রোগ সারাতে বাড়িতে কী কী গাছ রাখবেন?
পরামর্শে ভারত সরকারের আয়ুর্বেদ গবেষণা বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত চিকিৎসা বিজ্ঞানী অধ্যাপক ডাঃ সুবলকুমার মাইতি
সত্যিই কি বাংলার ঘরে ঘরে ছোট থেকে বড়— মাটিতে বা টবে, উঠোনের ধারে কিংবা রাস্তার পাশে, বারান্দায় বা ছাদে নানা আকারের টবে, ছোট-বড় কলোনিতে দশ ঘরে মিলে প্রত্যেকের বাড়ির সামনে দু-একটি করে গাছ লাগিয়ে, ঘরের পাশের পতিত জমিতে বা যেখানে ইচ্ছে ভেষজের বাগান করা সম্ভব? নিশ্চয়ই সম্ভব।
এমন কিছু ভেষজের চাষ হবে, যেগুলি নানা প্রকার রোগ সারাবে; কিছু ভেষজ থাকবে, যেগুলি রোগ সারাতে পারবে, আবার আমরা সব্জি হিসেবে খেতে পারব; আবার এমন কিছু সব্জির চাষ করতে পারি, যেগুলি মূলত সব্জি হলেও ঔষধি গুণ প্রচুর। এছাড়া এমন কিছু সব্জি আছে, যেগুলি বাজারে প্রচুর পাওয়া গেলেও ভয়ঙ্কর বিষাক্ত দ্রব্যের সাহচর্যে সেগুলি তৈরি হয়, সেই বিষক্রিয়া থেকেও তো কিছুটা রেহাই পেতে পারি। বাগান তৈরির জন্য মাটি তৈরি করতে হবে, সেজন্য শুকনো মাটি, গোবর সার, পাতা পচা সার, বালি, বেলেমাটির প্রয়োজন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে গোবর সার, সরষের খোল, পাতা পচা সার হলেই চলবে।
পোকা দমনের জন্য নিমপাতা সিদ্ধ জল বা নিগম থেকে তৈরি কীটনাশক সপ্তাহে একদিন বাগানে স্প্রে করতে পারি। মোটামুটি একটা গাছের তালিকা এই রকম—
১. কালমেঘ, তুলসী, ঘৃতকুমারী, শিউলি, উলট কমল, আয়াপান, মেহেন্দি, বাসক, নিসিন্দা প্রভৃতি।
২. নিম, বেল, কারিপাতা, সজনে, তেজপাতা, পাতিলেবু, পুদিনা, মেথি, কুলেখাড়া, ব্রাহ্মী, থানকুনি, পুনর্নবা, ডুমুর, পলতা, গাঁদাল, হলুদ, আদা, রসুন, পেঁয়াজ প্রভৃতি।
৩. লঙ্কা, বেগুন, পান, পালং, নটে, ফুলকপি, বাঁধাকপি, গাজর প্রভৃতি।
৪. রাস্তার ধারে লাগানোর জন্য দেশি গাছ— আম, জাম, কাঁঠাল, বেল, বকুল, অর্জুন, কুড়চি, নিম, অশোক, বাবলা, সাঁই, সজনে, শিরীষ, তেঁতুল, করমচা, কয়েতবেল, কুল, ডুমুর, বকফুল, শিউলি, নিসিন্দে, তাল, খেজুর, বট জাতীয় বৃক্ষ সমূহ প্রভৃতি।
আমরা এখানে বাগানের কথা বলছি, যা আমার পরিবারের কাজে লাগবে, প্রয়োজনে অন্য কারুর। চাষ করলে সেটির পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে, বিক্রির ব্যবস্থা করতে হবে। তাই চাষের প্রসঙ্গ এখানে আলোচনায় আসবে না। খুব সংক্ষেপে এগুলি ব্যবহার কীভাবে করা যেতে পারে, সেই আলোচনা করা হচ্ছে।
১. কালমেঘ— বীজ পাকলে গাছগুলো কেটে কুচি কুচি করে শুকিয়ে একটি পাত্রে ভালোভাবে রেখে দিন। শুকনো গাছ ৫০০ গ্রা.-৩ কিলো সংগ্রহ করলে ৪-৫ জনের সংসারে বছরখানেক চলে যাবে। সপ্তাহের যে কোনও একটা দিন ঠিক করুন। সেদিন বাড়ির সবাই কালমেঘ ভেজানো জল খাবেন খালিপেটে। আগের দিন রাত্রে ১০-১৫ গ্রাম গাছ ৪০০-৫০০ মিলিলিটার জলে ভিজিয়ে রাখুন।
