কর্মলাভের যোগ আছে। ব্যবসায় যুক্ত হওয়া যেতে পারে। কর্মক্ষেত্রে সাফল্য আসবে। বুদ্ধিমত্তার জন্য প্রশংসা জুটবে। ... বিশদ
চিকিৎসাবিজ্ঞানের কৃপায় অবশেষে দেশব্যাপী টিকাকরণের মহাযজ্ঞ শুরু হয়ে গেল। বর্তমানে প্রথম পর্যায়ের টিকাকরণ চলছে। এখন টিকা পাচ্ছেন চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা। আর কয়েকটি ধাপ পেরলেই সাধারণ মানুষও টিকা পাবে। মিলবে যুদ্ধজয়ের আনন্দ। তবে টিকাকরণ শুরু হতে না হতেই টিকা নিয়ে জনমানসে নানা বিভ্রান্তি ছড়িয়ে পড়েছে। উঠে আসছে নানান প্রশ্ন। খুঁজে নেওয়া যাক তারই উত্তর—
ভ্যাকসিন নেওয়ার সুফল কী কী?
অতিমারীর সময় ভ্যাকসিন নেওয়ার দু’টি সুফল—
১. ব্যক্তিগত সুরক্ষা: কোভিশিল্ড ভ্যাকসিনটির ক্ষেত্রে সংস্থার পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে, দু’টি টিকা নেওয়ার পর ব্যক্তিগত ক্ষেত্রে প্রতিরোধ গড়ে উঠবে কমবেশি ৭০ শতাংশ।
২. সামাজিক সুরক্ষা বা হার্ড ইমিউনিটি:
হার্ড ইমিউনিটি গড়ে তোলার জন্য দেশের ৬৭ থেকে ৭০ শতাংশ মানুষের মধ্যে প্রতিরোধ গড়ে ওঠা প্রয়োজন। তাই দেশের একশো শতাংশ মানুষ যদি ভ্যাকসিন নেন এবং ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা যদি ৭০-৮০ শতাংশও হয়, সেক্ষেত্রে সামাজিক সুরক্ষা বলয় তৈরি হয়ে যাবে।
কোভিশিল্ড ও কোভ্যাকসিন
আপাতত দেশে দু’টি ভ্যাকসিন ছাড়পত্র পেয়েছে— ১. অক্সফোর্ড এবং অ্যাস্ত্রাজেনেকার কোভিশিল্ড। ২. আইসিএমআর (ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব মেডিক্যাল রিসার্চ)-এর গবেষণার মাধ্যমে তৈরি হওয়া সম্পূর্ণ দেশীয় টিকা কোভ্যাকসিন।
প্রথমে কোভিশিল্ড-এর প্রসঙ্গে বলি। মূলত ভাইরাল ভেক্টর ক্যারিয়ার প্রোটিন ভ্যাকসিন হল কোভিশিল্ড। কোভিশিল্ডে ব্যবহার করা হচ্ছে শিম্পাঞ্জির লাইভ অ্যাডিনো ভাইরাস। এই অ্যাডিনো ভাইরাস মানবদেহে বংশবৃদ্ধি করতে পারে না। এই ভাইরাসের জেনেটিক উপাদান বাদ দিয়ে শুধু তার খোলটি ব্যবহার করা হচ্ছে। ভাইরাসের খোলকের মধ্যে রাখা হচ্ছে করোনা ভাইরাসের ‘স্পাইক প্রোটিন’-এর অংশ। এই ভাইরাস মানবদেহের কোষে শুধু স্পাইক প্রোটিন পৌঁছে দেওয়ার কাজটিই করবে। কোষের মধ্যে শুধু স্পাইক প্রোটিনের সংখ্যা বাড়বে। অথচ কোনও ক্ষতি হবে না।
আমাদের মনে রাখতে হবে, এই স্পাইক প্রোটিনের সাহায্যেই মানবদেহের কোষে আটকে যায় ভাইরাস।
ফলে ভ্যাকসিনের মাধ্যমে আগে থেকে এই প্রোটিনকে দেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা চিনে রাখলে, করোনা ভাইরাসকেই আর কোষে আটকাতে দেবে না। কোভিশিল্ড নিয়ে বিস্তারিত গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন জার্নালে।
আর দেশীয় কোভ্যাকসিনে ব্যবহার করা হচ্ছে নিষ্ক্রিয় করোনা ভাইরাস। এই ভাইরাস শরীরে বংশবৃদ্ধি করতে পারবে না। অথচ শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা জীবাণুটিকে চিনে রাখবে! তবে কোভ্যাকসিন সম্পর্কে বেশি তথ্য হাতে নেই। তবে যাঁদের শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম ও যাঁদের অন্য একাধিক ওষুধ খেতে হয়, তাঁদের কোভ্যাকসিন নিতে নিধেষ করছে ভারত বায়োটেক।
সম্প্রতি এই নিয়ে বিস্তারিত একটি তথ্যপত্র প্রকাশ করেছে সংস্থা।
ক’টি ডোজ নিতে হবে?
কোভিশিল্ড দু’টি ডোজে নিতে হয়। একবার নেওয়ার চার সপ্তাহ পরে দ্বিতীয় ডোজ দেওয়া হবে। ইঞ্জেকশনের সাহায্যে হাতের মাংসপেশিতে দিতে হয়।
কোভ্যাকসিনও নিতে হবে দু’টি ডোজে। প্রথম ডোজের থেকে দ্বিতীয় ডোজ নেওয়ার মধ্যে ২৮ দিনের পার্থক্য থাকবে। হাতের উপরের দিকের ডেল্টয়েড মাংসপেশিতে ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে ভ্যাকসিন দেওয়া হয়।
কেউ কেউ দাবি করছেন, কোভিড থেকে সেরে ওঠা রোগীর শরীরে ইতিমধ্যেই অ্যান্টিবডি তৈরি হয়ে আছে। ভ্যাকসিন নেওয়ার ফলে সেই অ্যান্টিবডি নাকি নষ্ট হয়ে যাবে। এই দাবি কতটা সত্যি?
