সুগার সামলাতে ট্যাবলেট ভালো নাকি ইনসুলিন?
ভালো-মন্দের দ্বন্দ্ব চিরন্তন। চা না কফি, গরম জল না ঠান্ডা—কোনটা ভালো? এমন হাজারো প্রশ্নে জেরবার অনেকে। শরীর-স্বাস্থ্য নিয়েও তো সওয়াল জবাবের শেষ নেই।
ট্যাবলেট ভালো না ইনসুলিন? ডাক্তারবাবু ইনসুলিন দিলেন মানেই কি সব শেষ? বিস্তারিত আলোচনা করলেন মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের এন্ডোক্রিনোলজি ও মেটাবলিজম বিভাগের অধ্যাপক ডাঃ রাণা ভট্টাচার্য
ভালো-মন্দের দ্বন্দ্ব চিরন্তন। চা না কফি, গরম জল না ঠান্ডা—কোনটা ভালো? এমন হাজারো প্রশ্নে জেরবার অনেকে। শরীর-স্বাস্থ্য নিয়েও তো সওয়াল জবাবের শেষ নেই। এখন ঘরে ঘরে সুগারের সমস্যা। সেখানেও প্রশ্ন, ট্যাবলেট ভালো না ইনসুলিন? ডাক্তারবাবু ইনসুলিন দিলেন মানেই কি সব শেষ? দেখা যাক চিকিৎসক কী বলছেন—
শরীরে কি বাসা বেঁধেছে ডায়াবেটিস?
এটা দু’ভাবে বোঝা যায়। প্রথমত, শরীরের সুগারের মাত্রা বাড়লে নির্দিষ্ট কিছু উপসর্গ দেখা দেয়। যেমন, হঠাৎ করে ওজন কমে যাওয়া, বারবার বাথরুম পাওয়া, জল তেষ্টা, কোথাও কেটে গেলে সহজে না শুকানো ইত্যাদি ইত্যাদি। এমন উপসর্গ দেখা দিলেই রক্ত পরীক্ষা করতে হবে। তাতে সমস্যাটি ধরা পড়তে পারে। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে, কোনও ব্যক্তি হয়তো জানেনই না তিনি মধুমেহ রোগে আক্রান্ত। কিন্তু, হঠাৎ অপারেশনের দরকার পড়ায় সাধারণ টেস্ট-এ ধরা পড়ল তিনি ডায়াবেটিসে আক্রান্ত!
সুগার জানতে পরীক্ষা
ডায়াবেটিস আছে কি না জানার জন্য মূলত আমরা চাররকম পরীক্ষা করি। তবে সকলকে সবগুলি টেস্ট করতে হয় না। সাধারণত, সম্ভাব্য রোগীকে খালি পেটে ব্লাড গ্লুকোজ পরীক্ষা করতে বলা হয়। আবার ৭৫ গ্রাম গ্লুকোজ খেয়ে তার দু’ঘণ্টা পর রক্ত পরীক্ষা করে সুগারের মাত্রা দেখে নেওয়া হয়। এছাড়া, কারও উপসর্গ থাকলে আমরা র্যানডম ব্লাড গ্লুকোজ টেস্ট করাতে পারি। চতুর্থ পরীক্ষাটি হল এইচবিএওয়ানসি। এর মাধ্যমে বিগত তিন-চার মাসে সুগারের গড় মাত্রা জানতে পারি। প্রতিটি ক্ষেত্রেই দেখা হয়, সুগারের মাত্রা নির্ধারিত মাত্রা বা সীমার মধ্যে রয়েছে কি না। তার ভিত্তিতেই পরবর্তী ধাপ অর্থাত্ চিকিত্সা শুরু করতে হবে।
ডায়াবেটিসের চিকিত্সা?
ডায়াবেটিসের চিকিৎসাকে আমরা মোটামুটি দুই ভাগে ভাগ করি। প্রথমত, জীবন শৈলী পরিবর্তন করে সুগারের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখা। এক্ষেত্রেও দু’টি ভাগ রয়েছে— পরিকল্পনামাফিক শরীরচর্চা ও ব্যালেন্সড ডায়েট। দ্বিতীয়ত, ওষুধের ব্যবহার। তবে কোন রোগীর ক্ষেত্রে কোন পথ অবলম্বন করা হবে, পরিস্থিতি বুঝে চিকিত্সকই তা ঠিক করবেন। বেশির ভাগ রোগীর জন্য দু’টিই একসঙ্গে করা হয়।
মুখে খাওয়ার ওষুধ না ইনসুলিন?
ডায়াবেটিসের চিকিত্সার ক্ষেত্রে এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তবে মূল কথায় আসার আগে একটা বিষয় পরিষ্কার করে নেওয়া জরুরি। তা হল, ওষুধ আর ইনসুলিন আলাদা কিছু নয়। ডায়াবেটিসের চিকিৎসার এক ধরনের ওষুধ এই ইনসুলিন। আবার বর্তমানে বেশ কিছু ইনজেকশন দেওয়া হচ্ছে, যা ইনসুলিন নয়। উদাহরণস্বরূপ জিএলপিওয়ান অ্যানালগের কথা বলা যায়। কখনও কখনও খাবার ওষুধের সঙ্গেও ইনসুলিন ব্যবহারের পরামর্শ দেন চিকিত্সকরা। সবটাই নির্ভর করে রোগীর শারীরিক পরিস্থিতির উপর।
কখন ইনসুলিনকে প্রাধান্য দেওয়া হয়?
টাইপ-১ ডায়াবেটিসের ক্ষেত্রে ইনসুলিনই একমাত্র চিকিৎসা। এক্ষেত্রে শরীরে ইনসুলিন তৈরি হয় না। তাই বাইরে থেকে প্রয়োগ করতে হয়। আমাদের দেশে টাইপ-টু ডায়াবেটিসই বেশি দেখা যায়। এক্ষেত্রেও যদি রোগীর ব্লাড সুগারের মাত্রা অনেক বেশি থাকে, উপসর্গ প্রকটভাবে দেখা দিচ্ছে বা জটিল কোনও সংক্রমণ থাকে, তাহলে প্রথমেই ইনসুলিন ব্যবহার করা হয়। এছাড়া কোনও রোগীর দীর্ঘক্ষণ ধরে অজ্ঞান করে অস্ত্রোপচার হবে, তখনও সাময়িকভাবে ইনসুলিনের দরকার পড়ে। শুধু তাই নয়, যদি দেখা যায় রোগী দীর্ঘদিন ধরে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। শুধু ট্যাবলেট কাজ করছে না বা সব ট্যাবলেট সহ্য হচ্ছে না, সেক্ষেত্রে খাওয়ার ওষুধের সঙ্গে ইনসুলিন যোগ করা হয়। এপর্যায়ে দিনে সর্বোচ্চ চারবার পর্যন্ত ইনসুলিন দেওয়া যেতে পারে।
কতদিন নিতে হবে ইনসুলিন?
