কর্মরতদের সহকর্মীদের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো থাকবে। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা ও ব্যবহারে সংযত থাকা দরকার। ... বিশদ
বিদ্যাসাগরের যথাযোগ্য মূল্যায়ন হোক
২০০ বছর অতিক্রান্ত। বিদ্যাসাগরের জীবন ও তাঁর কর্মকাণ্ড নিয়ে সমাজে যে প্লাবন তৈরি হওয়া দরকার ছিল তা হয়নি। বর্তমান ছাত্র সমাজের কাছে আদর্শ হলেও অনেকটাই উপেক্ষিত। তাই একজন ছাত্র হিসেবে নিদারুণ যন্ত্রণা পাই। রবীন্দ্রনাথ একসময় আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ‘বিদ্যাসাগর আমাদের সমাজে কাকের বাসায় কোকিলের ছানা।’ আমাদের হতশ্রী সমাজ এই মহাপ্রাণ মহাপুরুষকে কোনওদিনও মূল্যায়ন করতে পারেনি। তাই জীবিত বিদ্যাসাগর ঘরে ও বাইরে ছিলেন নিঃসঙ্গ ও প্রতারিত। এই বিদ্যাসাগরের স্কুলের ছাত্র হিসেবে চাই এই মনীষীর যথাযোগ্য মূল্যায়ন হোক। নতুন চিন্তার বিকাশ ঘটুক। নতুন প্রজন্ম তাঁর যথার্থ সম্মান ও হৃতগৌরব ফিরিয়ে দিক।
জিৎ মানিক, দশম শ্রেণী
বিদ্যাসাগরের আতিথ্য
ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলাদেশে ও সামাজিক সংস্কারের যে আলোড়ন ও নবজাগরণের সূচনা হয়েছিল সেই কাণ্ডারীর নাম আমরা সবাই জানি। তিনি আমাদের ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। জীবনের এমন কোনও ক্ষেত্র নেই যে তাঁর প্রচেষ্টা কার্যকরী ছিল না। রাজনৈতিক উত্থান থেকে শুরু করে সামাজিক কুসংস্কার দূর করে সমাজকে নতুন দিশা দেখিয়েছিলেন তিনিই। তিনি তাঁর চলার পথ নিজেই আবিষ্কার করেছেন। তিনি যে কত দয়ালু ছিলেন এবং মানুষের মুখ দেখে তাঁর মনের কথা বুঝতেন সেই প্রসঙ্গে বলি। তিনি তখন কর্মাটারে রয়েছেন।
একদিন অনেক রাতে কতকগুলি বাঙালি তীর্থযাত্রী তীর্থ সেরে ফেরার পথে বিদ্যাসাগরের আতিথ্য গ্রহণ করেছিলেন। তিনি তাদের আতিথ্যের সুযোগ করে দিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন তাদের খাওয়া হয়েছে কি না। সেই অতিথিরা বলেছিলেন, তাঁদের খাওয়া হয়নি। তবে এত রাতে আর খাবেন না। বিদ্যাসাগর ওই নিশুতি রাতে তাদের আলুসেদ্ধ ভাত রান্না করে খাইয়ে ছিলেন। এর থেকে বোঝা যায় তিনি কতটা মানব দরদি ও অতিথিপরায়ণ ছিলেন।
অঙ্কন ঘোষ, দশম শ্রেণী
বিদ্যার সাগর
বিদ্যাসাগরের শখ ছিল ভালো করে যত্ন করে বই বাঁধিয়ে রাখা। বইয়ের প্রতি অগাধ ভালোবাসা ছিল বিদ্যাসাগরের। তাঁর সংগ্রহের রাশি রাশি বই দেখে অনেকেই আকৃষ্ট হতেন। একদিন এক ধনী ব্যবসায়ীর শখ হল বিদ্যাসাগরের বইগুলি দেখার। বইগুলি দেখে তো তিনি আপ্লুত। কিন্তু মুখ ফসকে বলে ফেলেন বই-এর পিছনে এত বাজে পয়সা কেন খরচ করেন। এগুলি তো কোনও ভালো কাজে লাগাতে পারেন। বুদ্ধিমান বিদ্যাসাগর একথার উত্তর দেননি। তিনি