পরদিন সকালে ছেঁকে এটি ৪/৫ জন মিলে খেয়ে নিন। লিভার ভালো রাখে, হজম শক্তি বাড়ায়, ক্রিমি নষ্ট করে, রক্তের সুগার কমাতে সাহায্য করে। টবে/মাটিতে চাষ করতে পারেন।
২. তুলসী— ঘরের আনাচেকানাচে, বাগানে, ঘর থেকে বেরুবার রাস্তার দু’ধারে, অথবা টবে লাগাতে পারেন। মাঝে মাঝে রাত্রে খাওয়ার বা ঘরের টেবিলে ২-৪ টে তুলসীর টব রেখে দিতে পারেন।
প্রত্যহ সকালে উঠে খালি পেটে ৫-১০টি তুলসী পাতা বয়সানুপাতে বাড়ির সবাই খান। পাতাগুলো আগের দিন তুলে ভালোভাবে ধুয়ে একটা প্লেটে রেখে ভালোভাবে ঢাকা দিয়ে রাখতে পারেন। এটি কফ-কাশি প্রতিহত করতে পারে।
১০টি তুলসীপাতার সঙ্গে এক চা-চামচ চন্দন ঘষা মিশিয়ে প্রত্যহ সকালে খালিপেটে খেলে, যাঁরা হাইপ্রেশারের রোগী তাঁরা ভালো থাকবেন।
আর একটা কাজও করতে পারেন— সকালে খালিপেটে রসুনের বড় একটা কোয়া বা ছোট ছোট ২-৩টি কোয়া চিবিয়ে খেয়ে, সামান্য টিফিনের পর তুলসী, চন্দন খান— হাইপ্রেশার ও সুগারের পক্ষে খুবই ভালো।
৩. ঘৃতকুমারী— টবে বা মাটিতে সহজে চাষ করা যায়। রাতের বেলায় ঘরের যেখানে-সেখানে, সেই সঙ্গে শোওয়ার ঘরে দু-একটি টব বসাতে পারেন। ঘরের বাতাসকে শুদ্ধ করে অক্সিজেন তৈরি করবে।
এভাবে স্নেক প্ল্যান্ট ও মানি প্ল্যান্ট ঘরের মধ্যে রাখতে পারেন। ঘৃতকুমারীর বহু গুণ— লিভারকে ভালো রাখে, সমস্ত শরীর তরতাজা রাখে। প্রত্যেক দিন স্নানের পূর্বে ঘৃতকুমারীর শাঁস মুখে লাগাতে পারেন। আজ সব ক্ষেত্রেই এর রমরমা।
৪. শিউলি—ঔষধিগুণ অনেক। তুলসীপাতা ও শিউলিপাতার রস জ্বরনাশক। শিউলি পাতা হালকা বেসন সহকারে ভেজে খাওয়া যায়। লিভার ও পেট ভালো থাকে।
৫. উলট কমল— শিকড় স্ত্রীরোগের বাধক দোষে ব্যবহৃত হয়। পুষ্টিকারক। পাতার ডাঁটা একটি কুচি কুচি করে এক গ্লাস ঠান্ডা জলে রাতে ভিজিয়ে রাখুন। পরদিন সকালে ডাঁটাগুলো ফেলে দিয়ে জলটি খেয়ে নিন। এটি শরীরকে ঠান্ডা রাখে। মেয়েদের হোয়াইট ডিসচার্জ, ছেলেদের স্বপ্নদোষ, উভয়ের অপুষ্টিতে সপ্তাহে ৩ দিন করে খেতে থাকুন। ভালো থাকবেন। সামান্য মিছরি মেশাতে পারেন।
৬. আয়াপান— আয়াপানের পাতা ১৫-২০টি বেটে পরিমাণ মতো মিছরি দিয়ে কাপ দেড়েক শরবত করে সকালের দিকে খাবেন— সপ্তাহে ১ দিন বা ২ দিন। শরীর ঠান্ডা থাকবে। পেটের গোলমাল থাকবে না। যে কোনও প্রকার রক্তস্রাবে দিনে ২ বার করে শরবত বানিয়ে ৫-৬ দিন খেলে কমে যাবে। অতি উপকারী গাছ।
৭. মেহেন্দি— মেহেন্দি গাছের পাতা বেটে সেই বাটা দিয়ে মেহেন্দি লাগান। গাঢ় রং করতে হলে পরিমাণ মতো পানে খাওয়া কালো খয়ের মেশাতে পারেন। বাজারের মেহেন্দি লাগাবেন না, কারণ ওতে মারাত্মক সব কেমিক্যাল থাকে, যা চামড়ার পক্ষে ভালো নয়। এমনিতে মেহেন্দি পাতা ৮-১০ গ্রাম ভালোভাবে ধুয়ে হাতে ডলে/মুচড়ে এক গ্লাস জলে রাতে ভিজিয়ে রাখুন। সকালে ছেঁকে শরবতের মতো খান। মিছরি দিতে পারেন। শরীর ঠান্ডা থাকবে। হজম ভালো হবে। স্বপ্নদোষ বা সাদা স্রাব থাকলে প্রত্যহ একবার করে, ১০-১৫ দিন খেতে হবে। তা না হলে সপ্তাহে ১-২ দিন খান।
