জলপথ পরিবহণ কর্মে বিশেষ শুভ। হস্তশিল্পী, হিসাব-শাস্ত্রবিদ প্রমুখের কর্মে উন্নতি ও সুনাম। মানসিক অস্থিরতা থাকবে। ... বিশদ
বন্ বন্ বন্ বন্ টাকায় ঘুরছে এই দুনিয়াটা!’— সেকথা তো আমরা সবাই জানি। কিন্তু যদি এমনটা হয়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মুদ্রা তোমাদের চারপাশে ঘুরতে শুরু করল! কেমন লাগবে তখন? যদি চোখের সামনে খোলা পাও গোল্ড ভল্টের দরজা। আর সেখানে থরে থরে সোনার বাট সাজানো! ইচ্ছে করলেই হাতে তুলে দেখতে পার সেই সোনার বাট! তাহলে কেমন হবে? না না! আলিবাবা ও চল্লিশ চোরের গুহার কথা বলছি না! তেমন জায়গা আছে হাতের একদম নাগালের মধ্যেই! যেতে চাইলে সটান চলে যেতে পার কলকাতার ৮ নম্বর কাউন্সিল হাউস স্ট্রিটের পুরনো রিজার্ভ ব্যাঙ্কের হেরিটেজ বিল্ডিংয়ে। এখন যেটি ‘আরবিআই মিউজিয়াম’। সোমবার ছাড়া সপ্তাহের যেকোনও দিন সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত মিউজিয়াম খোলা। আরও মজার খবর এই মিউজিয়ামে কোনও প্রবেশমূল্য নেই। এটি দেশের দ্বিতীয় আরবিআই মিউজিয়াম। এটির উদ্বোধন হয়েছে ২০১৯ সালের ১১ মার্চ।
ঢুকতেই রিসেপশন কাউন্টারে রাখা রয়েছে বাতিল, ছেঁড়া নোটের মন্ড দিয়ে তৈরি বুদ্ধের মুখ। রয়েছে একটি বিশাল থাম। যার গায়ে বাতিল দশ পয়সা দিয়ে মানুষের ডিএনএ-র নকশা করা আছে। বিশাল বড় একটি এক টাকার কয়েনের আদলে তৈরি মূল দরজা দিয়ে এবার প্রবেশ করতে হবে সংগ্রহশালার ভেতর।
ঢুকেই ডানদিকে রয়েছে ডকুমেন্টারি প্রদর্শনীর জায়গা। স্কুল কিংবা কলেজ থেকে ছাত্রছাত্রীরা দল বেঁধে এলে এই প্রদর্শনী দেখানো হয়। বিশাল হল ঘরটির ঠিক মাঝখানে রয়েছে তেরো ফুট উঁচু উচ্চতার টাকার রেপ্লিকার খুব সুন্দর একটি স্থাপত্য। যার নীচে আছে বাতিল কয়েনের তৈরি ম্যাপ।
টাকা আবিষ্কারের আগে, প্রাগৈতিহাসিক যুগে মানুষ কীভাবে কেনাবেচা করত, তা ছবি-মডেল-তথ্যচিত্রের মাধ্যমে দেখানো হয়েছে এখানে। প্রথমে শস্যদানাকেই টাকার মূল্য হিসেবে ধরা হতো। বিনিময় প্রথা বা বার্টার সিস্টেমের কথা তো তোমরা ইতিহাসে পড়েছ। এখানে আছে একটি চমৎকার মডেল, যেখানে সে যুগের বাজারে কীভাবে মানুষ বেচাকেনা করত, তা তুলে ধরা হয়েছে।
‘ফানি মানি’ বিভাগ দেখলে মজা লাগবেই! কারণ, এখানে প্রদর্শিত রয়েছে সেই সব জিনিস, যেগুলিকে একসময় বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে ধরা হতো। কী ছিল না সেই তালিকায়! জন্তু-জানোয়ারের লোম, বাঘের জিভ, নুন, পার্মেসান চিজ, কড়ি, ঝিনুক, ঝিনুকের গয়না, গোরু, নৌকা এমনকী বিরাট বড় পাথরও!
আটের দশকের টাকার বিবর্তনের ইতিহাস দেখতে পাবে কয়েকটি ঘোরানো গোল টেবিলের আকৃতির মেশিনের বাটন টিপলেই!
