পড়শির ঈর্ষায় অযথা হয়রানি। সন্তানের বিদ্যা নিয়ে চিন্তা। মামলা-মোকদ্দমা এড়িয়ে চলা প্রয়োজন। প্রেমে বাধা।প্রতিকার: একটি ... বিশদ
আসলে, যাকে বলে ‘বিলো দ্য বেল্ট’ আঘাত করা, আজকাল রাজনীতির ময়দানে সেটা যে একরকম রেওয়াজই হয়ে গেছে ওই টুইট কটাক্ষ তারই প্রমাণ। যুক্তিতে না পারলেই আকথা-কুকথা আর তাতে যদি মনে হয় উদ্দেশ্য সিদ্ধ হচ্ছে না, তখন ঘর পরিবার নিয়ে সংশ্লিষ্ট বিরোধীর (তা সে তিনি বিরোধী দলনেতা নেত্রীই হোন কি দেশের প্রধানমন্ত্রী) কোনও দুর্বল জায়গায় ঘা মারা— রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে এখন এমন আকছার ঘটছে। কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধীও তাঁর ব্যতিক্রম হতে পারলেন কই? রাফাল যুদ্ধবিমানের বরাত নিয়ে বহুদিন যাবৎই রাহুল প্রধানমন্ত্রীকে বিঁধতে ‘চৌকিদার চোর হ্যায়’ বলে অভিযোগ তুলেছেন। অভিযোগটি প্রায় স্লোগানের মতো ছড়িয়েছে সারা দেশে! দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যেও যথেষ্ট সাড়া ফেলেছে চৌকিদার ব্যাপারটা! এতে অস্বাভাবিক কিছু নেই। রাজনীতির লোকজন সম্পর্কে বহুকাল ধরেই মানুষের ধারণা খুব মধুর নয়। তাই, তাঁদের বিরুদ্ধে কোনও একটা কিছু মুখরোচক পেলে বহুজনই তার সত্য-মিথ্যা বিচার না করেই গিলে নেন। আর সেই রাজনীতিক যদি দেশের প্রধানমন্ত্রী হন, তাহলে তো কথাই নেই। বড় ক্ষমতাবানকে, বিশেষ করে যিনি ‘প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ’ বলে চিহ্নিত, তাঁকে কোনওভাবে অস্বস্তিতে পড়তে দেখলে অনেকের এক ধরনের ভালো লাগে বোধহয়। আর তাই, ২০১৪ সালে নতুন ভারত দারিদ্র্য-দুশ্চিন্তামুক্ত ভারত গড়ার কারিগর বলে যাঁকে দেশের মানুষ বিপুলভাবে বরণ করে নিয়েছিলেন, মাত্র কটা বছর পর তাঁর বিরুদ্ধে চোর অপবাদ প্রকৃত সত্য যাচাইয়ের অপেক্ষা না রেখে সেই জনমহলের একাংশেই বেশ জায়গা পেয়ে যায়! এবং ওই স্লোগানের কারিগর কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধীর নামটাও সে মহলে আগের চেয়ে বেশি চর্চায় চলে আসে। সেইসঙ্গে তিন রাজ্যের বিধানসভায় কংগ্রেসের রীতিমতো মোড় ঘোরানো ফল রাহুল-চর্চাকে আরও গভীর, আরও ব্যাপক করে তোলে! পুরনো ভাবনা ছেড়ে নতুন চোখে রাহুলকে দেখাও শুরু হয়ে যায় মহলের কোথাও কোথাও! এই না হলে ভারতদেশের রাজনীতি!
