পড়শির ঈর্ষায় অযথা হয়রানি। সন্তানের বিদ্যা নিয়ে চিন্তা। মামলা-মোকদ্দমা এড়িয়ে চলা প্রয়োজন। প্রেমে বাধা।প্রতিকার: একটি ... বিশদ
শতবর্ষাধিক পূর্বে ১৯১৪ সালে আশুতোষ মুখোপাধ্যায় বিজ্ঞান কংগ্রেসের সূচনা করেছিলেন। সেই সময় সি ভি রমণের মত মহান বৈজ্ঞানিকেরা উপস্থিত থাকতেন এই সম্মেলনে। তার তুলনায় আজকের দিনে সম্মেলনের মান দেখে কিন্তু সব হারানোর ব্যথা পাওয়ার কোনও কারণ নেই। বর্তমানেও এই ধরনের বিজ্ঞানমেলাতে নোবেলজয়ীরা এসে কথা বলে যান। এই যে বিখ্যাত বিজ্ঞানীদের আলাপচারিতা, তা অনেকটা প্রৌঢ় মারাদোনা যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে পায়ের ওপর বল নাচানোর মত। আমরা সেটা দেখি এবং মুগ্ধ হই। বাস্তবে বিজ্ঞান গবেষণা ভীষণভাবেই একটি জটিল বিষয় এবং সেই বিষয়ে যাঁরা সরাসরি কাজ করেন তাঁরা ছাড়া বিষয়টির মর্মোদ্ধার অন্যদের পক্ষে অসম্ভব। বিজ্ঞানের গভীর তত্ত্ব নিয়ে অনেকসময়ই সংবাদমাধ্যমে জনসাধারণের বোধগম্য গল্প লেখা হয়। কিন্তু সেটা পড়ে যদি কেউ ভাবেন যে তিনি বিষয়টার বিশেষজ্ঞ হয়ে গেলেন অথবা বুঝলেন অনেকটা, তাহলে মহা মুশকিল। জাতীয় বিজ্ঞান সম্মেলনে নোবেলজয়ী বিশ্ববন্দিত বিজ্ঞানীদের কাজের বর্ণনা তাই পপুলার সায়েন্স-এর প্রচারের থেকে বেশি কিছু নয়। যাঁরা আন্তর্জাতিক মানের বিজ্ঞান গবেষণা করেন, তাঁরা প্রত্যেকেই জানেন যে ঠিক কোন কোন সম্মেলনে তাঁদের সমমানের বিজ্ঞানীরা আসেন। তাঁরা সঠিকভাবে অবহিত যে কোন গবেষণা পত্রিকাতে গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারের বর্ণনা ছাপাতে হয় অথবা কোন সম্মেলনে জানাতে হয় নতুন কিছু পাওয়া। ভারতের জাতীয় বিজ্ঞান সম্মেলন মোটেও তেমন কিছু গুরুত্বপূর্ণ মঞ্চ নয়। সুতরাং সেই হিসেবে এই সম্মেলনে পেশ করা গবেষণাপত্রগুলোর নিম্নমান অথবা অদ্ভুতুড়ে দাবি নিয়ে হইচই করা বৃথা।
তবে বিজ্ঞানেরও রাজনীতি আছে। আর জাতীয় বিজ্ঞান সম্মেলনে বিজ্ঞান যখন কম, তখন তাতে রাজনীতির মাত্রা বেশি থাকবেই। বিজ্ঞানী মানেই সততার প্রতিমূর্তি নন। গ্যালিলিওর ছবি ছুঁয়ে তাঁরা কেউ হলফনামা পেশ করেন নি যে কখনও মিথ্যে কথা আওড়াবেন না। সবাই জানে যে বিশ্বজুড়ে রাজনৈতিক নেতারা শিক্ষালয়ের সর্বোচ্চ আধিকারিকদের নিয়োগ করেন। ফলে দক্ষ বিজ্ঞানীকে অনেক সময়েই তুলনায় অনেক কম শিক্ষাগত যোগ্যতাসম্পন্ন রাস্ট্রনেতার গুণাগুণ গাইতেই হয়। সেই হিসেবে ‘মার্ক্সবাদ সর্বশক্তিমান, কারণ এটাই