আমাদের এই দেশকে গড়ে তুলতে অনেকে অনেক স্বার্থত্যাগ করে এগিয়ে এসেছিলেন। এই কলমে জানতে পারবে সেরকমই মহান মানুষদের ছেলেবেলার কথা। এবার বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম। আগামী ২৫ মে তাঁর জন্মদিন। লিখেছেন চকিতা চট্টোপাধ্যায়।
‘দুঃখ সয়েছি, আঘাতকে হাসিমুখে বরণ করেছি কিন্তু আত্মার অবমাননা করিনি। নিজের স্বাধীনতাকে কখনো বিসর্জন দিইনি...।’ সাহিত্য সভার এক ভাষণে কথাগুলো বলেছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। তিনি একধারে ছিলেন কবি, সংগীতজ্ঞ, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, সম্পাদক, রাজনীতিবিদ ও সৈনিক। ১৮৯৮ সালের ২৫শে মে, বর্ধমানের চুরুলিয়ায় জন্মেছিলেন এই ‘বিদ্রোহী কবি’। যেখানে যত অবিচার, সেখানেই তিনি তাঁর গানে, কবিতায় হেনেছেন আঘাত, গেয়েছেন সাম্যের গান। গ্রামের ‘মক্তব’-এ সামান্য লেখাপড়ার পর কারণে তিনি ভ্রাম্যমাণ ‘লেটো’-র দলে যোগ দেন। লিখে ফেলেন ‘শকুনি বধ’, ‘দাতা কর্ণ’, ‘কবি কালিদাস’এর মতো পালাগান। ১৯১০ সালে ‘লেটো’ -র দল ছেড়ে ফিরে এলেন ছাত্রজীবনে। প্রথমে রানিগঞ্জের শিয়ারশোল রাজ স্কুল, পরে মাথরুন স্কুল। ষষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত পড়ে তাঁকে রোজগারের জন্য লেখাপড়া ছাড়তে হয়। আসানসোলের এক চা-রুটির দোকানে কাজ নিলেন। কাজের ফাঁকে ফাঁকেও লিখতেন ছড়া ও কবিতা। তাই দেখে মুগ্ধ হয়ে দারোগা রফিজউল্লাহ তাঁকে দরিরামপুর স্কুলের সপ্তম শ্রেণীতে আবার ভর্তি করালেন। কিন্তু স্কুলের শেষ পরীক্ষা দেওয়ার আগেই প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যোগ দিলেন ৪৯ নং বাঙালি রেজিমেন্টে ‘সৈনিক’ হিসাবে। তাঁর লেখনী তবুও থামল না। যুদ্ধক্ষেত্র থেকেই লিখতেন গান, কবিতা, গল্প। পাঠাতেন বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষে ফিরলেন কলকাতায়। লেখালেখির পাশাপাশি শুরু করলেন পত্রিকা সম্পাদনাও। প্রথমে ‘নবযুগ’ ও পরে ‘ধূমকেতু’। সান্নিধ্যে এলেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মোহিতলাল মজুমদার, অতুলপ্রসাদ সেন, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, শিশিরকুমার ভাদুড়ী, প্রেমাঙ্কুর আতর্থী প্রমুখ বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বদের। ‘ধূমকেতু’কে আশীর্বাণী পাঠিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই ‘ধূমকেতু’ শিক্ষিত তরুণদের মধ্যে সাড়া ফেলে দিল। ‘ধূমকেতু’তে পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি তুলে ধরলেন নজরুল। ইংরেজ সরকার রাজদ্রোহের অভিযোগে পত্রিকা বন্ধ করে দিয়ে নজরুলকে গ্রেফতার করল। জেলে বসেই লিখলেন, ‘শিকল পরার ছল’, ‘ভাঙ্গার গান’ প্রভৃতি কালজয়ী কবিতা! প্রকাশিত হল তাঁর বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ ‘অগ্নিবীণা’, যার প্রচ্ছদ এঁকেছিলেন শিল্পাচার্য্য অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর। জেলের ভেতর তাঁর উদাত্ত কন্ঠের সেই গান বন্দিদের প্রাণে আগুন জ্বেলে দিত! জেলেই লিখলেন ‘রাজবন্দীর জবানবন্দী’। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘বসন্ত’ গীতিনাট্যটি যখন নজরুলকে উৎসর্গ করলেন, তখন জেলে বসেই নজরুল লিখলেন –‘আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে’র মতো কবিতা!
কর্তৃপক্ষের নির্মম আচরণের প্রতিবাদে নজরুল শুরু করলেন অনশন। জনরোষ ছড়িয়ে পড়ল ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ শিলং থেকে ‘তার’ করলেন –‘অনশন ত্যাগ করো, আমাদের সাহিত্য তোমাকে দাবি করে।’ উনচল্লিশ দিন পর অনশন ত্যাগ করলেন নজরুল।
‘লাঙল’ পত্রিকায় প্রকাশিত হল তাঁর ‘সাম্যবাদী’ কবিতা। লিখলেন ‘কান্ডারী হুঁশিয়ার’, ‘আমরা শক্তি, আমরা বল, আমরা ছাত্রদল’এর মতো তাঁর অমর সৃষ্টি। ১৯২৫ সালে ফরিদপুরে কংগ্রেসের প্রাদেশিক সম্মেলনে মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে কবির পরিচয় ঘটল। কবির কন্ঠে ‘চরকার গান’ শুনে গান্ধীজি মুগ্ধ হয়ে গেলেন!
ছোটদের জন্যও নজরুল লিখেছেন, ‘লিচুচোর’, ‘খুকী ও কাঠবেড়ালি’র মতো মনোগ্রাহী কবিতা। ১৯১৮ সালে গ্রামাফোন কোম্পানিতে যোগ দেন তিনি, প্রথমে ‘ট্রেনার’, পরে ‘কম্পোজার’ হিসেবে, পরে গায়ক, গীতিকার, সুরকার হিসেবে। ১৯৩৯ সালে যুক্ত হন কলকাতা বেতার কেন্দ্রে। তাঁর গানের বিপুল ভান্ডারে প্রায় চার হাজার গান আছে, যা আজ আমরা ‘নজরুলগীতি’ নামে চিনি। কাজী নজরুল বাংলা সিনেমার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন গীতিকার, সুরকার, গায়ক, কাহিনীকার এমনকি অভিনেতা হিসেবেও। ১৯৪৫ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে বাংলা সাহিত্যে সর্বোচ্চ অবদানের জন্য ‘জগত্তারিনী স্বর্ণপদক’ দেন। ভারত সরকার ১৯৬০ সালে তাঁকে দেন ‘পদ্মভূষণ’। কাজী নজরুল সমান সম্মানিত বাংলাদেশেও। সেখানকার ‘জাতীয় কবি’র আসনখানা তাঁরই। পেয়েছেন সর্বোচ্চ সম্মান ‘একুশে পদক’।
১৯৪২ সালে গুরুতর অসুস্থ হয়ে বাক্‌শক্তি রহিত হয়ে যান কাজী নজরুল। স্মৃতি বিভ্রমও ঘটে তাঁর। ১৯৭৬ সালের ২৯শে আগস্ট এই চিরবিদ্রোহী কবি চিরঘুমে শায়িত হন।
ছবি : সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে