বিদ্যার্থীদের ক্ষেত্রে ভাবনা-চিন্তা করে বিষয় নির্বাচন করলে ভালো হবে। প্রেম-প্রণয়ে বাধাবিঘ্ন থাকবে। কারও সঙ্গে মতবিরোধ ... বিশদ
এই পরিপ্রেক্ষিতেই গত ১১ই জানুয়ারি তপন থিয়েটারে মঞ্চস্থ হয়ে গেল কল্যাণীর সৌপ্তিক নাট্য সংস্থার নাটক ‘দাগ’।
নাটক ‘দাগ’ এই স্থিতিশীল উন্নয়ন ও স্বার্থান্বেষী উন্নয়নের সংঘাতের গল্প বলে। দু’টি ধারণা, দু’টি মতবাদের মধ্যে সংঘর্ষের কাহিনী তুলে ধরে। যে কাহিনীর পরতে পরতে এসে মেশে রাজনৈতিক ক্ষমতা, ক্ষুদ্র স্বার্থ আর লোভের বিষাক্ত সব ছবি।
প্রাথমিক শিক্ষক বিজন দত্ত (দীপঙ্কর দাস) আদর্শবাদী, পরিবেশসচেতন। অন্যদিকে রাজনীতিবিদ ব্রজকিশোর রায় (সমীর চট্টোপাধ্যায়) সাত পুরুষের বনেদী জমিদার। তাঁর রাজনীতিতে আসা শখে। বিজনের স্ত্রী সুজাতা (শতাব্দী নন্দী) টিপিক্যাল বাঙালী ঘরের স্ত্রী। তিনি শিক্ষিতা, স্বামীর আদর্শে বিশ্বাসী। কিন্তু স্ত্রী হিসেবে, মা হিসেবে আদর্শবান স্বামী ও কন্যার (রুপু- সুস্মিতা বিশ্বাস) মঙ্গলচিন্তায় দোলাচলে ভোগে।
নাটকের শুরুতেই দেখা যায় একটি মজে যাওয়া বিলে পরিবেশবান্ধব পর্যটনশিল্প গড়ে তোলার জন্য শিলান্যাসের অনুষ্ঠান আয়োজিত হচ্ছে। তাতে বিজন ও তার মেয়ে রুপু খুবই উৎসাহিত। কিন্তু সমাজের স্বার্থান্বেষী রাজনৈতিক নেতাদের চক্রান্তে পরে সিদ্ধান্ত পাল্টে যায়। ঠিক হয়, একই জায়গায় জলা বুঁজিয়ে তৈরি হবে রাসায়নিক শিল্পতালুক। বিজন প্রতিবাদে মুখর হয়। ব্রজ পার্টির নেতৃত্ব ও মন্ত্রী শ্যামাপদ বিশ্বাস (সুব্রত সেনগুপ্ত) ও তস্য চেলা যুবনেতা প্রোমোটার গোবিন্দ ধাড়ার (মনোতোষ বন্দ্যোপাধ্যায়) চাপে তাতে সম্মতি দেন। বিজন পরিবেশ বাঁচাতে আন্দোলন গড়ে তোলে, মামলা করে হাইকোর্টে। বলে - উন্নয়নের বিরোধিতা করা তার উদ্দেশ্য নয়। কিন্তু মানুষের দীর্ঘকালীন ভালো থাকবার লড়াই তাকে লড়তেই হবে, আর সেই কারণেই সে রাজনীতি করতে এসেছে। জটিল প্রশ্ন ওঠে— রাজনীতি করা কীসের জন্য? মানুষের জন্য, নাকি পার্টির জন্য? পার্টি কার? মুষ্টিমেয় সুবিধাভোগী শ্রেণীর, নাকি আমজনতার, যারা ভোট দিয়ে পার্টিকে ক্ষমতায় আনে তাদের? পার্টির জনভিত্তি কীসে অক্ষুন্ন থাকে? ব্রজকিশোর রায় জেলা পরিষদের সভাধিপতি হিসেবে এসব প্রশ্নে খেই হারান। চাপের সামনে মাথা নত করেন। বিজন করে না। স্বাভাবিক পরিণতি— বিজনের হত্যা। কিন্তু বিজনের খুন হয়ে যাওয়ার পরে তার স্ত্রী ও কন্যা সকল দ্বিধাদ্বন্দ্ব ত্যাগ করে, সর্বস্ব বাজী রেখে বিজনের মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে আইনী লড়াই লড়বে বলে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়। এ লড়াই যেন অনন্ত, এক পরিব্যাপ্ত কুরুক্ষেত্রে মা-মেয়ে নিঃসম্বল একা নেমে পড়ে।
ওদিকে রাসায়নিক শিল্পতালুকের শিলান্যাস হয়ে যায়। সেখানে তুমুলভাবে অভিনন্দিত, মাল্যভূষিত ও আবীরমন্ডিত ব্রজকিশোর শিলান্যাস অনুষ্ঠান থেকে বাড়ি ফিরে নিজের স্বস্তি, তৃপ্তির আর শ্লাঘার মাঝে কার কন্ঠস্বর শুনতে পান? কে তাঁকে দাঁড় করিয়ে দেয় সুতীক্ষ্ণ প্রশ্নবাণের সামনে? না, সে তো তাঁর আপ্তসহায়ক কালিপদ (চিরঞ্জীব বিশ্বাস) নয়।
তবে কে?.. সে কি তাঁর নিজেরই অন্তর্লীন আপ্তস্বর? যে বিবেকের লক্ষ ফণা তুলে ব্রজর সুশীল সুভদ্র অস্তিত্বকে গ্রাস করতে উদ্যত হয়।
প্রদীপ্ত ভট্টাচার্যের সময়োপযোগী লেখনীতে সুব্রত সেনগুপ্তের সুদক্ষ পরিচালনায় একটি অসামন্য নাটক দর্শকদের সামনে উপস্থাপনা করার জন্য কল্যাণী সৌপ্তিকে জানাই আন্তরিক অভিনন্দন। সুব্রতবাবুর বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর ও অভিনয় মুগ্ধ করেছে। এছাড়া, বিজনের ভূমিকায় দীপঙ্কর দাস ও ব্রজকিশোরের ভূমিকায় সমীর চট্টোপাধ্যায়ের অভিনয় মনে দাগ কেটেছে।
চিন্ময় গড়গড়ি