তো সে যাই হোক, তিন বিধানসভা জয়ের অক্সিজেন পেয়ে কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধী সপার্ষদ মোদি হটাও অভিযানে নেমে পড়েছেন। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে যাচ্ছেন, সভা সমাবেশ করছেন, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে লক্ষ্য করে রাফাল ইত্যাদি নিয়ে তোপের পর তোপ দাগছেন, কটুকাটব্য ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করছেন, অনেক সময় সেসবের সীমা বেল্টের নীচেও নেমে যাচ্ছে, আর তাতে উৎফুল্ল সমর্থক জনতার উল্লাসও শুনছেন। অন্যদিকে, বামেরাও তাঁদের শ্রমিক সংগঠনকে কাজে লাগিয়ে দেশ জুড়ে দুদিনের ধর্মঘট করে মোদিজির সরকারকে ‘ধাক্কা’ দেওয়ার চেষ্টা করলেন। তাতে কাজের কাজ কী হল ভবিষ্যৎ বলবে, তবে দুদিন এই বাংলায় না হলেও দেশের কোথাও কোথাও গরিবের রুটি-রুজি বন্ধ থাকল, কাজকামে বিঘ্ন ঘটল, সাধারণ জনজীবন কিছুটা হলেও বিপর্যস্ত হল! বন্ধ সমর্থক নেতানেত্রীরা বুক ফুলিয়ে দাবি করলেন, দেশজনতা তাঁদের বন্ধকে পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছেন এবং আসন্ন লোকসভা ভোটে মোদিরাজ খতম করতে তাঁরা বামেদের সমর্থনপুষ্ট বিরোধী জোটকে সাথ দেবেন! পাশাপাশি ওড়িশার নবীন পট্টনায়েক, ইউপির মায়াবতী অখিলেশ যাদবরাও নানান খেল্ নিয়ে আসরে নেমে পড়েছেন। কিন্তু, প্রশ্ন হল, এভাবে কি হবে? রাহুল গান্ধী, অখিলেশ মায়াবতী বা সিপিএম নেতৃত্বাধীন বাম যেই থাকুন, মমতার নেতৃত্ব ছাড়া বিরোধীদের লোকসভা জয়ের স্বপ্ন সফল হবে? ৫৬ ইঞ্চি ছাতিওয়ালা দেশের চৌকিদারকে ক্ষমতা থেকে হটানো যাবে?
রাজনৈতিক তথ্যভিজ্ঞমহলের অনেকেই মনে করছেন, এই মুহূর্তে দেশের পরিস্থিতি যা তাতে একমাত্র পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে বিরোধীজোট হলেই দিল্লির মসনদে রং বদল হতে পারে। সেক্ষেত্রে বিকল্প একটাই—মমতার ফেডারেল ফ্রন্ট। মমতা বহুদিন ধরেই ফেডারেল ফ্রন্ট তৈরিতে নেমেছেন তেলেঙ্গানার কেসিআর অন্ধ্রপ্রদেশের চন্দ্রবাবুর মতো দেশের নানা প্রান্তের বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী নেতা ইতিমধ্যেই মমতার ফ্রন্টে শামিল হয়েছেন। কিন্তু, তিন রাজ্যের ভোটে কংগ্রেস ভালো ফল করার পর রাহুল গান্ধী খানিক প্রাসঙ্গিকতা ফিরে পাওয়ায় কোনও কোনও নেতা আবার দোলাচলেও ভুগছেন। মমতা না রাহুল কোনদিকে যাবেন তাই নিয়ে দোলাচল। কিন্তু, রাজনৈতিক তথ্যভিজ্ঞজনেদের বক্তব্য, রাহুল সভাসমিতিতে বা টুইট করে চটকদার চমকদার যেসব কথা বলছেন বা যেসব লোভনীয় প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন—ভোট রাজনীতির দিক থেকে তার একটা তাৎক্ষণিক মূল্য থাকতে পারে। কিন্তু, তা দিয়ে মোদিজি বা তাঁর বিজেপির মতো কৌশল-নিপুণ প্রভাবশালীকে চূড়ান্ত ভোটযুদ্ধে পরাস্ত করা, কি নিদেনপক্ষে কিছুটা বেকায়দায় ফেলাও কতদূর সম্ভব তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় আছে। কারণ, যে দুর্নীতিকে ইস্যু করে প্রধানমন্ত্রী মোদিকে বেকায়দায় ফেলতে চাইছেন রাহুল, ঠিক সেই ইস্যুতেই তাঁদের দলের সরকারের মহাপতন ঘটেছিল ২০১৪ সালে! মনমোহন সিং সরকারের বিরুদ্ধে দেশজনতার প্রধান যে দুটি অভিযোগ ছিল তার মধ্যে অন্যতম ছিল দুর্নীতি! আজ মোদিজির বিরুদ্ধে যেমন সাধারণ মানুষের মনে প্রতিশ্রুতিভঙ্গের জ্বালা জেগেছে, মূল্যবৃদ্ধির দাপটে সেই জ্বালায় যন্ত্রণা বেড়েছে— মনমোহন সিংয়ের কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন দ্বিতীয় ইউপিএ সরকারের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল। মনমোহনের কংগ্রেস সরকারের প্রতি দেশের মানুষের সেই ক্ষোভ, সেই প্রতিশ্রুতিভঙ্গের জ্বালা রাহুল গান্ধীর কংগ্রেসের রাজনৈতিক অগ্রগতির পথে নরেন্দ্র মোদির চেয়েও বড় বাধা হয়ে দাঁড়ানোর একটা সম্ভাবনা থেকেই যায়। মানুষের মন বলে কথা!