শুধু বললেন, আপনার গায়ের শালটি বড় সুন্দর। তা দাম কত? তিনি বেশ আবেগাপ্লুত হয়ে বললেন ৫০০ টাকা। ব্যবসায়ী ভদ্রলোক এবার শালের বর্ণনা দিতে লাগলেন। তখন বিদ্যাসাগর টেনেটুনে নিজের গায়ের চাদরটি ঠিক করে নিলেন। এবং বললেন, কী দরকার অত দামি চাদর পরবার। আমার মতো খদ্দরের চাদর পরলেও হয়। দামও কম শীত মানে। কী দরকার অত দামি চাদর পরবার। এ দিয়ে অন্য কাজ করলেও হয়।
প্রাঞ্জল দত্ত, ষষ্ঠ শ্রেণী
বিধবা বিবাহ
বিদ্যাসাগর সারাজীবন ধরে নানান কর্মকাণ্ড করে গেছেন। এই ২০০ বছর পরেও তাঁর জীবন ও আদর্শ অনুসরণ প্রয়োজন। এরকম একজন শিক্ষাবিদ ও সমাজ সংস্কারকের জীবনী সমাজের সর্বস্তরে আলোচিত হওয়া দরকার। স্ত্রী শিক্ষা বিস্তার ও নারী জাতির প্রতি তাঁর সহমর্মিতা ও বিধবা বিবাহের রদের জন্য নারী সমাজ কৃতজ্ঞ। উনি স্ত্রী শিক্ষার উপযোগী পুস্তক রচনা করেন। বেথুন সাহেবের সহযোগিতায় মেয়েদের শিক্ষার জন্য তিনি বেথুন কলেজ স্থাপন করেন। তখন ছাত্রী জোগাড় করা ছিল খুব কঠিন কাজ। তাই সম্মানিত ব্যক্তির মেয়েদের কলেজের পাঠানোর ব্যবস্থা করেন, সকলকে অনুরোধ করেন। এর পাশাপাশি ওই কলেজের প্রাঙ্গণেই পাঠশালা খোলেন। সেখানে মেয়েদের জামাকাপড়, বই, খাতা, খাবার দিয়ে পড়ার ব্যবস্থা করেন। এবং বহু শিক্ষাদরদি মানুষের সাহায্য নিয়ে সমাজের প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও ৩৫টি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন। আজ সমাজের বুকে যে মেয়েরা শিক্ষিত বা স্বাধীন তাঁর জন্য বিদ্যাসাগরের অবদান অনস্বীকার্য।
শারণ্য চক্রবর্তী, ষষ্ঠ শ্রেণী
অদম্য জেদ
বিদ্যাসাগরের স্মরণশক্তি ছিল প্রখর। আট বছর বয়সে উচ্চশিক্ষার জন্য তিনি কলকাতায় পড়তে যান। কলকাতা যেতে যেতে মাইল স্টোনের সংখ্যা দেখে তিনি ইংরেজি সংখ্যা শিখে নিয়েছিলেন। পড়াশোনার প্রতি ছিল তাঁর অদম্য জেদ। অত্যন্ত নিয়ম নিষ্ঠার মধ্যে দিনযাপন করতেন। সব কাজ
সেরে রাত দশটার মধ্যে শুয়ে পড়তেন। বাবাকে বলতেন, রাত দুটোর সময় তাকে জাগিয়ে দিতে। বিদ্যাসাগরের বাবা আমনি গির্জার ঘণ্টা বাজলেই জাগিয়ে দিতেন। মধ্য রাতে উঠে তিনি পড়তে বসতেন। এর জন্য মাঝেমধ্যে শরীর খারাপ হতো। শরীরও তাঁর জেদের কাছে হার মানত। এরপরেও ঘরের কাজকর্ম করতেন। কোনও দাস-দাসী ছিল
না। বাবা ও দাদা সহ চারজন লোকের রান্না
ঈশ্বরচন্দ্র একাই করতেন। সকালে উঠে পড়াশোনা করে গঙ্গার ঘাটে স্নান করতে যেতেন। তারপর কাশীবাবুর বাজারে মাছ, তরকারি কিনে আনতেন। সেগুলি রান্না করে খাওয়া-দাওয়া করে বাসন
মেজে আবার পড়তে বসতেন। এমনকী রান্না
করতে করতে ও রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতেও বই পড়তেন। কোনও সময় তিনি নষ্ট করতেন না।
