পড়শির ঈর্ষায় অযথা হয়রানি। সন্তানের বিদ্যা নিয়ে চিন্তা। মামলা-মোকদ্দমা এড়িয়ে চলা প্রয়োজন। প্রেমে বাধা।প্রতিকার: একটি ... বিশদ
বাবুঘাটের আশপাশে ময়দানের যে অংশ বছরভর দিগন্তমোড়া সবুজ আর নির্জনতায় ঝিমিয়ে থাকে, পৌষের শেষ লগ্নে সেখানে এখন অন্য হাওয়া। সরকারি উদ্যোগে এই এলাকায় খোলা হয়েছে ক্যাম্প। গোটা দেশ থেকে পুণ্যের লোভে যাঁরা গঙ্গাসাগরের দিকে পা বাড়ান, তাঁদের এখানে একটু জিরিয়ে নেওয়ার পালা। তাই গঙ্গার পাড় ঘেঁষে হাজার হাজার দেহাতি মানুষের ভিড়। ভিনভাষার কোলাহলে মুখরিত চারদিক। আর আছে বাঙালি। গঙ্গাসাগর পর্যন্ত যাওয়ার ইচ্ছা বা ফুরসত নেই যাঁদের, তাঁদেরই কেউ কেউ ঘুরে যাচ্ছেন এই চত্বরটা। সাগর দেখা না হোক, সাগরমুখী মানুষদের দেখলেও যে পুণ্য! শনিবারের বিকেলে তাই বাবুঘাটের ‘মিনি গঙ্গাসাগরে’ ভিড়ের ঢেউ। এত ঠেলাঠেলি, ধাক্কাধাক্কি, পা ফেলার জো নেই। শখের ফটোগ্রাফাররা এসেছেন ক্যামেরা কাঁধে। কারও হাতে সেলফি স্টিক। কপালে লক্ষ্মীলাভ আছে কি না, তা আগাম জানার লোভে নাগা সন্ন্যাসীদের কাছে ভিড় জমিয়েছেন বহু মানুষ। কপালের দোষ খণ্ডানোর প্রণামীও পড়ছে মুড়ি-মুড়কির মতো। কেউ আবার সাধু দর্শনেই গদগদ হয়ে প্রণাম ঠুকে পায়ে নিবেদন করছেন দশ-বিশ টাকা। হাতে থাকা লাঠিতে চামর কিংবা ময়ূরের পালকগুচ্ছ বেঁধে, দর্শকের গায়ে বুলিয়ে দিচ্ছেন কেউ কেউ। সেখানেও টাকার গন্ধ। মৃগনাভি বা রুদ্রাক্ষ বিক্রির হিড়িকও চতুর্দিকে। ঠকে গেলে, দায়িত্ব ক্রেতার। সন্ন্যাসীদের সবক’টি আখড়াতেই জ্বলছে ধুনি। কাঠ পোড়া আর ধুনোর গন্ধে মাত চারদিক। আর আছে বেজায় ধুলো। পুণ্যার্থী, দর্শক, হুজুগে মানুষ আর প্রশাসনের কর্তাদের পায়ে পায়ে ধুলোয় ঢেকেছে চারপাশ। সব মিলিয়ে গঙ্গাসাগরের প্রাক-সঙ্গমে শহরের এই কোণে দেদার উড়ছে ধোঁয়া, ধুলো আর প্রণামীর নগদ টাকা।
নাইবা হল সাগর পাড়ে যাওয়া। নাইবা হল পুণ্যস্নান। এত মানুষ ভিড় জমিয়েছে এখানে, তাদের পেট ভরে খাওয়ানোটাও তো বড় পুণ্য। সেই লোভে হাজির প্রচুর স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। সেখানে যে শুধু সাগরযাত্রীরাই পাত পাড়বেন, এমন কোনও কথা নেই। সেখানে অবারিত দ্বার। তাই খেয়ে যেমন তৃপ্তি পাচ্ছেন হাজারো মানুষ, খাইয়ে তেমনই আনন্দ পাচ্ছেন কত না লোক। কোনও শামিয়ানার নীচে খিচুড়ি, ছ্যাঁচড়া, আলুর দম, পায়েস। কোনও মণ্ডপে আবার পুরি-তরকারি, বোঁদের আয়োজন। কোথাও আবার ধোঁকার ডালনা আর বাঁধাকপির তরকারির আগে পাতে পড়ছে দেরাদুন চালের ভাত আর ঘন মুগের ডাল। শামিয়ানা ভেদে বদলে যাচ্ছে মেনু। বদলে যাচ্ছে পুণ্যার্থীর মুখ। শুধু আন্তরিকতার স্পর্শটুকু রয়ে যাচ্ছে সর্বত্র। বেলা সাড়ে চারটেতেও আহারের খোঁজে যাঁরা মধ্যাহ্নভোজের জন্য লাইনে দাঁড়িয়েছেন, তাঁদের ধৈর্য্য টলেনি এতটুকু। ক্লান্তি ছাপিয়ে হাতে গরম বালতি নিয়ে অন্ন বিলিয়ে গিয়েছেন শ’য়ে শ’য়ে মানুষ।
অনেকে আবার পুণ্যের আয়োজন সেরেছেন অন্যভাবে। খাবার তো খাওয়াচ্ছে সবাই। কিন্তু আরও তো পরিষেবা বাকি। স্মার্ট যুগে সবার হাতে হাতে মোবাইল। কিন্তু তাতে চার্জ দেওয়া যাবে কী করে? একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা আবার কয়েকশো প্লাগ পয়েন্ট নিয়ে হাজির। সেখানে মোবাইলের চার্জার গুঁজে বসে থেকেছেন বহু পুণ্যার্থী। একসঙ্গে এত মানুষ শুধু ফোনে চার্জ দেওয়ার জন্য আগ্রহ নিয়ে বসেছেন, যেন সেটাও একটা উৎসব। আসলে, যে যেমন পেরেছেন, তেমনভাবে আয়োজন সেরেছেন পুণ্যের তাড়নায়। তাই বাবুঘাটের এই আয়োজন শুধু নিয়ম রক্ষার নরনারায়ণ সেবা নয়। মানবিকতার উদযাপনও। যে শহর বছরভর নানা অমানবিক দৃশ্যের সাক্ষী হয়ে থাকে, এ যেন তারই এক চিলতে পাপস্খলন। মনুষ্যত্বের অন্য হাওয়া।