আর বাদবাকি যাঁরা, তাঁদের কার আছে তেমন সর্বভারতীয় প্রভাব-প্রতিপত্তি, যা দিয়ে মোদিজিকে টেক্কা দিতে পারেন তাঁরা? একটা জবরদস্ত ভোট মহাযুদ্ধের পটভূমি রচনা করতে পারেন? আছেন তো একজনই— মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এ কথা আমরা বলছি না, বলছেন জাতীয় রাজনীতির একাধিক পর্যবেক্ষক, বলছে মমতামুগ্ধ দেশ জনতা। বলছে যে তার কারণও আছে। প্রথমত, মমতার কোনও অপ্রীতিকর ইতিহাস নেই। অতীতে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হিসেবে রেল সমেত বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দপ্তর তিনি সাফল্যের সঙ্গে সামলেছেন। তাঁর আমলে ‘দূরন্ত’র মতো দুর্দান্ত নন-স্টপ ট্রেন এবং ঝকঝকে পরিষেবা পেয়েছিল দেশ। রেলের ভাড়াও নিয়ন্ত্রণে রেখেছিলেন তিনি। তাতে আপামর দেশবাসী যে উপকৃত হয়েছিল তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আজ রেলের অবস্থা, চড়া ভাড়া এবং পরিষেবার মানের সঙ্গে তুলনা করলে তফাৎটা যে কারওরই নজরে আসবে। অন্যদিকে রাজ্যে ক্ষমতায় আসার পর সিপিএমের ছেড়ে যাওয়া রুগ্ন, হতশ্রী শিল্পহীন উন্নয়নহীন রাজ্যটাকে মাত্র কয়েক বছরে অক্লান্ত পরিশ্রমে তিনি কোথায় তুলে নিয়ে গেছেন সেটাও লোকে দেখছেন। তাঁর বিশ্ববাংলা কন্যাশ্রী আজ কেবল দেশে নয়, গোটা বিশ্বে মর্যাদা স্বীকৃতির আলোয় মহিমান্বিত। এবং, ইতিমধ্যেই মমতা ঘোষণা করেছেন, দেশের ক্ষমতায় এলে গোটা দেশকে কন্যাশ্রীর আওতায় আনবেন।
দেশের মানুষ তাঁর এই প্রতিশ্রুতি বিশ্বাস করলে আশ্চর্যের কিছু নেই। কারণ তাঁরা তো শুনছেন, দেখছেন, বুঝছেন—মমতা যা প্রতিশ্রুতি দেন তা বাস্তবায়িত করেন। দেশের মন্ত্রী হিসেবে করেছেন। এখন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে করছেন। আর সেইসূত্রেই দেশজনতার বিশ্বাস প্রধানমন্ত্রী হিসেবেও করবেন। মোদিজির মতো মহানেতা এবং তাঁর সুদক্ষ পদ্মবাহিনীর বিরুদ্ধে এমন একজন সৎ-স্বচ্ছ কর্তব্যে অবিচল মহানেত্রী ছাড়া লড়াই জমে!