সমৃদ্ধ দত্ত, অযোধ্যা, ১০ নভেম্বর: নিছক একটি মন্দির নয়, বস্তুত সপ্তকাণ্ড রামায়ণ নির্মিত হতে চলেছে সুপ্রিম কোর্ট নির্ধারিত অযোধ্যার রামজন্মভূমিতে। আর সেই রামায়ণ রচনার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত দুই বাঙালি পিতাপুত্র। রঞ্জিত মণ্ডল ও নারায়ণ মণ্ডল। অসমের বাসিন্দা এই দুই বাঙালি কারিগরের উপর সাত বছর আগে দায়িত্ব পড়েছে দশরথের প্রাসাদে রামচন্দ্রের জন্ম থেকে সীতার পাতালপ্রবেশ, গোটা পর্বটির মূর্তি নির্মাণ করার। অযোধ্যার রামকথা কুঞ্জে। রামজন্মভূমির বিতর্কিত সেই জমি থেকে মাত্র কয়েক কিলোমিটার দূরেই করসেবপুরমে প্রস্তাবিত রামমন্দির নির্মিত হয়ে চলেছে সেই ১৯৯০ সাল থেকে। রামজন্মভূমি কর্মশালা। ২৮ বছর ধরে এই কর্মকাণ্ডের অন্যতম প্রধান উদ্যোগী বিশ্ব হিন্দু পরিষদের শারদ শর্মাকে আজ দেখা গেল অসংখ্য চিঠিতে স্বাক্ষর করছেন, আর অনর্গল ফোন। কাদের কাছে যাচ্ছে এই চিঠি আর ফোন? প্রতিটি রাজ্যের সঙ্ঘ ইউনিটে। অসংখ্য কারিগর লাগবে। পাথরে ডিজাইন করতে হবে, তোরণ বানাতে হবে। রামমন্দিরের প্রথম তলের কাজ প্রায় সমাপ্তই। এবার বাকি দ্বিতীয় তল। তাই গতকালের রায়ের পর ফের করসেবাপুরমের মন্দির নির্মাণের তৎপরতা তুঙ্গে। কর্মশালার মুখেই রামমন্দিরের রেপ্লিকা। মন্দিরে অষ্টপ্রহর সীতারামের মন্ত্র। নিঃশব্দে কাজ করে চলেছেন কারিগরের দল। শারদ শর্মা বললেন, ‘আমাদের এই কাজ দেখে এতকাল বহু মানুষ হাসিঠাট্টা করেছে। আজ প্রমাণ হল তো? আমাদের একনিষ্ঠ ভক্তির ফল পাওয়া গেল। এই মন্দিরই প্রতিষ্ঠা হবে। আর দেরি নয়, আমরা চাই তিন মাসের মধ্যে ট্রাস্ট তৈরি করে মন্দির নির্মাণের কাজ শুরু হয়ে যাক। রামনবমীর দিন হোক শিলান্যাস। সময় লাগবে খুব বেশি হলে চার বছর। মন্দির হবে ২৬৮ ফুট লম্বা। ১৪০ ফুট চওড়া। ১২৮ ফুট উচ্চতার। দোতলা হচ্ছে মন্দির। মোট ২১২টি পিলার থাকবে। প্রতিটি পিলারে থাকবে দু’টি করে মূর্তি। রামায়ণের চরিত্র। প্রথম তলে থাকবে নৃত্যমণ্ডপ, সিংহদরজা, গর্ভগৃহ। আর দ্বিতীয় তলে দরবার হল। লক্ষ্মণের মন্দির। মন্দির চত্বরজুড়ে রামায়ণ বর্ণিত হবে মূর্তির মাধ্যমে। ১৯৯২ সাল থেকে আমাদের কাজ চলছে। মন্দিরের গ্রাউন্ড ফ্লোর কিন্তু কমপ্লিট! জাস্ট নিয়ে গিয়ে বসিয়ে দিতে হবে। সেটার জন্য সময় লাগবে দু’বছর। আর দ্বিতীয় তল শেষ করতে আরও দু’বছর।’ সুতরাং চার বছর পর মন্দিরের উদ্বোধন। তার মানে তো ২০২৪ সাল? লোকসভা ভোট? শারদ শর্মা হেসে ফেললেন। বললেন, ‘আমি সম্ভাব্য টাইমফ্রেম বললাম। কিন্তু রামজন্মভূমি ন্যাস, বিশ্ব হিন্দু পরিষদের এই মডেল মন্দিরকেই যে সরকার কিংবা ট্রাস্ট সত্যিকারের মন্দিরের আর্কিটেকচার মডেল হিসেবে মেনে নেবে, তার নিশ্চয়তা কী? এবার তো মন্দির নির্মাণ করবে সরকার গঠিত ট্রাস্ট। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ, তাই কাজ দ্রুত হবে। সরকারের নজরদারি থাকবে। সুতরাং খ্যাতনামা আধুনিক আর্কিটেক্ট, ইঞ্জিনিয়ার ফার্ম, কারিগরদের যুক্ত করা হবে। আর সোমনাথ মন্দিরের ট্রাস্টি বোর্ডে বল্লভভাই প্যাটেল ছিলেন। আমরা চাই, রামমন্দিরের ট্রাস্টে স্বয়ং নরেন্দ্র মোদি ও অমিত শাহ থাকুন। তাহলে কাজটা দ্রুত এবং নিপুণ হবে।’ যদিও রামজন্মভূমি ন্যাস, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ আর করসেবাপুরমের কারিগরদের মনেপ্রাণে বিশ্বাস, যে মডেল তারা করেছে, সেটাই হবে প্রকৃত রামমন্দির।
কীভাবে শুরু হল এই অযোধ্যার তিনটি স্থান জুড়ে চলা সঙ্ঘ পরিবারের মন্দির নির্মাণের কাজ? মন্দির নির্মাণ কর্মশালার ইন চার্জ অন্নু ভাই সম্পুরা বললেন, ‘১৯৮৯ সালে ভারতের ২ লক্ষ ৭৫ হাজার গ্রাম থেকে ডোনেশন নেওয়া হয়। সাড়ে তিন কোটি টাকার ফান্ড নিয়ে শুরু হয় মন্দির নির্মাণ। নয়ের দশক জুড়ে মন্দির নির্মাণের জন্য ডোনেশন, ইট, পাথর প্রচুর এসেছে। কিন্তু গত কিছু বছরে উৎসাহ কমে আসছিল। এখনও ১ লক্ষ ৮৬ হাজার পাথর জমে আছে। সেগুলিতে ডিজাইন করতে হবে। সুপ্রিম কোর্টের রায় এক লহমায় চিত্রটা বদলে দিয়েছে। হাজার হাজার ফোন আসছে। আবার দলে দলে কারিগর আসতে চাইছে।’
তাই নিছক ভক্তির আকুলতা নয়, রায়ের ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই অযোধ্যায় চলছে বিপুল ‘সরকারি’ প্রকল্প ঘিরে অর্থনীতির হিসেব নিকেষও! প্রজেক্ট রামমন্দির! ছবি: পিটিআই