জীবাণুর কারণে অসুখ হলেই আমাদের শরীরে সেই জীবাণুর বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়। ভিন্ন ভিন্ন জীবাণুর বিরুদ্ধে তৈরি হওয়া অ্যান্টিবডির স্থায়িত্বকালেও প্রভেদ দেখা যায়।
একটা উদাহরণ দিলে বিষয়টি স্পষ্ট হবে। কোনও ব্যক্তির স্মল পক্স হলে, তাঁর শরীরে যে অ্যান্টিবডি তৈরি হয় তা প্রায় সারাজীবনই থাকে। অন্যদিকে ইনফ্লুয়েঞ্জা কিন্তু আমাদের বছর বছর হয়। ইনফ্লুয়েঞ্জার বিরুদ্ধে শরীরে তৈরি হওয়া অ্যান্টিবডির স্থায়িত্ব কাল ছয় থেকে আট মাস। এই কারণেই বছর বছর ইনফ্লুয়েঞ্জার ভ্যাকসিন নিতে হয়। দেখা গিয়েছে, করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধেও আমাদের শরীরে তৈরি হওয়া অ্যান্টিবডি দীর্ঘস্থায়ী হয় না। আমরা একই ব্যক্তিকে একাধিকবার করোনায় আক্রান্ত হতে দেখেছি। সুতরাং কোভিড থেকে সেরে ওঠার পরেও ভ্যাকসিনের ডবল ডোজ নিলে কোভিডজয়ীর রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা শক্তিশালীই হবে।
ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা কতদিন?
গবেষণালব্ধ ফলাফল থেকে দাবি করা হচ্ছে, কোভিশিল্ডের কার্যকারিতা প্রায় একবছর বজায় থাকবে। সুতরাং যাঁরা ভ্যাকসিন নিচ্ছেন তাঁদের আগামী একবছর পর্যবেক্ষণ করা হবে। তারপর দেখা হবে বুস্টার ডোজ কবে নেওয়ার দরকার পড়বে। এমনকী এও হতে পারে যে বুস্টার ডোজের আর দরকারই আর পড়ল না!
মিউটেশন হলে তখন?
করোনা ভাইরাসের চরিত্র বদল নিয়ে চারিদিকে আলোড়ন চলছে। তবে এই মিউটেশন ভাইরাসের তেমন বড় বদল আনেনি। তাই এই টিকা দু’টি চরিত্র পরিবর্তন করা ভাইরাসের বিরুদ্ধেও কাজ করবে বলে মনে করা হচ্ছে।
টিকা নেওয়ার পরে
ভ্যাকসিন নেওয়ার পরেই হাসপাতাল থেকে চলে যাবেন না। ৩০ মিনিট অপেক্ষা করুন। এই সময়ের মধ্যে কোনওরকম শারীরিক অসুস্থতা দেখা দিলে চিকিৎসককে জানান। সাধারণত ৩০ মিনিট পেরিয়ে গেলে আর কোনও সমস্যা হতে দেখা যায়নি।
কারা টিকা নিতে পারেন?
বিশেষ কিছু ক্ষেত্র ছাড়া সকলেই নিতে পারেন।
কখন ভ্যাকসিন নেওয়া যাবে না?
অ্যালার্জির পূর্ব ইতিহাসে।
জ্বর থাকলে।
রক্তপাতজনিত সমস্যা বা রক্ত তরল করার ওষুধ খেলে।
ইমিউনিটি কম থাকলে বা ইমিউনিটির উপর প্রভাব ফেলে এমন ওষুধ খেলে।
সন্তানসম্ভবা অবস্থায়।
মাতৃদুগ্ধ পান করালে।
করোনার অন্য ভ্যাকসিন নিলে।
কোনও জটিল অসুখ থাকলে চিকিৎসকের সঙ্গে আগেভাগে পরামর্শ করে নিন।
প্লাজমা থেরাপির অধীনে রয়েছেন এমন ব্যক্তি।
মারাত্মকভাবে অসুস্থ রোগী।
টিকা নেওয়ার পরও কি মাস্ক?
আগেই বলেছি, ভ্যাকসিন দেওয়া মানেই ১০০ শতাংশ সুরক্ষিত— এমন ভাবার কারণ নেই। তাই ভ্যাকসিন নেওয়ার পরও করোনা বিধি যেমনটা মানছিলেন, তেমনই মেনে চলুন। শারীরিক দূরত্ব বজায় রখুন, মাস্ক পরুন, সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে নিন বা স্যানিটাইজ করুন।
অবশ্যই মনে রাখুন
১. ভ্যাকসিন থেকে করোনা হয় না
২. করোনা থেকে সুস্থ হয়ে ওঠার পরও ভ্যাকসিন নিতে হবে।
৩. ১৮ বছরের নীচে এই ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা নিয়ে তথ্য সামনে আসেনি। তাই বাচ্চাদের আপাতত এই টিকা দেওয়া হবে না।
৪. ভ্যাকসিন বাধ্যতামূলক নয়। চাইলে নাও নিতে পারেন। জোর করে দেবে, এমন ভাবার কারণ নেই।
ও সায়ন নস্কর
ছবি: ভাস্কর মুখোপাধ্যায়