পড়শির ঈর্ষায় অযথা হয়রানি। সন্তানের বিদ্যা নিয়ে চিন্তা। মামলা-মোকদ্দমা এড়িয়ে চলা প্রয়োজন। প্রেমে বাধা।প্রতিকার: একটি ... বিশদ
স্মরণ করুন, ভারতের সংবিধান প্রণয়ন করতে কী দীর্ঘ সময় লেগেছিল। আরও মনে করে দেখুন, ১৯৫১ সালে প্রথম সংবিধান সংশোধনের খসড়া প্রস্তুত এবং পাশ করাতে কী দীর্ঘ সময় লেগেছিল। প্রথম সংশোধনের মাধ্যমে ‘নাগরিকদের মধ্যে সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া শ্রেণী বা তফসিলি জাতি ও তফসিলি জনজাতি’র জন্য ‘বিশেষ ব্যবস্থা’র (স্পেশাল প্রভিশন) সূচনা করা হয়েছিল। ‘বিশেষ ব্যবস্থা’ নামক এই বাগধারাটিই ‘সংরক্ষণ’ (রিজার্ভেশন) নামে জনপ্রিয়।
আতঙ্ক-তাড়িত
১২৪তম সংশোধনীর বিরুদ্ধে সমালোচনাটি এই যে এটা সম্পন্ন হয়ে গেল মাত্র ৪৮ ঘণ্টার ভিতরে—সংসদীয় কমিটির স্ক্রুটিনি এবং গণবিতর্ক ছাড়াই। অন্যদিকে, লোকসভা এবং রাজ্য বিধানসভাগুলোর এক তৃতীয়াংশ আসন মহিলাদের জন্য সংরক্ষণ সংক্রান্ত সংবিধান সংশোধনী বিলটি ২০০৮ সাল থেকে ফেলে রাখা হয়েছে। দোষগুণ (মেরিট) নির্বিশেষে ১২৪তম সংশোধনী হল একটা আতঙ্কের লক্ষণ যেটা বিজেপি এবং সরকার দুটোকেই কব্জা করে ফেলেছে। আতঙ্ক-তাড়িত আরও কিছু ব্যবস্থা গ্রহণের তোড়জোড় চলছে; এগুলোর মধ্যে একটা হল কৃষকদের জন্য ‘ক্যাশ ট্রান্সফার’—যে সম্ভাবনার কথা এই স্থানে বলেছিলাম গত ৭ জানুয়ারি, ২০১৯।
নীতি গৃহীত
এখন বলব বিলের দোষগুণ সম্পর্কে। বিলের ‘উদ্দেশ্য ও কারণ বর্ণনা’ অংশে বলা হয়েছে যে, ‘নাগরিকদের মধ্যে অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল শ্রেণীটা বহুলাংশে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং সরকারি চাকরির বাইরে রয়ে গিয়েছে, তার কারণ আর্থিক অক্ষমতার দরুন অর্থনৈতিক দিক থেকে আরও সুবিধাপ্রাপ্ত (মোর প্রিভিলেজড) মানুষগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় তারা এঁটে উঠতে পারছে না।’ এই নেপথ্য নীতির বিরোধিতা কোনও দলই করেনি। (২০১৪ সালের লোকসভা ভোটের ইস্তাহারে অর্থনৈতিক দিক পিছিয়ে-পড়া শ্রেণীর জন্য সংরক্ষণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল কংগ্রেস )।
সুতরাং, বিপুল বিরোধিতা করার জায়গা বিলটির নীতি নিয়ে নেই, কিন্তু আছে অন্যকিছু কারণে, সেগুলি বিবেচিত হওয়ার যোগ্য এবং প্রাসঙ্গিক। তার মধ্যে উল্লেখ করতে হয়:
(এক) যদি অর্থনৈতিক থেকে দুর্বল শ্রেণীর জন্য সংরক্ষণের বিষয়টি গত চার বছর সাত মাসেও অগ্রাধিকার না-পেয়ে থাকে (যখন তিন তালাক বিলটা ছিল), তবে কেন সেটা লোকসভা ভোটের বিজ্ঞপ্তি জারি হওয়ার মাত্র ৬০ দিন আগে ভীষণ অগ্রাধিকার পেল?
