পড়ে গিয়ে বা পথ দুর্ঘটনায় আঘাতপ্রাপ্তির যোগ থাকায় সতর্ক হন। কর্মে উন্নতি ও সাফল্যের যোগ। ... বিশদ
ফরাসি লেখক জুল ভার্নের ‘টোয়েন্টি থাউজেন্ড লিগস আন্ডার দ্য সি’ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে প্রথম ডুবোজাহাজ তৈরি করেছিলেন মার্কিন নৌবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ার সাইমন লেক। আর আধুনিক হেলিকপ্টারের উদ্ভাবক ইগর সিকোরস্কিও ছিলেন ভার্নের ‘ক্লিপার অব দ্য ক্লাউডস’ বইটির মুগ্ধ পাঠক। কিন্তু কম্পিউটার আবিষ্কারের পিছনে এমন কোনও কল্পকাহিনি ছিল বলে আজও জানা যায়নি। অথচ, এই কম্পিউটার ঘিরেই তৈরি হয়েছে কত কল্পকাহিনি...।
নির্ভুল গণনার স্বপ্ন তাড়া করে ফিরেছিল চার্লস ব্যাবেজের গোটা জীবন। ঊনবিংশ শতকের শুরুতে গণনার জন্য ব্যবহৃত হতো নানা রকমের টেবিল। গণনার তালিকা। সেই তালিকা কাজে লাগাতেন সবাই। বিজ্ঞানী, জ্যোতির্বিজ্ঞানী, ইঞ্জিনিয়ার, সার্ভেয়ার, স্থপতি, ব্যাঙ্কার, ঋণদাতা ও ঋণগ্রহীতা। গণনা প্রয়োজন সব পেশার লোকদের। সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন নৌযাত্রায়। তারাদের চলনের খুঁটিনাটি হিসেব জানা চাই। তারাদের চলন বুঝতে ত্রুটি হলে শুধু প্রাণহানিই হয় না, ব্যবসাও লাটে ওঠে। হিসেবে ভুল যেন সমুদ্রে লুকিয়ে থাকা হিমশৈল। কখন যে কোন ভুলের জন্য জাহাজডুবি হবে, তা বলা যায় না। গণনায় ভুল মানেই জাহাজডুবি।
ব্যাবেজ নামলেন তাঁর স্বপ্নপূরণে। যন্ত্রগণক তৈরি করতে। এমন মেশিন তৈরি করতে, যা মানুষের মতো ভাবতে পারবে। ওই ১৮২২ সালেই তিনি তৈরি করে ফেললেন এক মডেল। সেই মডেলের নাম দিলেন ‘ডিফারেন্স ইঞ্জিন’। কারণ সেই মেশিন কাজ করত ধাপে ধাপে বিয়োগফলের উপর ভিত্তি করে। মানুষের চিন্তাশক্তি যন্ত্রের মধ্যে ঢোকাতে ব্যাবেজ একের পর এক যন্ত্রাংশ বাড়াতে শুরু করেন। ডিফারেন্স ইঞ্জিনের যন্ত্রাংশের সংখ্যা দাঁড়ায় ২৫ হাজার। ডিফারেন্স ইঞ্জিনের সাইজ দাঁড়ায় লম্বায় আড়াই মিটার, চওড়ায় দু’মিটার এবং পুরুত্বে এক মিটার। শুধু গণনা নয়, গণনার ফল (আউটপুট) প্রিন্ট করারও ব্যবস্থা ছিল ওই যন্ত্রে। লন্ডন শহরের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের একদিন ব্যাবেজ আমন্ত্রণ জানালেন যন্ত্রের কার্যক্ষমতা দেখাতে। হাতল ঘুরিয়ে এক সুশৃঙ্খল সংখ্যা থেকে আর এক সংখ্যা— কিন্তু সুশৃঙ্খল— দেখে ব্যাবেজের আমন্ত্রিত অতিথিরা অবাক। আমন্ত্রিতদের মধ্যে ছিলেন তরুণ রবার্ট চার্লস ডারউইন। যিনি পরে লিখেছিলেন, ‘অন দ্য অরিজিন অব স্পিসিজ বাই মিন্স অব ন্যাচারাল সিলেকশন, অর দ্য প্রিজারভেশন অব ফেভার্ড রেসেস ইন দ্য স্ট্রাগল ফর লাইফ’।
রয়্যাল সোসাইটির প্রেসিডেন্ট স্যার হামফ্রে ডেভিকে একটি চিঠি লিখেছিলেন ব্যাবেজ। ১৮২২ সালের ৩ জুলাই। লিখেছিলেন, ‘আমি এমন এক ইঞ্জিনের (যন্ত্রের) নকশা করেছি, যা কোনও সংখ্যাকে (m) অন্য সংখ্যা (n) দিয়ে গুণ করতে পারবে।... আমি এমনও ইঞ্জিনের নকশা ভেবেছি, যা চাইলে ০ থেকে এক কোটির মধ্যে যে কোনও মৌলিক সংখ্যা নির্ণয় করতে পারবে।’ আধুনিক কম্পিউটারের বীজ লুকিয়ে ছিল ওই চিঠির মধ্যেই।
কে এই চার্লস ব্যাবেজ? জন্ম ১৭৯১ সালের ২৬ ডিসেম্বর। সারে জেলার ওয়ালওয়ার্থে। বাবা বেঞ্জামিন ব্যাবেজ। লন্ডনের ব্যাঙ্ক-মালিক। মা এলিজাবেথ প্লুমলে টিপে। দুই ভাই মারা যান শৈশবে। এক বোন বেঁচে ছিলেন অনেক দিন। শৈশব থেকেই অনুসন্ধিৎসু। স্কুলের বন্ধুরা বলেছিল, ভূত আছে, দৈত্য আছে। ওরা নাকি খরগোশ, পেঁচা, কালো বেড়াল, দাঁড়কাকের বেশ ধরে আসে। আর, রক্তপাত ঘটলে নাকি ওদের দেখা পাওয়া যায়। বন্ধুদের কথামতোই একদিন ঘোর রাতের অন্ধকারে একটি পোড়ো বাড়িতে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করলেন ব্যাবেজ। রক্তপাতের প্রয়োজনে কাটলেন নিজের আঙুলও। এত রক্তারক্তির পরও ভূতপ্রেতের দেখা মিলল না। ভূতে বিশ্বাস হারিয়ে গেল চিরতরে।
এই ব্যাবেজ পরিণত বয়সে হলেন কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিতের অধ্যাপক। ১৮২৮ সালে তিনি নির্বাচিত হন ‘লুকাসিয়ান প্রফেসর অব ম্যাথমেটিক্স’। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের গভর্নিং বডির সদস্য হেনরি লুকাস-এর নামে ওই পদ চালু হয় ১৬৬৪ সাল থেকে। ‘দ্য ডেলি টেলিগ্রাফ’ কাগজের মতে, যা পৃথিবীর সবচেয়ে বিখ্যাত অধ্যাপক পদ। বিভিন্ন সময়ে এই পদে ছিলেন আইজ্যাক নিউটন, স্টিফেন উইলিয়াম হকিংদের মতো দিকপালরাও।
১৮৩৩ সালের ৫ জুন লন্ডন শহরে এক সান্ধ্য পার্টিতে ব্যাবেজের সাক্ষাৎ হয় গণিতজ্ঞ অ্যাডা লাভলেসের। বিখ্যাত ইংরেজ কবি লর্ড বায়রনের কন্যা। আধুনিক কম্পিউটারের ধারণা প্রবর্তনে ব্যাবেজের পাশাপাশি অ্যাডার ভূমিকাও অপরিসীম। ব্যাবেজ অ্যাডাকে বলতেন ‘ইন্টারপ্রিট্রেস’। মানে, তাঁর ‘ব্যাখ্যাকারিণী’। ১৮৩৪ সালে আর একটি যন্ত্রগণকও তৈরির পরিকল্পনা করেন ব্যাবেজ। অ্যানালিটিক্যাল ইঞ্জিন। যা আধুনিক কম্পিউটারের কাছাকাছি। যার অর্থ, যন্ত্র নিজে পরিস্থিতি বিচার করে সিদ্ধান্ত নিয়ে কাজ করবে। ১৮৪০ সালে ইতালির তুরিন শহরে ব্যাবেজ ব্যাখ্যা করেন অ্যানালিটিক্যাল ইঞ্জিনের কাজকর্ম। শ্রোতাদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন গণিতজ্ঞ লুইসি ফেডেরিকো মেনাব্রিয়া। এই মেনাব্রিয়া ফরাসি ভাষায় একটি প্রবন্ধ ছাপেন। শিরোনাম অ্যানালিটিক্যাল ইঞ্জিনের খসড়া। অ্যানালিটিক্যাল ইঞ্জিনের মূল নীতি এবং তার বিভিন্ন যন্ত্রাংশের কাজকর্মের বর্ণনা। মেনাব্রিয়ার প্রবন্ধ পড়ে অ্যাডা তা ইংরেজিতে অনুবাদ করেন। টীকা সহযোগে। অ্যাডার রচিত সেই পেপারকে কম্পিউটার প্রোগ্রামিংয়ের প্রথম প্রবন্ধ হিসেবে ধরা হয়। অ্যাডা লেখেন, ‘মেশিন শুধু সেটাই পারে, যেটা আমরা মেশিনকে দিয়ে করানোর কায়দা জানি।’ তাঁর অ্যালগরিদম রচনার জন্যই কম্পিউটার প্রথম ‘কেবল গণনাযন্ত্র’ পরিচয় থেকে বেরিয়ে আসে। তিনি তাঁর নোটে লিখেছিলেন, যেকোনও বিষয় যেমন গান, ছবি ইত্যাদিকে যদি সংখ্যায় পরিণত করার উপায় খুঁজে বের করা যায়, তাহলে কম্পিউটারের মাধ্যমে তার পরিবর্তন করা সম্ভব। আজ আমরা জানি যে, সে উপায়টি হচ্ছে বাইনারি সংখ্যা। মাত্র ৩৬ বছর বয়সে অ্যাডা লাভলেসের মৃত্যুতে সব ওলটপালট হয়ে গেল। তাঁর অ্যালগরিদম বিষয়ক কাজ স্থবির হয়ে যায়, অর্থনৈতিক সংকটে পড়েন ব্যাবেজ।
১৮৭১ সালে ব্যাবেজের মৃত্যুর আগে পর্যন্ত অ্যানালিটিক্যাল ইঞ্জিনের পরিকল্পনা আর বাস্তবায়িত হয়নি। দুঃখের কথা, ডিফারেন্স ইঞ্জিন আর অ্যানালিটিক্যাল ইঞ্জিনের মডেল তৈরি করা ছাড়া আর বেশি দূর এগতে পারেননি ব্যাবেজ। মারা যাওয়ার আগে পর্যন্ত তা নিয়ে বড়ই অসুখী ছিলেন তিনি। বিষয়টি বোঝা যায় ব্যাবেজের আত্মজীবনী ‘প্যাসেজেস ফ্রম দ্য লাইফ অব আ ফিলোজফার’ পড়লে। নিজের স্বপ্নপূরণ না হলে কী হবে, ব্যাবেজ আমৃত্যু চাইতেন গণনার কাজ মেশিন দিয়েই হোক।