বৃহস্পতিবার, 19 জুন 2025
Logo
  • বৃহস্পতিবার, ১৯ জুন ২০২৫

ভূতের আলো আলেয়া

গ্রাম-বাংলায় যাঁরা বসবাস করেন, তাঁরা অনেকেই আলেয়ার সঙ্গে পরিচিত। আলেয়া কি সত্যিই ভৌতিক রহস্য? না, এর নেপথ্যেও রয়েছে বৈজ্ঞানিক যুক্তি? সেটাই ছোট্ট বন্ধুদের জানালেন  কল্যাণকুমার দে

ভূতের আলো আলেয়া

গ্রাম-বাংলায় যাঁরা বসবাস করেন, তাঁরা অনেকেই আলেয়ার সঙ্গে পরিচিত। আলেয়া কি সত্যিই ভৌতিক রহস্য? না, এর নেপথ্যেও রয়েছে বৈজ্ঞানিক যুক্তি? সেটাই ছোট্ট বন্ধুদের জানালেন  কল্যাণকুমার দে

ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে বিস্তৃত বিশাল ম্যানগ্রোভ জঙ্গল। সুন্দরবনের অতুলনীয় প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং রহস্যঘেরা এই স্থান। শোনা যায়, সুন্দরবনের গভীরে, জলে-জঙ্গলে অন্ধকার জলাভূমিতে মাঝে মধ্যেই দেখা যায় এক রহস্যময় ভৌতিক আলো! যাকে আমরা চলতি কথায় বলে থাকি— আলেয়া! ‘আলেয়া’ নামটি এসেছে বাংলার লোককাহিনি থেকে। এই শব্দটি আত্মা বা ভূতের সঙ্গে সম্পর্কিত। সেই আলেয়ার আলোই সুন্দরবনের জেলেদের রাত-বিরেতে নিয়ে যায় মৃত্যুর কাছে! সেই আলো দেখলেই নাকি শরীরে-মনে এক ঘোরের সৃষ্টি হয়। বোধ-বুদ্ধি কাজ করে না। লোকে মন্ত্রমুগ্ধের মতো সেই আলো অনুসরণ করে এগতে থাকে। তারপর, হয় জলে ডুবে মৃত্যু হয় তাদের! নইলে অন্য কোনও রহস্যজনক কারণে! দ্বিতীয় ক্ষেত্রে কিন্তু শরীরে কোনও আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায় না! অনেক মানুষ বিষয়টি জানে না বলে এ ধরনের আলো দেখে ভয় পেয়ে যায়। ভূত-প্রেত জাতীয় কিছু কল্পনা করে বসে। আর কাল্পনিক গল্প ফেঁদে বসে।
বিজ্ঞানীরা এই সব কথা মানতে রাজি নন। বিজ্ঞানীদের যুক্তি বা বক্তব্য যাই হোক, সুন্দরবনের মানুষ তা মানতে নারাজ। তাঁরা পাল্টা যুক্তি দিতে ফিরে যান অতীতের এক রাজবংশের গল্পে। 
বহু বছর আগে সুন্দরবনের ওই অঞ্চলে রাজত্ব করতেন রাজা শ্রুতঞ্জয়। তাঁর একমাত্র ছেলের নাম ছিল অলঞ্জয়।  নিজের গুণে রাজকুমার সকলের প্রিয় পাত্র ছিলেন। তাই প্রজারা এবং রাজবংশের বাকিরা তাঁকে ‘আলেয়া’ নামে আদর করে ডাকতেন! দিনে দিনে বড় হলেন অলঞ্জয়। পারদর্শী হলেন সব বিদ্যায়। অলঞ্জয়ের রাজ্যাভিষেকের সময় হলে রাজপরিবারের নিয়ম মেনে তাকে যেতে হয় শিকারে। আর শিকারের শর্ত হিসাবে ছিল সুন্দরবনের বিখ্যাত নরখাদক রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার শিকার করে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করতে হবে। নিয়ম মতন অলঞ্জয় তাঁর পিতা এবং দলবলকে সঙ্গে নিয়ে শিকারের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। সুন্দরবনের খাঁড়ির মধ্যে দিয়ে দুই দিন ভেসে চলল তাঁদের বজরা। জ্যোৎস্নার আলোয় অলঞ্জয় এক বাঘিনীকে তার শাবকের সঙ্গে জল পান করতে দেখতে পেলেন।  দেখতে দেখতে সন্তর্পণে তাকে ঘিরে ফেললেন অলঞ্জয় এবং তাঁর দলবল। তার পর আর তাকে বধ করতে কতক্ষণ! জঙ্গলের গভীরে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেও রেহাই পেল না শাবকটিও! হত্যা করা হল তাকেও! কিন্তু, বিপদ ঘনিয়ে এল পরের রাতেই। বাঘ শিকারের পরের দিন ফেরার সময় রাতে অলঞ্জয় দেখলেন, আরও এক বাঘিনী তার শাবককে নিয়ে জল খাচ্ছে। ধীরে ধীরে ঠিক আগের দিনের মতো তার দিকে এগিয়ে গেলেন রাজকুমার। এবার কিন্তু আর আগের দিনের মতো ঘটনা ঘটল না। এইবার ভাগ্য সঙ্গ না দেওয়ায় বাঘিনীর আক্রমণে অলঞ্জয়ের প্রাণ যায়। সবাই দেখল চোখের সামনে, রাজকুমারকে মুখে নিয়ে সুন্দরবনের গভীর জঙ্গলে হাওয়ায় মিলিয়ে গেল বাঘিনী আর তার শাবক। বুড়ো রাজাও হাহাকার করতে করতে ফিরে এলেন ঘরে। আলেয়ার অতৃপ্ত আত্মা কিন্তু থেকে গেল সুন্দরবনের জলে-জঙ্গলেই।
