অনুরূপ অনুরাগ ও ব্যাকুলতার ঝড় শ্রীরামকৃষ্ণের জীবনবৃক্ষে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। সে-সময়কার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে তিনি নিজ-মুখে বলেছিলেন, ‘সময়ে সময়ে ভগবদবিরহে অধীর হইয়া ভূমিতে এমন মুখঘর্ষণ করিতাম যে কাটিয়া যাইয়া স্থানে স্থানে রক্ত বাহির হইত। ঐরূপে ধ্যান, ভজন, প্রার্থনা, আত্মনিবেদন দিতে সমস্ত দিন যে কোথা দিয়ে এ-সময় চলিয়া যাইত তাহার হুঁশ থাকিত না! পরে সন্ধ্যাসমাগমে যখন চারিদিকে শঙ্খঘণ্টার ধ্বনি হইতে থাকিত তখন মনে পড়িত—দিবা অবসান হইল, আর একটা দিন বৃথা চলিয়া গেল, মার দেখা পাইলাম না। তখন তীব্র আক্ষেপ আসিয়া প্রাণ এমন ব্যাকুল করিয়া তুলিত যে, আর স্থির থাকিতে পারিতাম না, আছাড় খাইয়া মাটিতে পড়িয়া “মা, এখনও দেখা দিলি না” বলিয়া চীৎকার ক্রন্দনে দিক্ পূর্ণ করিতাম ও যন্ত্রণায় ছট্ফট্ করিতাম। লোকে বলিত, “পেটে শূলব্যথা ধরিয়াছে তাই অত কাঁদিতেছে।” শুধু কি তাই? তীব্র ব্যাকুলতার ফলস্বরূপ উভয়ের মধ্যেই যোগজ বিকার দেখা দিয়েছিল। উভয়ের ক্ষেত্রেই তাঁদের আত্মীয়স্বজন ও আশপাশের লোকজন ঐ ঐশী প্রেমার্তিকে ব্যাধি বলে ভুল ধারণা করেছিল। স্বাভাবিক কারণেই এই রোগ নিরাময়ের জন্য তাদের নানাপ্রকারের চিকিৎসার চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছিল। কিন্তু জহরী জহর চেনে। নবদ্বীপে শ্রীবাসপণ্ডিত শ্রীচৈতন্যের ভাবোন্মাদ অবস্থা দেখে বলেছিলেন, ‘মহাভক্তিযোগ দেখি তোমার শরীরে।/ শ্রীকৃষ্ণের অনুগ্রহ হইল তোমারে।।’ তেমনিভাবে শাস্ত্রজ্ঞা সাধিকা যোগেশ্বরী ব্রাহ্মণী ও বৈষ্ণবাচার্য বৈষ্ণবচরণ ভাবোন্মত্ত শ্রীরামকৃষ্ণের মধ্যে মহাভাবের বিকাশ দেখতে পেয়ে তাঁর স্তবস্তুতি করেছিলেন।
অবতারপুরুষের সাধনজীবনে দেখা যায় আগে ফল তারপর ফুল। শ্রীচৈতন্য ও শ্রীরামকৃষ্ণের হৃদয়ে ভক্তিশতদল প্রস্ফুটিত হওয়ার পর তাঁরা উভয়েই অনেকরকমের সাধন-ভজন করেছিলেন। উভয়েই শক্তির উপাসনা করেছিলেন। উপরন্তু উভয়েই শিবের ভজনা করেছিলেন। চৈতন্যভাগবত সূত্রে জানা যায় নবদ্বীপে নিমাইপণ্ডিতের বাড়িতে এক গায়েন ডমরু বাজিয়ে শিবগাথা গাইছিল। শুনতে শুনতে নিমাই ভাবাবিষ্ট হয়ে নাচতে থাকেন, গায়কের কাঁধে চেপে ‘হুঙ্কার করিয়া বোলে মুঞি সে-শঙ্কর।’ পুরীর পথে তিনি জলেশ্বর, কপোতেশ্বর, ভুবনেশ্বর এবং দাক্ষিণাত্যে শিবকাঞ্চী, সেতুবন্ধ ও অন্যান্যস্থানে শিবদর্শন করেছিলেন। আর শ্রীরামকৃষ্ণের কৈশোরে শিবের ভূমিকায় অভিনয় করতে গিয়ে বাহ্যজ্ঞান হারানো, দক্ষিণেশ্বরে ‘শিবমহিম্নঃস্তোত্র’ পাঠ করতে করতে ভাবে অভিভূত হয়ে পড়া, কাশী মণিকর্ণিকাঘাটে বিশ্বশ্বরের দর্শনলাভ ইত্যাদি তাঁর শিবারাধনার প্রমাণ। আবার উভয়েরই শ্রীরামচন্দ্রের ভজনাও করেছিলেন।
স্বামী প্রভানন্দের ‘বাংলার যুগলচাঁদঃ শ্রীচৈতন্য ও শ্রীরামকৃষ্ণ’ থেকে