(দুই) ১৫ নম্বর অনুচ্ছেদের প্রস্তাবিত (৬)(এ) এবং (বি) ধারাটা হল—যে (৪) এবং (৫) ধারা রয়েছে সেটারই ‘কাট অ্যান্ড পেস্ট’—একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনসহ। ১৫(৫) অনুচ্ছেদে বিশেষ ব্যবস্থার (অর্থাৎ সংরক্ষণ) সংস্থান ‘আইনের দ্বারা’ ( বাই ল) করার প্রয়োজনের কথা বলা রয়েছে, নতুন ধারা থেকে ‘বাই ল’ শব্দ দুটি বাদ দেওয়া হয়েছে এবং সরকারকে এক্সিকিউটিভ অর্ডারের মাধ্যমে স্কুল ও কলেজে সংরক্ষণ কার্যকর করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।
(তিন) ১৬ নম্বর অনুচ্ছেদের প্রস্তাবিত (৫) ধারাটিও বর্তমান অনুচ্ছেদের (৪) ধারার একটা ‘কাট অ্যান্ড পেস্ট’—একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনসহ। ১৬(৪) অনুচ্ছেদ সংরক্ষণ অনুমোদন করেছে কেবলমাত্র নাগরিকদের মধ্যে যে-কোনও পিছিয়ে-পড়া শ্রেণীর জন্য, চাকরি-বাকরিতে যাদের পর্যাপ্ত প্রতিনিধিত্ব নেই।
আইনগতভাবে এবং নীতিগতভাবে সন্দেহভাজন
(চার) সুপ্রিম কোর্টের দ্বারা ঘোষিত আজ মান্য আইন অনুযায়ী, পদের জন্য সংরক্ষণ অনুমোদনযোগ্য নয় যদিনা শ্রেণীটার পর্যাপ্ত প্রতিনিধিত্ব না-থাকে; অর্থনৈতিক পশ্চাদপদতার ‘একমাত্র’ বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে সংরক্ষণও অনুমোদনযোগ্য নয়। অবশ্য, ওই রায়গুলো বর্তমান সংশোধনীর পূর্বে সংবিধান অনুসারে দেওয়া হয়েছিল। সরকারকে অবশ্যই পরামর্শ দেওয়া হয়েছে যে ওই রায়গুলো অতিক্রম করা যাবে যদি সংবিধান সংশোধন করা হয়। বিলের নীতির সমর্থকরা—অবশ্য কোনও লাভ ছাড়া—সরকারের গৃহীত মত দাবি করেছেন, যাতে তাঁরা সন্তুষ্ট হতে পারেন যে কোনও রকম আইনি ঝামেলায় পড়বেন না।
(পাঁচ) গরিব নির্ধারণের বৈশিষ্ট্য সংক্রান্ত সমালোচনাটি হল সবচেয়ে বাস্তব। ৮ জানুয়ারি ২০১৯ সমস্ত খবরকাগজে এবং টিভি চ্যানেলে একটি অভিন্ন বৈশিষ্ট্য প্রকাশ-প্রচার করা হল (অবশ্যই সরকারি বিবৃতি অনুসারে)। একটি পরিবারভুক্ত একজন সদস্যের মোট বার্ষিক আয় (গ্রস অ্যানুয়াল ইনকাম) ৮ লক্ষ টাকা হলে তিনি ‘গরিব’, কিছু ব্যতিক্রমসহ। যে তথ্যের ভিত্তিতে এই যে ৮ লক্ষ টাকার সীমারেখা সরকার বেঁধে দিল সেই তথ্যটা বিরোধীরা দাবি করলেন, কিন্তু সেই তথ্য পাওয়া গেল না। পাবলিক ডোমেইনের তথ্য অনুসারে বলা যায় যে জনসংখ্যা (১২৫ কোটি)-র ৯৫ শতাংশই এই ক্ষেত্রে যোগ্য—এবং খুব সামান্য অংশই এর বাইরে (আন্ডার দি ‘এক্সক্লুশানস’) বিবেচিত হবে। সংশোধনী অনুসারে যদি প্রায় সকলেই ‘গরিব’ বলে গণ্য হয় তবে ‘সবচেয়ে গরিব’রা—এই সংশোধনের উদ্দেশ্যটা যাদের জন্য—তারাই দুর্বিপাকে পড়ে যাবে! যদি ‘গরিব’-এর সংজ্ঞাটাকে আরও ছোট করে কেবলমাত্র জনসংখ্যার একেবারে নীচের দিকের ২০ শতাংশ আর্থিকভাবে দুর্বল মানুষের জন্যই নির্দিষ্ট করে না-দেওয়া হয় তবে এই নতুন ব্যবস্থাটি সন্দেহভাজন হয়ে থাকবে—আইনগতভাবে এবং নীতিগতভাবে।
(ছয়) বড় প্রশ্নচিহ্ন থাকছে জোগানের দিক থেকে। স্কুল এবং কলেজে আরও বেশি সিট মঞ্জুর করা হবে পরিকাঠামোর স্বল্পতা এবং উপযুক্ত শিক্ষকের অভাবের কথা মাথায় না রেখে। কিন্তু সরকারি পদের বেলা পদ জুটবে কোত্থেকে? সরকারের মতলব কি সমস্ত স্তরে ব্যাপকভাবে বিস্তৃত হওয়া—কেন্দ্র, রাজ্য, পুরসভা, পঞ্চায়েত, পেরাস্তাটাল এবং পাবলিক সেক্টরে? পাবলিক সেক্টর এন্টারপ্রাইজগুলোতে কর্মী সংখ্যা কিন্তু বাস্তবে কমে গিয়েছে—২০১৪ সালের মার্চের শেষে ছিল ১৬,৯০,৭৪১ আর সেটা ২০১৭ সালের মার্চের শেষ দিকে ১৫,২৩,৫৮৬-তে নেমে এসেছে। কেকের সাইজ বাড়ল না, অথচ আর একটা টুকরো সংরক্ষণ করে দেওয়া হল, এরকম হলে সরকারের ধাপ্পাবাজিই ধরা পড়ে যাবে।
বিলটা মনে হয় রিজার্ভেশনের জন্য নয় আত্মরক্ষার (সেলফ-প্রিজার্ভেশন) জন্য।