বিদ্যার্থীদের ক্ষেত্রে ভাবনা-চিন্তা করে বিষয় নির্বাচন করলে ভালো হবে। প্রেম-প্রণয়ে বাধাবিঘ্ন থাকবে। কারও সঙ্গে মতবিরোধ ... বিশদ
দিদি নটী বিনোদিনীর ‘যেন ঠাঁই পাই তব চরণে...’ গানটা। কেউ কেউ বলছেন, দিদি, মীরার বঁধুয়ার ‘জাত সঁপেছে কৃষ্ণপায়ে’ গানটা শোনাতেই হবে।
দিদি দুটি গানই গাইলেন। গান থামার পর আরও একই আবেদন। এবার দিদি বললেন, ‘আজ থাক, পরের বার আবার!’
অনেক বছর আগে আসানসোলের রামসায়ের ময়দানে যাত্রার আসরে ঘটে যাওয়া ওই ঘটনাটি প্রমাণ করে বীণাদেবীর প্রতি হাজার হাজার মানুষের প্রত্যাশা কতটা ছিল। শুধু আসানসোলের এই একটি আসরেই নয়, গ্রাম-বাংলার সর্বত্র যেখানেই বীণা দাশগুপ্তা অভিনয় করতে গেছেন সাধারণ দর্শকদের মধ্যে এমন বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস লক্ষ্য করা যেত। গান শেষ হতেই এক বয়স্কা প্রশ্ন করলেন, ‘এমন সুরেলা হৃদয়স্পর্শী গলা আপনার বছর বছর একইরকম থাকে কীভাবে?’ কেউ বা বলছেন, ‘সুরসম্রাজ্ঞী লতা বা বাংলা গানের সন্ধ্যার মতো আপনিও কণ্ঠের মেজাজটা একইরকম রেখেছেন কোন জাদুতে?’
সামাজিক পালায় দাপটের সঙ্গে অভিনয় এবং পরে ওই দুটি ভক্তিমূলক গান পরিবেশন করেও দিব্যি তরতাজা বীণাদির অকপট উত্তর, ‘এ সবই সম্ভব করুণাময় ঈশ্বরের আশীর্বাদ এবং আপনাদের সবার শুভেচ্ছা ও ভালোবাসার জন্য।’ মুহূর্তে করতালির ধ্বনিতে ভরে গেল আশপাশ।
‘যাত্রালক্ষ্মী’কে ঘিরে মানুষের এমনই প্রবল আকর্ষণ ছিল। তিনি নিজেও বলেছেন, ‘অভিনয়ই আমার জীবনের সর্বস্ব, তাই দর্শকদের আনন্দ দেওয়ার জন্য আমার চেষ্টা সর্বক্ষণ থাকে একইরকম।’ অভিনয় চলাকালীন মাঝে মাঝে দর্শকদের মাঝে মিলেমিশে একাত্ম হবার ঘটনা ঘটেছে একাধিকবার। ‘ওগো বিষ্ণুপ্রিয়া’ যাত্রাপালায় যিনি বিষ্ণুপ্রিয়া চরিত্রে সাবলীল অভিনয় ও গানে মাতিয়ে দিয়েছিলেন আসানসোলের একটি মঞ্চে, কয়েক বছর পর তিনিই আবার ওই মঞ্চেই ‘আমি নিমাই-এর মা’ পালার শচীমাতার চরিত্রে অনবদ্য অভিনয় করেন। এই পালার একেবারে শেষ দৃশ্যে শচীমাতার চরিত্রে বীণাদেবী ‘নিমাই, নিমাই….’ বলতে বলতে মঞ্চ থেকে নেমে দর্শকদের ভিড়ের মধ্যে মিশে যান আবেগে আত্মহারা হয়ে। এভাবে মঞ্চ ছেড়ে একেবারে মাটির সাধারণ দর্শকদের সামনে চলে আসার ঘটনাটি সেদিন অনেককেই অবাক করেছিল।
পরবর্তীকালে আসানসোলের এক যাত্রা আসরের গ্রিন-রুমে বসে আমায় বলেছিলেন, ‘শচীমাতার ওই আবেগকে আমি কিছুতেই নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারি না। নিমাইয়ের খোঁজে যাত্রার আসরের আনাচে-কানাচে আমি তখন পাগলিনীর মতো ওইভাবে ছুটে যাই। আসলে আমি দর্শকদের সঙ্গে ওভাবেই একাত্ম হতে চাই...।’
এই শিল্পীর যাত্রার আসরের নিজস্ব গ্রিনরুমটি সর্বত্রই প্রায় একইরকম থাকত। আসানসোলের পর এই শিল্পীর সঙ্গে কথা হয় পুরুলিয়ার পুনচা থানার বাগদা গ্রামের এক যাত্রার আসরে। সেখানকার হাইস্কুল সংলগ্ন মাঠে সেবার গ্রিনরুমে ঢুকেই আমার মনে হল, আসানসোলের গ্রিনরুমটাই বোধহয় বীণাদেবীর সঙ্গে সঙ্গে এখানে চলে এসেছে। সেভাবেই পর্দা টাঙানো। সাজ-সজ্জার বিভিন্ন উপাদান একইরকমভাবে ছড়ানো আছে। সেই চেয়ার-টেবিল এমনকী পানের পিক ফেলার পাত্রটিও।
রীতিমতো বিস্ময়ের ঘোরে দিদিকে প্রশ্ন করলাম, দিদি, আপনার পানের পিক ফেলার সেই পাত্রটাই, যেটা আসানসোলে দেখেছিলাম!
হাসতে হাসতে দিদি বলেছিলেন, ‘বাঃ তুই দারুণ লক্ষ্য করিস তো! হ্যাঁ, আমার গ্রিনরুমকে ঘিরে সর্বত্রই একইরকম ব্যবস্থা থাকে। তা না হলে অভিনয়ের মেজাজটা ঠিক আসে না।’
তাঁর অভিনয়ের মেজাজটি গড়ে তুলতে সবথেকে সক্রিয় ভূমিকা ছিল বীণাদির গুরু তথা অভিনেতা স্বামী অরুণ দাশগুপ্তের। স্বামী-স্ত্রী একসঙ্গে দীর্ঘ কয়েক বছর বিভিন্ন যাত্রা দলে অভিনয় করেছেন ‘নটী বিনোদিনী’, ‘মীরার বঁধুয়া’, ‘মা-মাটি-মানুষ’, ‘অচল পয়সা’, ‘তালপাতার সেপাই’, ‘হরেকৃষ্ণ হরেরাম’ সহ একাধিক পালায়। বাংলা যাত্রা জগতে অরুণ দাশগুপ্ত অবশ্যই একটি উল্লেখযোগ্য নাম। অভিনয় এবং পরিচালনা দুটো ক্ষেত্রেই তিনি ছিলেন সমান দক্ষ। গিরিশ ঘোষের কাছে বিনোদিনী এসে করজোড়ে বলেছিলেন, ‘আমাকে আপনি তৈরি করে নেবেন...’, এমন কী তাঁর উদ্দেশে গেয়েছিলেন সেই বিখ্যাত গানটি ‘যেন ঠাঁই পাই তব চরণে...।’ মঞ্চে যাত্রাপালায় বলা গিরিশরূপী অরুণ দাশগুপ্তকে বিনোদিনীরূপী বীণা দাশগুপ্তা বাস্তবে সেই কথা যেন বারবার বলতেন। এই প্রসঙ্গটি দিদির কাছে তোলায় হাসতে হাসতে মাথা নেড়ে সম্মতি জানান। তাঁর কথায়, ‘উনিই আমাকে ঠিকমতো তৈরি করেছেন, অভিনয়ের যেটুকু শিখেছি তাঁর কৃতিত্ব পুরোটাই ওনার (অরুণ দাশগুপ্তের)।’
অসিতবরণ বন্দ্যোপাধ্যায়