সত্য’, ‘সীতাকে উড়িয়ে নিয়ে যাওয়া রাবণরথ প্রথম বোয়িং বিমান’, ‘গান্ধী পরিবার আমাদের দেশের উন্নতির একমাত্র কারণ’, ‘রাস্তায় ধোঁয়া কামান দাগলেই ডেঙ্গুর মশা নিধন হয়’ এরকম গল্প বিজ্ঞান সম্মেলনে ভুল প্রমাণ সহযোগে পেশ করাটাই ক্ষমতাসীন অথবা ক্ষমতালোভী বিজ্ঞানীদের দস্তুর। একথা অজানা নয় যে ফলিত গবেষণায় বিভিন্ন উদ্ভট পর্যবেক্ষণের ফল সঠিকভাবে ন্যায্যতা সহকারে লেখা হয় না। সেক্ষেত্রে পুকুরের জলে হাঁস সাঁতার কাটলে সেই জল পরিস্রুত হয়ে যায়—এর সমর্থনে তথ্যরাশি রান্না করা কঠিন নয়। ফলিত বিজ্ঞানে একটা অংশের কাজ অনেক সময়েই মিথ্যে। এর সুযোগ নেন সকল অপবিজ্ঞানী এবং সঙ্গে কিছু সামান্য অংশের সুযোগসন্ধানী বিজ্ঞানীরাও। অনেক ক্ষেত্রে গবেষণালব্ধ ফল হয়তো সত্যি কথা বলে দেয়, কিন্তু সেই ফলের মান (সেটা আঙ্কিক সংখ্যা হতে পারে, হতে পারে কোনও শব্দ কিংবা ছবি) এমনভাবে ব্যাখ্যা করা হয় যে সেটা সম্পূর্ণ ভুল অথবা মিথ্যে। পরীক্ষালব্ধ পর্যবেক্ষণে হয়তো কোনও ঘটনা একশোর মধ্যে ষাট বার ঘটল, কিন্তু সেটাতে ৯০ শতাংশ সাফল্য পাওয়া গিয়েছে এমন কথা লিখে অনেককেই বিশ্বাস করিয়ে ফেলা যায়। একথা আজকে সকলেই বোঝেন যে গবেষণাপত্রের প্রকাশনও আসলে একটা ব্যবসা। বহু নিম্নমানের গবেষণা পত্রিকা সেই ব্যবসায় মুনাফা লোটার জন্যে গবেষণাপত্রগুলি সঠিকভাবে বিচার করে না। তেমনই বহু বিজ্ঞান সম্মেলন মানের দিক থেকে বেশ নিম্নস্তরের। তাই এই অবিজ্ঞান চলবেই। শুধু আমাদের বিজ্ঞান কংগ্রেসকে কিংবা আজকে ক্ষমতায় থাকা বিজেপি সরকারকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। পুতিন কিংবা ট্রাম্প সাহেবের বলা কিছু অলীক বিবৃতি রাশিয়া বা আমেরিকার কোনও গবেষণাপত্রে ছাপা হয়ে গেলে চমকে ওঠার কিছু নেই। তবে এটা একদিকের ছবি। স্বাধীন বিজ্ঞান তার মতো করে সঠিক রাস্তায় এগিয়ে চলে। অবশ্যই আন্তর্জাতিক স্তরে বেশ কিছু গবেষণা পত্রিকা আছে যারা মানের ব্যাপারে কোনও আপস করে না। সেখানে ছাপা হওয়া গবেষণাপত্রের মান যথেষ্ট উচ্চস্তরের এবং বিশ্বাসযোগ্য। একইরকমভাবে দেশ বিদেশের বিভিন্ন নামী শিক্ষাকেন্দ্রের বিজ্ঞ অধিকর্তারা আদৌ পাত্তা দেন না মন্ত্রী কিংবা রাজনীতিবিদদের। তবে কাজ চালিয়ে যাওয়ার মত একটা সম্পর্ক হয়তো অনেক সময়েই রাখতে হয়।