পায়ে পায়ে চলে এসো কয়েকটি পুরনো যন্ত্রের সামনে। আছে বন্ড তৈরির মেশিন, নোট ছিঁড়ে গেলে যে মেশিনের সাহায্যে জোড়া হতো সেই মেশিন, যে ইউভি ল্যাম্প জ্বেলে জাল নোট পরীক্ষা করা হতো সেটি। এছাড়াও রয়েছে ধাতব মুদ্রা তৈরির সময় যে হাতুড়ি দিয়ে পেটানো হতো সেইসব হাতুড়ি, ছুরি, গালার বিভিন্ন রকমের সিল। সেই সিলে ব্যবহার করার কালি, দাঁড়িপাল্লা, বিদ্যুৎ চলে গেলে যে হ্যাজাক জ্বালানো হতো সেগুলোও রাখা আছে।
নিজেদের জ্ঞান পরীক্ষা করতে চাইলে দাঁড়িয়ে পড়তে পার কুইজ মেশিনের সামনে। এ, বি, সি এই তিন রকমের গ্রুপে ভাগ হয়ে সামনে থাকা বোতাম টিপে খেলতে পারবে।
এবার চল সোনার ইতিহাসের খোঁজে। পৃথিবীতে বতর্মানে কোন কোন দেশে কতটা সোনা আছে, তা দেখানো হয়েছে গ্রাফের মাধ্যমে। পাবে এমন একটি ওজনযন্ত্র, যেখানে তোমার ওজনের সমপরিমাণ হতে গেলে কতগুলো সোনার বাট লাগতে পারে, তার হিসেব কষা যাবে! একটা শো-কেস ভর্তি শুধু স্বর্ণমুদ্রা! না শুধু জাহাঙ্গিরের স্বর্ণমুদ্রা নয়, এখানে আছে গজনির সুলতান মামুদ, মুঘল সম্রাট হুমায়ুন, আকবর, আওরঙ্গজেব, টিপু সুলতান, লোদি শাসনকালের স্বর্ণমুদ্রা!
এবার সোজা ঢুকে পড়া যাক— এক্কেবারে গোল্ড ভল্টের ভেতর! প্রথমেই দেখতে পাবে রেলিংয়ের ওপাশে তিনজন প্রমাণ সাইজের মডেল কেমন করে সোনার বাট থরে থরে সাজিয়ে রাখছে! হাতের নাগালের মধ্যেই পাবে একটা ১২.৫ কেজি ওজনের সোনার বাট! নিজের হাতে একবার সেটা তুলে ধরার চেষ্টা করে দেখতে পার! ভল্টে লাগানোর বিভিন্ন রকম তালার বিবর্তনও দেখানো রয়েছে এখানে। এই সেকশনেই দেখতে পাবে খনি থেকে কীভাবে সোনা তোলা হয় এবং প্রসেস করার পর তা কীভাবে চকচকে চেহারা পাচ্ছে!
এবার রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ইতিহাস জানতে পাতা ওল্টাও একটি অভিনব ‘ফ্লিপ-বুক’-এর! তবে পাতা ওল্টাবার জন্য স্পর্শ করার বদলে শূন্যে মশা তাড়ানোর ভঙ্গিতে শুধু হাত নাড়তে হবে, তবেই উল্টে যাবে সেই বইয়ের পাতাগুলি! ফুটে উঠবে সামনের স্ক্রিনে আরবিআইয়ের ইতিহাস!
এ এমনই এক মিউজিয়াম যেখানে থাকে বাতিল পয়সারও এপিটাফ! আরবিআই-এর প্রথম ভারতীয় গভর্নর সি ডি দেশমুখ সর্ব ন্যূনতম পয়সা ‘পাই’ বাতিল হয়ে যাওয়ার পর, ইংরেজিতে লিখেছিলেন সেই পাইয়ের এপিটাফ! যেটি এখানে পাইয়ের ছবির সঙ্গে টাঙানো রয়েছে। আছে লেখাটির বাংলা অনুবাদ— ‘মুক্ত করে মানুষের প্রয়োজনী চাপ...সময়ে বিলীন হবে আমাদের ছাপ, বেঁচে রবে পাই-এর ইতিহাস কথা!’ আরে! ওরা কারা বসে আছে? আগেকার দিনের ‘নায়েবমশাই’। হিন্দিতে যাদের বলে ‘মুনিমজি’। প্রমাণ সাইজের মডেলের সাহায্যে ‘মুনিম কি পেটি’ যেন একদম জীবন্ত হয়ে উঠেছে! ডেস্কের ওপর লাল খেরোর খাতা খুলে লোহার সিন্দুকের সামনে বসে বসে তারা টাকার হিসেব করছে!
এবার গন্তব্য দোতলায়। দোতলায় রয়েছে একের পর এক চমক! স্বাধীনতার পর প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর ইচ্ছে অনুসারে বিখ্যাত ভাস্কর রামকিঙ্কর বেইজ নয়াদিল্লির আরবিআই-এর মূল তোরণের জন্য তৈরি করেছিলেন দু’টি যক্ষ-যক্ষীর মূর্তি। কারণ, পুরাণ অনুসারে ধনসম্পদের দেবতা কুবেরের সমস্ত ধনরাশি রক্ষা করে থাকেন এঁরা দু’জন। সেই যক্ষ-যক্ষীর মূর্তি দু’টির রেপ্লিকা রাখা আছে এই দোতলায়। আছে আলো দিয়ে সাজানো এই মিউজিয়ামের সামনের গেটের মিনিয়েচার মডেল। দেখতে দেখতে যাতে শিখতে পার, সেজন্য আছে নানারকম গেম। সাইকেলের প্যাডেল করে কখনও মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে পার, কখনও অর্থনৈতিক উন্নয়নের টিউবকে ব্যালান্স করতে পার বোতাম টিপে।
আচ্ছা, ধর যদি এমন হতো— গান্ধীজি নয়, তোমার নিজের মুখের ছাপ দেওয়া টাকা পাওয়া যেত? এখানে এলে পূরণ হয়ে যাবে সেই অসম্ভব ইচ্ছেটাও! আড়াইশো, দেড়শো কিংবা এক লক্ষ টাকার নোট ছাপিয়ে নিতে পারবে নিজের নাম, জন্মতারিখ সহ! অবশ্য, এই টাকার প্রিন্ট পাবে না। তবে স্ক্রিনশট দেখিয়ে বন্ধুদের তাক লাগিয়ে দিতে পার।
আরও একটা মজার গেমে তোমার ‘অবতার’কে একটা নির্দিষ্ট টাকায় বাজার করতে হবে সব্জি-মাছ-মাংস-ডিম ইত্যাদি। বেঁচে যাওয়া টাকা জমা দিতে হবে ব্যাঙ্কে। তবে সাবধান হিসেবে গোলমাল করলেই কিন্তু পুলিস এসে তোমার ‘অবতার’-এর হাতে হাতকড়া পরিয়ে দেবে! অনেক সময় টাকা ছিঁড়ে যায়। গ্রাফের সাহায্যে শেখানো হয়েছে ঠিক কোন কোন অংশ অক্ষত থাকলে ছেঁড়া নোটের বিনিময়ে ঠিক কত টাকা পাওয়া যেতে পারে।
আগেকার দিনে ইউরোপ, আমেরিকায় কফিশপগুলোয় বিভিন্ন কোম্পানির চেক ক্লিয়ারিং হতো। প্রমাণ সাইজের মডেল দিয়ে সেসবই দেখানো হয়েছে। বিশাল বিশাল অঙ্কের ডলার দেখতে কেমন হয়, দেখতে চাও? এখানে তাও দেখে যাও। দেখবে বিভিন্ন দেশের নোটও।
এখানেই শেষ নয়। চলে এসো মেজানাইন ফ্লোরের ‘কিডস জোন’-এ। এখানে ক্যালাইডাস্কোপ ঘোরালে পয়সা দিয়ে তৈরি হবে নানান ডিজাইন। ‘ওপেন-টি-বায়োস্কোপ’-এর গর্তে চোখ লাগিয়ে দেখতে পাবে টাকা তৈরি থেকে শুরু করে বাতিল নোট কীভাবে নষ্ট করা হয় সেই পুরো পদ্ধতিটাই। বিভিন্ন নোটকে খণ্ড খণ্ড করা আছে, তুমি সেগুলো সঠিকভাবে জুড়ে দেবার ‘জিগ-স-পাজল’ গেম খেলতে পার।
ফেরার সময় স্যুভেনির শপ থেকে বাতিল নোটের মন্ড দিয়ে বানানো চাবির রিং, নোটপ্যাড, নানারকম মূর্তি, আরবিআই-এর লোগো দেওয়া টিশার্ট কিংবা কফিমাগ নিতে ভুলো না যেন!
তাহলে? কবে আসছ এই অভিনব টাকার মিউজিয়াম নিজের চোখে দেখতে?