬৫ টাকা। কিন্তু গরিব মানুষ আকাশ ছোঁয়া সেই খরচ জোগাবেন কীভাবে?
দেশের মাত্র একটি রাজ্যে বিপুল টাকা এমন সময় খরচ করা হয়েছে, যখন খোদ কেন্দ্রীয় সরকার বলছে কোষাগারের অবস্থা খারাপ। সার্বিক ভাবে অর্থনীতির ঝিমিয়ে পড়ার কারণ খুঁজতে অর্থ মন্ত্রকে আলোচনা চলছে। প্রতিদিন আরও বিবর্ণ হচ্ছে ভারতীয় অর্থনীতি! মন্দার কারণে রাজস্ব আদায় কম হওয়ায় পরিকাঠামো ও উন্নয়নমূলক প্রকল্পে খরচের ক্ষমতা কমছে সরকারের। সুদ কমানো, কর কমানোর মতো কোনও দাওয়াইয়েই চাঙ্গা করা যাচ্ছে না দেশের অর্থনীতিকে। অর্থনীতির কাহিল হওয়ার জন্য দায়ী করা হচ্ছে কৃষিক্ষেত্রের মন্থর উৎপাদনকেও। বিশ্বব্যাঙ্কের দাবি, বৃদ্ধির গতি শ্লথ যথেষ্ট ঋণের অভাবে ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড কমায় এবং চাহিদা-কেনাকাটা ঝিমিয়ে পড়ায়। কেন্দ্রীয় সরকারের পরিসংখ্যান মন্ত্রকের ইঙ্গিত, কারখানার উৎপাদন, লগ্নি বা নির্মাণ যন্ত্রাংশে পুঁজির ক্ষেত্রেও ছবিটা বেশ খারাপ। সরকার যতই ‘কিছু হয়নি’ ভাব দেখাক, সম্প্রতি খোদ মোদি সরকারের পরিসংখ্যান মন্ত্রক জানিয়েছিল, চলতি অর্থবর্ষে বৃদ্ধির হার ৫ শতাংশে আটকে থাকবে।
শেষ পর্যন্ত সত্যিই এই ৫ শতাংশের ‘গর্তে’ পা ঢুকলে, ২০০৮ সালে বিশ্বজুড়ে আর্থিক মন্দার পরে ১১ বছরের তলানিতে পিছলে যাবে দেশের বৃদ্ধির হার। মার্কিন অর্থনীতিবিদ নুরিয়েল রুবিনির মন্তব্য, ‘‘ভারত সরকার ঝিমিয়ে পড়া অর্থনীতির তুলনায় মতাদর্শগত বিষয়গুলিকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। তবে অর্থনীতি শ্লথ হলে ভারতের জনপ্রিয়তা হারাতে হতে পারে।’’ প্রশ্ন ওঠে, অর্থনীতি বেহাল, তবুও নতুন নাগরিকত্ব আইন নিয়ে মাতামাতি কেন?
অনেকেই বলছেন দেশের অর্থনীতির মূল সমস্যা থেকে দৃষ্টি অন্য দিকে ঘোরানোর জন্যই নাকি
তড়িঘড়ি জাতীয় নাগরিকত্ব আইনের প্রবর্তন। এই ধরনের স্পর্ধা ভারতের জনগণ কখনও দেখেনি। সোশ্যাল মিডিয়ায় বিজেপি মন্ত্রী লিখছেন, তোমাকে আগে ফেরত পাঠাই তোমার দেশে, তার পর তোমার কথার জবাব দেব...। কর্ণাটকের বেল্লারির বিজেপি বিধায়ক সোমশেখর রেড্ডির প্রকাশ্যে বলছেন, ‘খুব সাবধান, আমরা দেশের মোট জনসংখ্যার ৮০ শতাংশ। তোমরা মাত্র ১৫ শতাংশ। তোমরা সংখ্যালঘু। এ দেশে থাকতে গেলে বুঝে শুনে পা ফেলতে হবে।’ কলাকাতায় এসে বিজেপির সর্বভারতীয় কার্যকরী সভাপতি জগৎপ্রকাশ নাড্ডা বলে গিয়েছেন, পিকচার অভি বাকি হ্যায়। সিএএ, এনআরসির মধ্যে ‘জুজু’ খুঁজছে গোটা দেশ, গোটা বাংলা।
একদিন হয়তো, মজা করে নিজেকে ‘বরিশালের পোলা’ বলতেও ভয় হবে!