ওই ঘটনার পর থেকেই অলঞ্জয়ের আত্মা সুন্দরবনের গভীর অরণ্যে ঘুরে বেড়ায় এবং নিজের শিকার খোঁজে। তাই এলাকার বাসিন্দাদের কাছে ওই  আলো অলঞ্জয়ের নামানুসারে আলেয়া বলেই পরিচিত। যাঁরা সেই আলো দেখতে পান, অনুসরণ করতে করতে তলিয়ে যান মৃত্যুমুখে। অনেকে আবার বলেন, আলেয়া এতটাও খারাপ নন! তিনি নাকি আলোর বেশে দেখা দিয়ে সাবধান করে দেন সবাইকে! সামনে বিপদ রয়েছে, তাই এগতে বারণ করেন! যাঁরা সেই বারণ শোনেননি, তাঁরা জীবনের বিনিময়ে ভুল শুধরেছেন! বিতর্ক থাকতেই পারে! কিন্তু ছোট্ট বন্ধুরা, কোনও দিন ভেবেছ কি,  আলোর মধ্যেই লুকিয়ে থাকে এতখানি মৃত্যুর আঁধার?
বিজ্ঞানীদের বক্তব্য, আলেয়ার জন্ম হয় নানা গ্যাসের রাসায়নিক বিক্রিয়ায়। মূলত মিথেন আর ফসফরাসের! সুন্দরবনের নিচু জমির জলা জায়গায় এরকম গ্যাস সুলভে মেলে। ফলে, তাদের পারস্পরিক বিক্রিয়ায় জলে মাঝে মধ্যেই আলো জ্বলে ওঠাটাও অস্বাভাবিক কিছু নয়। আলেয়া এক ধরনের বায়ুমণ্ডলীয় ভৌতিক আলো যা রাতের অন্ধকারে জলাভূমিতে বা খোলা প্রান্তরে দেখা যায়। মাটি থেকে একটু উঁচুতে আগুনের শিখা জ্বলতে থাকে। ইংরেজি ভাষায় একে will-o’-the-wisp বলে।  আলেয়া সৃষ্টি নিয়ে নানা মত রয়েছে। লোককথায় একে ভৌতিক আখ্যা দেওয়া হলেও বিজ্ঞানীরা মনে করেন গাছপালা, গাছের পাতা পচনের ফলে যে মার্শ গ্যাসের সৃষ্টি হয়, তা থেকে আলেয়ার উৎপত্তি। যেহেতু মিথেন গ্যাসের নিজের জ্বলার ক্ষমতা নেই, তাই আগুন শুরুর কারণ হিসেবে বিজ্ঞানীরা দাহ্য ফসফিন (PH3) ও ফসফরাস-ডাই-হাইড্রাইড (P2H4) গ্যাসকে চিহ্নিত করেন। আলেয়াতে থাকা ফসফরাস-ডাই-হাইড্রাইড (P2H4) গ্যাসটি বায়ুর সংস্পর্শে এলে জ্বলে ওঠে। ফলে অন্যান্য গ্যাসগুলি (অর্থাৎ মিথেন এবং ফসফিন) একই সঙ্গে নীল শিখাসহ জ্বলতে থাকে। বায়ুপ্রবাহের ফলে জ্বলন্ত গ্যাসটি গতিশীল হয়। এটিই হল আলেয়া। আলেয়া কোনও ভৌতিক ব্যাপার নয়। তবুও গ্রাম বাংলার অধিকাংশ মানুষ বিশ্বাস করে এটি অশরীরীদের কাজ। কেউ মনে করেন বাঁশ বা শুকনো কাঠের ঠোক্করে যে স্ফুলিঙ্গ তৈরি হয় তা থেকেই এই মার্শ গ্যাসে আগুন লাগে। আয়নীকরণের সময়, এই গ্যাসের অণুগুলি আলোক কণা নির্গত করে। যা বৈজ্ঞানিক সম্প্রদায়ের কাছে ‘ফোটন’ নামে আরও সঠিকভাবে পরিচিত। এটিই আলোকসজ্জার কারণ। যেহেতু বিভিন্ন গ্যাস বিভিন্ন তরঙ্গদৈর্ঘ্যের ফোটন নির্গত করে, তাই বিভিন্ন রঙের আলো তৈরি হয়। আলেয়ার আলো মিথ্যা মায়া। এই জলাভূমিতে দৃষ্ট জ্বলন্ত গ্যাস যাতে প্রায়ই পথিকের পথভ্রম ঘটে। অনেক সময় মানুষ ভুল বিশ্বাসে জড়িত হয়ে যায়। শোনা যায়, গ্রামাঞ্চলে মানুষ এই আলেয়াকে পরীও ভাবে। মূলত তারা ভ্রান্ত বিশ্বাসে জড়িয়ে পড়ে। তারা বিশ্বাস করে, এই আলোগুলি এই অঞ্চলে দুর্ঘটনায় প্রাণ হারানো মৃত জেলেদের আত্মা থেকে উদ্ভূত। যারা এই ভূতের আলো বা ‘আলেয়া’র কাছে যাওয়ার চেষ্টা করবে, তারা হয় তাদের জীবন হারাবে অথবা তাদের মানসিক স্থিতিশীলতা নষ্ট হবে।