বিদ্যার্থীদের পঠনপাঠনে আগ্রহ বাড়বে। কর্মপ্রার্থীদের কর্মপ্রাপ্তির যোগ। বিশেষত সরকারি বা আধা সরকারি ক্ষেত্রে যোগ প্রবল। ... বিশদ
সে যাই হোক, রিঙ্কু ওতে চিড়িয়াখানার ছবি দেখেছে। বড়বড় বাঘের ছবি, হাতির ছবি, সাপের ছবি, জিরাফের ছবি, ময়ূরের ছবি, আরও কত পশুপাখির ছবি। সব রঙিন। যেন এক্কেবারে জ্যান্ত। রিঙ্কুর খুব ভালো লেগেছে। ওকে চিড়িয়াখানায় নিয়ে যেতেই হবে। কোনও কথা ও শুনবে না।
রিঙ্কু এখন তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্র। ওদের বাড়ি সুভাষগ্রামের উকিলপাড়ায়।
ওর বাবা সবে কাজ থেকে ফিরেছেন। ও বাবাকে বলে ওঠে, ‘বাবা, তাহলে রোববার চিড়িয়াখানা যাওয়া হচ্ছে তো?’
‘দাঁড়া বাবা, আগে একটু চিন্তাভাবনা করে নিই। তারপর বলছি।’ বলেন ওর বাবা।
‘না, তোমাকে যেতেই হবে।’ জেদ ধরে রিঙ্কু।
‘হুঁ, রবিবার কত তারিখ পড়ছে যেন...?’
মনে মনে একটু হিসাব কষে নিয়ে রিঙ্কুর বাবা বলেন, ‘আটাশ তারিখ। ঠিক আছে, যাওয়া হবে।’
‘বাবা, আমার একটা ভালো টিফিন বক্স আর একটা ওয়াটার বটল কিনে দিতে হবে কালকে। আমরা রবিবার চিড়িয়াখানা যাব। কিনে দেবে তো বাবা?’ বলে রিঙ্কু।
‘হ্যাঁ হ্যাঁ, দেব। কালকেই দেব।’ বলেন ওর বাবা।
‘আমার ভালো বাবা।’ বাবার গলা জড়িয়ে ধরে খুশি হয়ে রিঙ্কু বলে।
যথারীতি রবিবার ওরা বেরিয়ে পড়ল। ট্রেনে যাচ্ছে ওরা।
ট্রেনে যাওয়ার সময় রিঙ্কু নানান প্রশ্ন করে ওর বাবাকে— ‘বাবা, চিড়িয়াখানার বাঘগুলো খুব বড়বড় হয়? জিরাফগুলো খুব উঁচু উঁচু হয়?
শিম্পাঞ্জিগুলো খুব কালো হয়? ময়ূরগুলোর পেখম থাকে?’
ওর বাবা বলেন, ‘চল, গিয়ে সব দেখবি এখন।’
রিঙ্কু তাড়াতাড়ি ওর ব্যাগের মধ্যে হাতটা দিয়ে দেখে নেয় ক্যামেরাটা নিয়েছে কি না, নয়তো ফিরে এসে স্কুলের বন্ধুদের তো ছবিগুলো দেখাতে পারবে না।
উল্টোদিকে বসে থাকা এক মাঝবয়সি ভদ্রলোক রিঙ্কুর দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলেন, ‘চিড়িয়াখানা যাচ্ছ?’