কী কারণে ইনসুলিন প্রয়োগ করা হচ্ছে তার ওপর নির্ভর করে কতদিন ওই ‘ওষুধ’ চলবে। ধরা যাক, কোন রোগী টাইপ ২ ডায়াবেটিস নিয়ে এসেছেন। খুব বেশি সুগার রয়েছে আর বেশ কিছু উপসর্গও দেখা যাচ্ছে। তখন অনেক সময় এক-দেড়মাস ইনসুলিন ব্যবহারের পরামর্শ দেন চিকিত্সকরা। তারপর শারীরিক অবস্থা বিচার করে শুধু ট্যাবলেটই খেতে বলা হয়। আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে অনেকগুলো ওষুধ দিয়েও সুগারের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না, সেক্ষেত্রেও ইনসুলিনের প্রয়োজন পড়ে। সেক্ষেত্রে আবার দীর্ঘ সময় ইনসুলিন নেওয়ার দরকার পড়ে। তবে সবটাই নির্ভর করে শারীরিক পরিস্থিতির উপর।
মিথ বনাম তথ্য
অনেকেই মনে করেন, ইনসুলিন মানেই ডায়াবেটিসের শেষ অবস্থা। অর্থাত্ রোগীর শারীরিক অবস্থা মোটেই ভালো নয়। এমন ধারণা মোটেই ঠিক নয়। কারণ কারও হয়তো একটা বা দু’টো ওষুধ চলছে। কিন্তু, দীর্ঘক্ষণ অজ্ঞান করে অপারেশন হবে বা মুখ দিয়ে কয়েকদিন ওষুধ খেতে পারবেন না, সেখানে সাময়িক ইনসুলিন ব্যবহার করা হবে। আবার গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিসের সমস্যা নিয়ে অনেকে আমাদের কাছে আসেন। তাদেরও অনেককে ইনসুলিন নিতে বলা হয়। সন্তান প্রসবের পর তা আবার বন্ধ করে দেওয়া হয়।
এছাড়া আরও একটা প্রচলিত ধারণা রয়েছে। ইনসুলিন ইনজেকশন নিতে বেশ ব্যথা লাগে। বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে এই কথাটাও ঠিক নয়। কারণ আজকাল যে সুঁচ ব্যবহার করা হয় তা অত্যন্ত সূক্ষ্ম ও ছোট। এই সুচ শরীরে ফোটালে তেমনভাবে কিছু টেরই পাওয়া যায় না। তা সত্ত্বেও অনেকেই বলেন, ব্যথা লাগছে। তখন আমরা দেখি, ইনসুলিন নেওয়ার পদ্ধতিতে কোন ত্রুটি রয়েছে, একই সুচ অনেকবার ব্যবহার হচ্ছে অথবা ফ্রিজ থেকে বের করেই ঠান্ডা অবস্থাতেই ইনসুলিন নেওয়া হচ্ছে কি না। কারণ তা না হলে ইনসুলিন নিলে ব্যথা হওয়ার কথা নয়।
ট্যাবলেট খারাপ, ইনসুলিন ভালো?
আরও একটা মিথ কাজ করে যে, সুগারের চিকিৎসায় ওষুধের থেকে ইনসুলিন অনেক বেশি কার্যকরী এবং নিরাপদ। এটাও কিন্তু সব সময় ঠিক নয়। ইনসুলিনের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া সত্যিই খুব কম। তবে কিছু কিছু সুগারের ট্যাবলেটের অতিরিক্ত কার্যকারিতা রয়েছে। আমরা জানি সুগার নিয়ন্ত্রণে থাকলে হার্ট, কিডনিও ভালো থাকে। কিছু কিছু ওষুধ আছে যেগুলো সুগার কন্ট্রোল ছাড়াও হার্ট, কিডনির মতো গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গপ্রত্যঙ্গকে বাঁচিয়ে রাখতে অতিরিক্ত সহযোগিতা করে। কিন্তু এই অতিরিক্ত কার্যকারিতা ইনসুলিনের নেই। এছাড়া ডায়াবেটিসের কিছু কিছু পর্যায়ে, ইনসুলিনের সঙ্গে সঙ্গে সুগার আরও ভালোভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে ট্যাবলেটও দিতে হয়। সুতরাং ইনসুলিন মানে খুব ভালো আর ট্যাবলেট মানে খুব খারাপ এ ধারণাও ঠিক নয়। এটা অত্যন্ত গুরুতর বিষয়কে সরলীকরণ করা। বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে আমরা ইনসুলিনের থেকে ট্যাবলেটই বেশি প্রাধান্য দিই। কিছু ক্ষেত্রে ইনসুলিনের সঙ্গেও ট্যাবলেট ব্যবহার করা হয়।
শেষ কথা
ট্যাবলেট না ইনসুলিন—এই দ্বন্দে জড়াবেন না। উপসর্গ দেখা দিলে বা রুটিন টেস্ট-এ ডায়াবেটিস ধরা পড়লে চিকিত্সকের কাছে যান। তাঁর পরামর্শ মেনে চলুন। সুস্থ থাকুন।
লিখেছেন সুদীপ্ত সেন