রাজনীতিবিদরাও অনেক সময় উচ্চশিক্ষিত হন। কিংবা অনেক সময় উচ্চশিক্ষিত না হলেও তাঁদের মধ্যে বহু তীক্ষ্ণবুদ্ধির মানুষ থাকেন। সাধারণভাবে তাঁরা জানেন যে বিজ্ঞানী এবং প্রযুক্তিবিদদের স্বাধীনভাবে কাজ করতে না দিলে দেশের উন্নয়ন অসম্ভব। কিন্তু রাজনীতি বড় দায়। তাই অনেক সময় দক্ষিণপন্থী নেতাকে পদার্থবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তরস্তরের ডিগ্রি থাকা সত্ত্বেও গণেশের দুধ খাওয়ার প্রচার করতে হয়। ফলে এই ধরনের নেতাদের কাছ থেকে সুবিধে পাওয়ার জন্যে কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বলতেই পারেন যে কৌরবেরা আসলে নলজাতক শিশু এবং এই সংক্রান্ত আবিষ্কার আমাদের দেশে অনেক আগেই হয়েছিল।
ধান্দাবাজির জন্যে বিজ্ঞানী এবং রাজনীতিবিদদের পারস্পরিক পিঠ চুলকানির ব্যাপারটা নাহয় বোঝা গেল। কিন্তু সাধারণ মানুষ হিসেবে কীভাবে বুঝব যে সত্যি বিজ্ঞান কোনটা? গাছ থেকে আম পড়লে মাটির দিকে আসে এটা দিয়ে মাধ্যাকর্ষণকে যতটা যুক্তি দিয়ে পেশ করা যায়, পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘোরে নাকি তার উল্টোটা, সেটা তো চটজলদি প্রত্যক্ষ করার উপায় কম। বিজ্ঞানের এক একটি বিষয়ের পিছনে বহু গুণী মানুষের কয়েক হাজার বছরের অক্লান্ত পরিশ্রম আছে। সেগুলো অনেক সময় আমরা না-বুঝেই মেনে নিই। অর্থাৎ গোটাটাই একটা পরম্পরা। ভগবানকে বিশ্বাস করার যেমন একটা ঐতিহ্য আছে, বিজ্ঞানের বিভিন্ন ফলাফলকে বিশ্বাসেরও তেমন অন্য এক ঐতিহ্য বর্তমান। আমাদের বেশিরভাগ বিশ্বাস-অবিশ্বাসই ভালোভাবে না-বুঝে। সেই সুযোগে অতীতের কল্পবিজ্ঞানগুলোকে যদি আমাদের বর্তমান সরকার আবিষ্কার বলে চালিয়ে দেয় তাতে দোষের কি? পুরোটাই তো প্রচার। আর আজকের দিনে আমাদের দেশে নলজাতক শিশুর জন্ম তো হাতের মুঠোয়। অনেকেই হয়তো জানেন যে চিকিৎসক সুভাষ মুখোপাধ্যায় ১৯৭৮ সালে আমাদের এই শহরে প্রথম (বিশ্বে দ্বিতীয়, প্রথমটির ঠিক ৬৭ দিন পরে) নলজাতক শিশুর জন্ম দেওয়ার কাজটি সুসম্পন্ন করেন। কিন্তু সেই সময়ের বুদ্ধিজীবী বামপন্থী সরকার তাঁর কাজের সঠিক মূল্যায়ন করতে পারেনি। মাত্র ৫০ বছর বয়সে আত্মহত্যা করেন এই চিকিৎসক। পরবর্তীকালে তাঁর কাজের পূর্ণ মূল্যায়ন হয়েছে, মরণোত্তর প্রচুর সম্মান পেয়েছেন তিনি। সুভাষবাবু জন্মেছিলেন ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দের ১৬ জানুয়ারি। তাঁর জন্মদিনে তাঁকে স্মরণ করবেন নাকি বিজ্ঞান সম্মেলনে প্রচারিত কৌরবদের কবিরাজকে, সে ধন্দ থেকে মুক্তি পাওয়া মুশকিল।
লেখক ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক