জলপথ পরিবহণ কর্মে বিশেষ শুভ। হস্তশিল্পী, হিসাব-শাস্ত্রবিদ প্রমুখের কর্মে উন্নতি ও সুনাম। মানসিক অস্থিরতা থাকবে। ... বিশদ
মুংলি যখন ছোট্টটি ছিল, মধুও তখন হামা টানে। দু’টি সমবয়সি প্রাণীর মধ্যে সখ্য গড়ে উঠতে সময় লাগেনি। জঙ্গলে যারা থাকে, পশুপাখিদের সঙ্গে পাশাপাশি ঘেঁষাঘেঁষি করে পরশির মতো বাস করে। কিন্তু যারা বাইরে থেকে লুকিয়ে ঢোকে, বনের প্রতি তাঁদের কোনও মায়া নেই। নির্দয়ের মতো গাছ কাটে, নির্বিচারে পশুপাখি মারে। এদের অত্যাচারে বন ছোট হয়ে যাচ্ছে আজকাল। নদীর পাড় ভাঙছে। ভেসে যাচ্ছে কত গ্রাম। মধুর ভয় হয়, কোনওদিন হয়তো তাদের এই ছোট্ট গ্রামটাও আর থাকবে না।
জঙ্গলের ধার ঘেঁষে মধুদের গ্রাম। এখানকার মানুষেরা জঙ্গলের উপরে নির্ভর করেই বেঁচে থাকে। কেউ মাছ ধরে, কেউ মৌচাক ভাঙে। কাঠ কুড়োয়। ঝোপঝাড় হাতড়ে খুঁজে আনে শাকপাতা, ফলপাকুড়, জ্বালানি।
মধুর মা নেই। বাবা শহরে কাজ করে। মধু থাকে তার বুড়ি ঠাকুরমার সঙ্গে। ঠাকুরমাও ইদানীং খুনখুনে বুড়ি হয়ে পড়েছে। তার উপরে চোখেও দেখে না ভালো। সংসারের সব কাজ মধুকেই করতে হয়। সকালে কাজ সেরে ইশকুলে যায় সে। বাড়ি ফিরে রাঁধেবাড়ে। নিজে খায়, ঠাকুরমাকে খাওয়ায়।
তারপরেও পড়ে থাকে সারাটা দুপুর। সেই সময়টা মুংলির সঙ্গে খেলে বেড়ায় সে। মুংলি এখন তো আর ছোটটি নেই। শুঁড়ে করে জড়িয়ে মধুকে নিজের পিঠে বসিয়ে নেয়। মধুও হাতে একখানা গাছের ডাল নিয়ে বীরদর্পে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে চলে। তখন নিজেকে বনের রাজা বলে মনে হয় তার।
।। দুই ।।
সেদিনটাও ছিল অন্যান্য দিনের মতো একটা সাধারণ দিন। মুংলির পিঠে চড়ে বেড়াতে বেড়াতে গভীর জঙ্গলে চলে এসেছিল মধু। এমন সময় চোখে পড়ল, নদীর ধারে বেলগাছে ফলে আছে ঝাঁকে ঝাঁকে পাকা বেল।
দেখেই ভারী লোভ হল মধুর। মুংলিকে বুঝিয়ে বলতেই সেই গিয়ে দাঁড়াল বেলগাছের ঠিক নীচে। ওর পিঠে দাঁড়িয়ে বেল পাড়তে শুরু করল মধু। পাকা বেল, যেমন মিষ্টি গন্ধ, তেমনি তার স্বাদ। দু’জনে মিলে যত পারল বেল খেল। তাতে পেট ভরল বটে, কিন্তু মন ভরে কই! ইশ, আরও কিছু বেল যদি নিয়ে যাওয়া যেত সঙ্গে, কী ভালোই না হতো! বেলের শরবত ভারী ভালোবাসে ঠাকুরমা।
ভাবতে ভাবতেই বুদ্ধি খেলে গেল মধুর মাথায়। চট করে পরনের জামাটা খুলে ফেলল। পুটুলি বানিয়ে তাতে ভরে ফেলল অ্যাত্ত অ্যাত্ত বেল। তারপর সেটা আড়াআড়ি করে বেঁধে নিল পিঠে।
বেলা পড়ে এসেছে। বনের বিশাল বিশাল গাছের ঝাঁকড়া মাথা আকাশ ঢেকে রাখে। তাই এখানে সন্ধে নামে তাড়াতাড়ি। সূর্য পশ্চিমে ঢলতে শুরু করলে আশপাশের গ্রামের মানুষজন বাড়ি ফিরে যায়। অন্ধকার অরণ্য নিরাপদ নয়।
অন্যদিন অনেক আগেই ফিরে যায় মধুও। কিন্তু আজ বেল পাড়ার আনন্দে সময়ের খেয়াল ছিল না। এখন চারদিকে তাকিয়ে বুঝল, বড্ড দেরি হয়ে গিয়েছে। তার উপর এসেও পড়েছে অনেকটা গভীর বনে। সূর্যাস্তের আগে ফিরতে হবে। মুংলিকে তাড়া দিল সে। দু’জনে ফিরতি পথ ধরল।
সামান্যই এগিয়েছে, হঠাৎ থমকে
দাঁড়াল মুংলি।
‘কী হল রে?’ জিজ্ঞাসা করল মধু। খেয়াল করল, মুংলির কান খাড়া। অর্থাৎ সে কোনও শব্দ শুনতে পেয়েছে। কান পাতল মধুও। একটানা একটা চাপা ঘর্ঘর শব্দ কানে এল। এই শব্দ মধুর অচেনা নয়। শুধু সে কেন, জঙ্গলে যারা থাকে, সকলেই চেনে এই শব্দকে। গাছ কাটার কলের করাত।
মধুর চোয়াল শক্ত হল, শিরদাঁড়া হল টানটান। জঙ্গলে কাঠচোররা ঢুকেছে। ফিসফিস করে বলল সে, ‘চল মুংলি।’
।। তিন ।।
মুংলি বুঝি তার নির্দেশের অপেক্ষাতেই ছিল। নিঃশব্দে পা ফেলে এগিয়ে চলল। গভীর বন দিনের বেলাতেও অন্ধকার। কিছু দূর এগতেই চোখে পড়ল দৃশ্যটা। বুড়ো বটের তলায় মারাংবুরুর থান রয়েছে। খুব জাগ্রত দেবতা। পূর্ণিমা তিথিতে আশপাশের গ্রামের লোকেরা এখানে পুজো দেয়। অন্য সময়ে তেমন কেউ আসে না এদিকটায়। সেই সুযোগেই বেশ খানিকটা জায়গা লেপে-পুছে সাফ করা হয়েছে। তাঁবুও পড়েছে একটা। গাছ কাটার বড় যন্ত্র এসেছে। এক পাশে ডাঁই হয়ে পড়ে আছে শাল, সেগুন, শিশু গাছের বিশাল বিশাল কাণ্ড। একটা ট্রাক দাঁড় করানো
কিছুটা দূরে।
সব দেখে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল মধু। গত ক’মাস ধরেই রাতারাতি জায়গায় জায়গায় জঙ্গল সাফ হয়ে যাচ্ছিল। সরকার থেকে গ্রামে গ্রামে ঘোষণা করে গিয়েছে, কোনও খবর পেলে ফরেস্ট অফিসে জানাতে। কিন্তু এই মুহূর্তে যেটা চিন্তার, সেটা হল কাঠচোররা দেবতার থান বুড়ো বটগাছটাকেই কাটছে।
‘মুংলি!’ মৃদুস্বরে বলল মধু।
মুংলি নিঃশব্দে মাথা নাড়ল।
‘এদের আটকাতে হবে।’
মনে মনে হিসেব করল মধু। ফরেস্ট অফিসে গিয়ে খবর দিতে গেলে তার আগেই দেবতার গাছ কাটা পড়বে। যা করার তাদেরই করতে হবে। সতর্কভাবে চারদিকে তকিয়ে দেখল সে। দুটো লোক গাছ কাটছে। ভেতরে আরও
লোক থাকলেও থাকতে পারে। সেটুকু ঝুঁকি নিতেই হবে।
ঝোলা থেকে একটা বেল বের করল মধু। মুংলির দিকে বাড়িয়ে দিল সেটা। মুংলির বয়স কম হলে কী হবে ভারী বুদ্ধিমান সে। কী করতে হবে বুঝে নিল। শুঁড় বাড়িয়ে বেলটা নিয়ে ছুড়ে দিল লোক দুটোর মধ্যে একজনের মাথা লক্ষ্য করে। আচমকা আঘাত পেয়ে লোকটা মাথা ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। কান্নার শব্দে তাঁবুর ভেতর থেকে আরও দু’জন বেরিয়ে এল। সতর্কভাবে দেখতে লাগল এদিক-ওদিকে। সঙ্গে সঙ্গে আরও একটা বেল। তারপর আরও একটা। আরও একটা। লোকগুলো লাফাচ্ছে, ঝাঁপাচ্ছে, ভয়ে কান্নাকাটি জুড়েছে।
মধু সাবধান হল। বেল ফুরিয়ে আসছে। খুব দ্রুত ভেবে নিল পরবর্তী কর্তব্য। মুংলির কানের কাছে মুখ নিয়ে কিছু বলল। হাত বুলিয়ে দিল তার মাথায়। মুংলি কয়েক মুহূর্ত চুপ করে রইল। তারপর শুঁড়টাকে শূন্যে তুলে অদ্ভুত সুরে ডেকে উঠল। একবার, দু’বার, তিনবার। লোকগুলো এতক্ষণে দেখতে পেয়েছে তাদের। ভয়ের জায়গায় মুখের রেখায় ফুটে উঠেছে হিংস্রভাব। একজন ঢুকে গেল তাঁবুর ভেতরে। পরক্ষণে বেরিয়ে এল। হাতে ধরা কালো কুচকুচে অস্ত্রটাকে চেনে মধু। সিনেমায় দেখেছে। শিরদাঁড়া দিয়ে হিমেল স্রোত নেমে গেল তার।
মুংলি আবারও ডেকে উঠল, আগেরবারের চেয়েও উচ্চস্বরে। তারপর হঠাৎই মধুর নির্দেশের পরোয়া না করে বীরবিক্রমে ছুটে গেল লোকগুলোর দিকে।
‘মুংলি, মুংলি... সাবধান,’ চেঁচিয়ে উঠল মধু। কিন্তু মুংলির কানে কোনও কথাই যেন ঢুকছে না। এগিয়ে গিয়ে শুঁড় দিয়ে ধাক্কা মেরে ফেলে দিল সামনের লোকটাকে। অন্য লোকটা পিস্তল তাক করে আছে, কিন্তু হাত কাঁপছে তার, স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে মধু। মুংলি এবার ঘুরল ওর দিকে।
দুম!
প্রচণ্ড শব্দে কেঁপে উঠল বনভূমি। পাখিরা ওড়াউড়ি শুরু করেছে কলকল শব্দে। মধু চিৎকার করে উঠল, ‘মুংলি!’
গুলি মুংলির শরীর ছুঁয়ে গেছে। ঘাড়ের কাছ থেকে গলগলিয়ে রক্ত বেরচ্ছে। প্রচণ্ড রাগে লোকটাকে শুঁড় দিয়ে তুলে মাটিতে আছড়ে ফেলল মুংলি। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে প্রচণ্ড হুঙ্কারের শব্দে চমকে উঠল মধু। খুব কাছেই অনেক হাতি একসঙ্গে ডাকছে। মধুর মুখে হাসি ফুটল। মুংলির ডাকে কাজ হয়েছে। হাতির দল ঝোপজঙ্গল ভেঙে ছুটে আসছে এদিকেই। দেখতে দেখতে প্রায় ডজনখানেকেরও বেশি হাতি ঘিরে ফেলল জায়গাটা। লোকগুলো ভয়ে মাটির উপর বসে পড়েছে। দু’হাত জোড় করে কাঁপছে থরথর করে।
‘চল মুংলি, আমাদের যেতে হবে।’
।। চার ।।
চল্লিশ মিনিটের মধ্যে ফরেস্ট অফিসারদের গাড়ি এসে পৌঁছল মারাংবুরুর থানের কাছে। মধুর মুখে খবর পেয়ে ভিড় জমিয়েছে গ্রামের মানুষও। তারা দেখল এক অদ্ভুত দৃশ্য। চারজন কাঠচোর মাটির উপর থেবড়ে শুয়ে-বসে গোঙাচ্ছে। তাদের ঘিরে রেখেছে হাতির দল। কাঠচোরদের হাতকড়া পরাতে বেগ পেতে হল না। মুংলিকেও ওরা নিয়ে চলল পশু হাসপাতালে। ওর চিকিৎসা দরকার।
মধু গিয়ে জড়িয়ে ধরল মুংলির গলা। দু’চোখে জল তার। মুংলিও শুঁড় বাড়িয়ে আদর করল মধুকে। গ্রামবাসীরাও সকলে খুব খুশি। তারা মধুকে কাঁধে তুলে নিয়েছে। মধু যেন আজ সত্যিই বনের রাজা হয়েছে। যেতে যেতে ফিরে তাকাল সে মারাংবুরুর থানের দিকে। মনে হল, দেবতার চোখ দুটোও যেন হাসছে তারই দিকে তাকিয়ে।