রিঙ্কু লোকটির দিকে তাকিয়ে বলে, ‘হ্যাঁ।’
‘যাও। কত কী পশু আছে, পাখি আছে গিয়ে সব দেখবে। খুব ভালো লাগবে।’ ভদ্রলোকটি বলেন।
‘তাই নাকি বাবা, অনেক অনেক পশু আছে, পাখি আছে?’ জিজ্ঞাসা করে রিঙ্কু।
ওর বাবা বলেন, ‘হ্যাঁ। বললাম তো গিয়ে সব দেখবি এখন।’
রিঙ্কুর মা ব্যাগ থেকে জলের বোতলটা বার করে ছিপিটা খুলে রিঙ্কুর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলেন, ‘বাবু, একটু জল খেয়ে নে।’
ট্রেনের গতি কমে যাচ্ছে। হুইসেল বাজছে। স্টেশনে মাইকে ট্রেন আসার ঘোষণা শোনা যাচ্ছে। রিঙ্কু অস্থির হয়ে ওঠে।
ওর বাবা বলেন, ‘এটা ঢাকুরিয়া এল। এরপর বালিগঞ্জ, তারপর পার্ক সার্কাস। বালিগঞ্জে আমরা নামব।’
রিঙ্কু একটু স্থির হয়ে বসে।
লোকে লোকারণ্য! সবাই যেন ব্যস্ততার কাছে নিজেদেরকে উজাড় করে দিয়ে হেঁটে চলেছে। একটু অবাক হয়ে যায় রিঙ্কু।
ওরা চিড়িয়াখানায় বড় একটা চোখ ধাঁধানো গেট দিয়ে ঢোকে। রিঙ্কু অবাক নয়নে এদিক ওদিক তাকিয়ে আশপাশে সবকিছু দেখতে থাকে।
‘এই দেখো মা কত্তবড় পাখি!’, উটপাখি দেখে রিঙ্কু চেঁচিয়ে ওঠে।
‘এটার মতো আরও অনেক বড়বড় সব পাখি আছে। এদিক দিয়ে আয় দেখবি তো।’ বলেন ওর বাবা।
রিঙ্কুর বাবা বলেন, ‘রিঙ্কু, এই যে চিড়িয়াখানা ঘুরে দেখছিস, ১৮৭৬ সালে এটা তৈরি হয়েছিল। এর নাম আলিপুর পশুশালা। আমরা মুখের কথায় একে আলিপুর চিড়িয়াখানা বলে থাকি। ইংরেজিতে বলা হয় জুলজিক্যাল গার্ডেন অব কলকাতা, বাইরে দেখবি এর গেটের ওপর লেখা আছে।’
রিঙ্কু বাবার হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে একমনে কথাগুলি শুনছিল।
‘বাবা, ওই দেখো জিরাফ!’, চেঁচিয়ে ওঠে আট বছরের রিঙ্কু।
‘রিঙ্কু বাবা, জিরাফ আমাদের কী শেখায় বল তো দেখি...’, রিঙ্কুর বাবার প্রশ্ন রিঙ্কুকে।
‘কী শেখায় বাবা?’, জানতে চায় রিঙ্কু।
‘ও শেখায় উচ্চ হতে। মনের দিক দিয়ে উচ্চ হতে, ঠিক ওর মতো। দেখ ও কত উঁচু! তাই না?’
‘হ্যাঁ বাবা।’
‘জীবনে ভালো ভাবে বাঁচতে গেলে ছোটখাট বিষয়গুলোকে অত আমল দিতে নেই। উচ্চ হতে হয়, মানে মনটাকে উঁচু করতে হয়। দেখ, ওর পায়ের কাছে কতকিছু পড়ে আছে, ও কিন্তু ওদিকে নজর দিচ্ছে না। ও পাতা খেয়ে যাচ্ছে, ওর যা কাজ ও করে যাচ্ছে। এবার এই দেখ হাতি! এবার বল, হাতির কাছ থেকে তুই কী শিখবি?’
‘জানি না বাবা, তুমি বলে দাও।’
‘ধীর-স্থির হতে। কোনও কাজে তাড়াহুড়ো না করতে। বুঝেছিস?’
‘হ্যাঁ বাবা।’
এভাবে ওরা পাখি দেখল, কত হরিণ দেখল, জলের পাশে ডাঙায় শুয়ে থাকা কুমির দেখল। তারপর বাঘমামার ঘরের সামনে গেল। রিঙ্কু তো আনন্দে ভরপুর। ক্যামেরা দিয়ে বাঘমামার একটার পর একটা ছবি তুলতে লাগল।
তারপর ওরা সাপের জায়গায় এল। ওরে বাবা, কত রকমের আর কত বড় বড় মোটা মোটা সাপ! কী বিকট দেখতে রে বাবা! রিঙ্কু দেখে আর ভাবে। সবগুলো কাচের ঘরে রয়েছে। ও দেরি না করে একটার পর একটা সাপের ছবি তুলতে থাকে।
এবার ওরা এল বাঁদরদের সামনে। কত্ত বাঁদর! কোনওটা গাছের ডালে বসে, কোনওটা ছোট্ট ঘরগুলোর চালে বসে, আবার কোনওটা এদিক-ওদিক লেজটি তুলে ঝপাৎ ঝপাৎ করে লাফ দিচ্ছে। বাঃ! দেখতে বেশ সুন্দর তো! ভাবে রিঙ্কু।
‘বাবা, আমাকে আগে কেন এখানে আনোনি?’, ওর বাবাকে প্রশ্ন করে রিঙ্কু।
‘এই তো এলি। আমরা আবার আসব। খুশি তো?’
‘হ্যাঁ বাবা, আমার খুব মজা লাগছে। আমরা আবার আসব। তবে এবার আসলে রকিদাদাকে নিয়ে আসব।’
রকি ওর থেকে এক শ্রেণী ওপরে পড়া ওর এক বন্ধু। রকির সঙ্গে ওর খুব ভাব।
‘ঠিক আছে।’ ওর বাবা বলেন।
এরপর ওরা সিংহের ঘরের কাছে আসে। সিংহের কেশর রিঙ্কু তাকিয়ে দেখতে থাকে বিস্ময়ভরা দৃষ্টিতে।
ওর বাবা বলেন, ‘এই হল সিংহ। কথায় বলে ‘পুরুষসিংহ’, মানে তোকে সিংহের মতো পুরুষ হতে হবে, এক্কেবারে সাহসী আর পরাক্রমশালী। বুঝলি?’
‘হ্যাঁ বাবা।’, রিঙ্কু ছোট্ট করে উত্তর দেয়।
তারপর ওরা আশপাশের বেশ কিছুটা জায়গা ঘুরে বেড়ালো। ছোটছোট ফুলের গাছ দেখল। একটা পুকুরে কত রকমের মাছ দেখল। কোনওটা ইয়া বড়, কোনওটা মাঝারি, সবাই জলের মধ্যে চরে বেড়াচ্ছে। অনেকগুলো আবার হাতের নাগালের মধ্যে। রিঙ্কু ধরবে বলে হাত বাড়াল। কিন্তু ধরতে পারল না। ওর কতই না মজা হচ্ছে বলে বোঝানো যাবে না।
রিঙ্কুর বাবা পাউরুটি আর কলা এনেছিলেন। রিঙ্কু কিছুটা রুটি আর একটা কলা খেল।
রিঙ্কু আবার বাঁদর দেখতে চাইল। ওর বাবা ওকে বাঁদরদের ঘরের কাছে নিয়ে গেলেন। ও দু’-চারটে ছোলা বাঁদরদের দিকে বাড়িয়ে দিল। ওরা লাফিয়ে লাফিয়ে ছোলাগুলো খেতে লাগল।
রিঙ্কুও আনন্দে লাফাতে লাগল। ওর বাবা বললেন, ‘থাম বাবা থাম। অত লাফাস না, পায়ে লেগে যাবে।’
রিঙ্কু থামল।
রিঙ্কু বলল, ‘বাবা, ময়াল সাপটার আর একটা ছবি তুলব।’
ওর বাবা-মা ওকে সাপের ঘরের কাছে নিয়ে গেলেন। ও গিয়ে কাছ থেকে সেই বিরাটাকার ময়াল সাপের তিনটে ছবি চটপট তুলে নিল।
অনেক ঘুরল ওরা। এখন একটু ক্লান্ত লাগছে ওদেরকে।
দুপুর গড়িয়ে এল। ওরা একটা জায়গায় কাগজ পেতে বসল। রিঙ্কুর মা বাড়ি থেকে বানিয়ে আনা খাবার বার করতে লাগলেন। রিঙ্কুর বাবা দুটো বোতল নিয়ে গেলেন জল ভরে আনতে। রিঙ্কু বসে বসে শুধু ভাবছে, বাব্বা! কত পশু কত পাখি কত সাপ কত কী দেখলাম আজ! খুব সুন্দর জায়গা এটা। কাল স্কুলে গিয়ে সব্বাইকে বলতে হবে।
তারপর ওরা বাড়ি থেকে আনা মুরগির মাংস আর ভাত তৃপ্তি করে খেল। রিঙ্কু একটা লেগপিস চিবতে চিবতে বাবাকে বলে, ‘বাবা, অনেক ফটো তুলেছি। তুমি কালকেই ওগুলো দোকান থেকে ওয়াশ করিয়ে আনবে। আমি স্কুলে গিয়ে আমার বন্ধুদেরকে দেখাব।’
এ যেন এক নিষ্পাপ শিশুর তার আদরের বাবাকে করা হুকুম।
ওর বাবা বললেন, ‘ঠিক আছে করে আনব। এখন তুই খা।’
খাওয়া-দাওয়া শেষ করে ওরা কিছুক্ষণ বসে বিশ্রাম নিল। রিঙ্কু ততক্ষণ একটা বল নিয়ে একটু খেলে নিল।
তারপর ওরা ময়ূর দেখতে গেল। পেখমওয়ালা ময়ূর দেখে রিঙ্কুর তাক লেগে গেল। ও একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। এক্কেবারে মোহিত হয়ে গেছে রিঙ্কু। তারপর নানান ভঙ্গিতে একটা বড় পেখমওয়ালা ময়ূরের কয়েকটা ছবি তুলে নিল।
আধঘণ্টা পর ওরা যে জায়গাটায় শিম্পাঞ্জি থাকে সেখানটায় এল। দেখে কালো কালো লোমওয়ালা ইয়া বড় একটা শিম্পাঞ্জি লাফিয়ে লাফিয়ে খেলা দেখাচ্ছে। আর সবাই রেলিংয়ে হাত ঠেস দিয়ে সেই খেলা দেখছে।
‘ওরা হল আদিমানব। ওদের থেকে পরিবর্তন হতে হতে আজকের মানুষের রূপ এমন হয়েছে। ডারউইন নামে এক বিজ্ঞানী এমনটাই বলেছেন। বুঝতে পারলি রিঙ্কু?’, বলেন রিঙ্কুর বাবা।
‘তাই নাকি বাবা? সত্যি?’ অবাক চোখে বাবার দিকে তাকায় রিঙ্কু।
‘সত্যি হতে পারে। ওনারা তো বড়বড় মানুষ ছিলেন। অনেক পড়াশোনা করে, অনেক ভাবনাচিন্তা করে কথাগুলো বলে গেছেন। উঁচু ক্লাসে ওঠ, সব জানতে পারবি।’ ওর বাবা ওকে বলেন।
অনেক ঘুরে-বেড়িয়ে বিকেল পাঁচটায় ওরা চিড়িয়াখানা থেকে বেরল।
ফেরার সময় অনেক কষ্ট হয়েছে বলে ট্রেনের মধ্যে রিঙ্কু ঘুমিয়ে পড়েছে। ঘুমোতে ঘুমোতে হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল, ‘ওই দেখো বাবা কী সুন্দর একটা হরিণ!’
ও হয়তো এখন কোনও এক স্বপ্নের দেশে ঘুরে বেড়াচ্ছে যেখানে এমনই এক চিড়িয়াখানা আছে আর সেখানে ধীর পায়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে এক সুন্দর হরিণ।