৮. বাসক— বাসক পাতা জলে ফুটিয়ে পরিমাণ মতো মিছরি মিশিয়ে খান— কাশি কমবে। পাতা ১০ গ্রাম ও মিছরি ১০ গ্রাম, ২ কাপ জলে ফুটিয়ে এক কাপ থাকতে নামিয়ে ছেঁকে চায়ের মতো করে খান— দিনে ২-৩ বার খুসখুসে কাশি, গলা ঘড় ঘড় করা কাশি, ঠান্ডা লেগে সর্দি-জ্বর-কাশি সবই কমতে থাকবে। পরপর কয়েকটা দিন খেতে হবে।
৯. নিসিন্দা— পাতার চূর্ণ ৫০০ মিলিগ্রাম করে দিনে ২ বার হালকা গরম জল দিয়ে খেলে বাতের ব্যথা কমবে। ১০০ গ্রাম সর্ষে তেলে পাতা বাটা ১৫-২০ গ্রাম ভেজে নিয়ে সেই তেলটা সংরক্ষণ করুন। বাতের ব্যথায় মালিশ। নাক এঁটে গেলে এক ফোঁটা করে দু’নাকে নস্যি নিন। সঙ্গে সঙ্গে কমে যাবে।
যে কোনও বাতের ব্যথায় দিনে ২ বার মালিশ ও কাপড়ের গরম সেক নিলে চমৎকার উপকার পাবেন। তেলে ভেজে পাতা খেলে অনেক উপকার পাবেন বাতের ক্ষেত্রে।
১০. নিম— বাগানে বা টবে লাগিয়ে ২-৩ ফুটের মাথায় কেটে দিন। নতুন পাতা গজালে ভেজে খান। এমনি করে গাছ ঝাঁকড়া হবে। সারা বছর কচি পাতা খেতে পারবেন। নিমের প্রচুর গুণ। চর্মরোগ, অ্যালার্জি, মধুমেহ, জন্ডিস,অজীর্ণ প্রভৃতি ক্ষেত্রে তখনকার দিনে নিদানে এটির ব্যবহার দেখা যায়। বর্তমানের গবেষণায় প্রচুর গুণের হদিশ পাওয়া গেছে।
১১. হলুদ— কাঁচা হলুদ এক গাঁট, থানকুনি পাতা ৪-৫টি প্রত্যহ সকালে খালিপেটে চিবিয়ে খান। বহু রোগের হাত থেকে রক্ষা পাবেন। তবে গর্ভাবস্থায় না খাওয়াই ভালো। হলুদের প্রচুর গুণ— কম-বেশি সবাই তা জানেন।
১২. পুদিনা— সর্বপ্রকার পেটের রোগে পুদিনার রমরমা ব্যবহার। পুদিনার চাটনি উপাদেয় খাদ্য। ১০ গ্রাম পুদিনা বেটে কাপ খানিক জলে মিশিয়ে ছেঁকে রাখুন। পেটের নানা গোলমালে এটি সারাদিনে ৪-৫ বারে খেয়ে নিন।
১৩. ব্রাহ্মী, থানকুনি, পুনর্নবা, কুলেখাড়া প্রভৃতি নানা প্রকারে ঔষধে ব্যবহৃত হলেও এগুলি আলু ও বেগুন সহযোগে মাখো মাখো তরকারি বানিয়ে খাওয়া যায়, একই উপকার পাবেন। ব্রাহ্মী অবশ্য ঘিয়ে ভেজে খেতে পারেন। থানকুনি ও ব্রাহ্মী— বুদ্ধি-স্মৃতি-মেধাবর্ধক। পুনর্নবা— কিডনি ও প্রস্টেটকে সুস্থ রাখে, কুলেখাড়া অম্লনাশক ও রক্তবর্ধক গুণসম্পন্ন।
১৪. লঙ্কা, বেগুন, গোছা পান— বাগানে বা টবে লাগাতে পারেন। এগুলি কেন লাগাতে বলছি শুনুন। যত প্রকারের খারাপ সার ও বিষ সবই এই তিনটিতে ব্যবহার করা হয়। যাঁরা চাষ করেন বাজারজাত করার জন্য, অধিকাংশক্ষেত্রে তাঁদের বাড়ির কেউই এ তিনটে দ্রব্য ছোঁন না। আলাদাভাবে চাষ করে ব্যবহার করেন।
সাধারণ শুকনো গোবর ও পাতা পচা সার দিয়ে এগুলোর চাষ মাটিতে বা টবে করুন। নিমপাতা সিদ্ধ জল বা নিম মিশ্রিত ঔষধ স্প্রে করুন সপ্তাহে বা ১৫ দিনে এক বার— পোকামাকড়ের হাত থেকে রেহাই দেবে। লঙ্কা ও বেগুন, পানে সাধারণত বিশেষ কিছু
লাগে না।
অন্যান্য দ্রব্যগুলির প্রচুর গুণ, তা নানা প্রকার পত্র-পত্রিকা, বই থেকে সহজেই জেনে নিতে পারবেন। প্রথমে চাষ তো করুন মন দিয়ে।
26th September, 2019