আর এভাবেই এক দরিদ্র বঙ্গসন্তান সমগ্র বঙ্গসমাজকে কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন। যা সত্যিই
স্মরণীয় এবং গ্রহণীয়।
শঙ্কর দে, অষ্টম শ্রেণী
ইংরেজি ভাষার গুরুত্ব
‘এ বঙ্গের সমতলে তৃণলতা গুল্মদলে
বজ্রজয়ী তুমি বনষ্পতি’
এই ছত্র দুটি বিদ্যাসাগর সম্বন্ধেই প্রযোজ্য। কর্মে, চিন্তায়, মানসিকতায় তিনি একবিংশ শতাব্দীকেও অতিক্রম করে গেছেন। আর সেজন্যই ওনাকে তদানীন্তন সমাজের ভয়াল ভ্রুকুটির শামিল হতে হয়েছে। কারণ রাজা রামমোহনের পর তিনিই দ্বিতীয় মনীষী ইংরেজি ভাষা শিক্ষাকে যুক্তিযুক্ত মনে করে সাদরে গ্রহণ করেন। এদেশে ইংরেজি শিক্ষা প্রচলনে তাঁর সুগভীর চিন্তা ও দূরদৃষ্টির পরিচয় মেলে। ইংরেজি শেখার গুরুত্ব যে কতটা সেটা মহান শিক্ষাব্রতী বিদ্যাসাগর সেই যুগে বুঝেছিলেন। কিন্তু আমাদের দেশের শিক্ষা নিয়ামকরা বড় দেরিতে উপলব্ধি করেছেন। অনেক ক্ষেত্রে তা প্রযোজ্য হয়নি এখনও। এর থেকেই বোঝা যায় তাঁর জন্মের দু’শো বছরেও তিনি কতটা প্রাসঙ্গিক।
স্বর্ণদীপ দত্ত, দশম শ্রেণী
মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউশন (মেন)
নিবেদিতা ভঞ্জ, প্রধান শিক্ষিকা
এ এমন এক পুণ্যভূমি, যেখানে জ্ঞানের মশাল জ্বালিয়েছেন স্বয়ং বিদ্যাসাগর। এ এমন এক শিক্ষাক্ষেত্র, যেখানে ছাত্র হিসাবে পাঠ নিয়েছেন, পাঠ দিয়েওছেন স্বয়ং স্বামী বিবেকানন্দ। বিদ্যাসাগরের জন্মের দ্বিশতবর্ষের সামনে দাঁড়িয়ে সেই জ্ঞানপীঠ মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউশন (মেন)-এর এবার হৃতগৌরব পুনরুদ্ধারের চেষ্টা।
অতীতের আঁতুড়ঘরে
বাংলা নবজাগরণের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফসল মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউশন (মেন)। বিদ্যাসাগর ১৮৮৫ সালে বর্তমান ৩৯ শংকর ঘোষ লেনে মহেন্দ্র নারায়ণ দাসের কাছ থেকে প্রায় দু-বিঘা জমি কেনেন ২৮ হাজার টাকায়। তারপর দেড় লক্ষ টাকা ব্যয়ে স্কুল ও কলেজের জন্য দুটি দোতলা বাড়ি নির্মিত হয়। ১৮৮৭ সালের জানুয়ারি মাস থেকে এই নতুন বাড়িতেই স্কুল কলেজের পঠনপাঠন শুরু হয়। ১৮৮৫-তে মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউশনের বউবাজার শাখা ও ১৮৮৭-তে বড়বাজার শাখার শুভ সূচনা হয়। তবে, প্রকৃতপক্ষে বিদ্যালয়ের সূচনা হয়েছিল ১৮৬৪ সালে।
স্মরণীয় বরণীয়
বিদ্যাসাগর, বিবেকানন্দের পাশাপাশি এই বিদ্যালয়ে দায়িত্বভার সামলেছেন প্রথম প্রধান শিক্ষক হিসাবে ‘বাংলার হোমার’ হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রখ্যাত সাহিত্যিক মোহিতলাল মজুমদার, রবীন্দ্রনাথের গৃহশিক্ষক ব্রজনাথ দে, রাষ্ট্রপতি পুরস্কার প্রাপ্ত জাতীয় শিক্ষক ধরণীমোহন মুখোপাধ্যায়, শিক্ষা ও শিক্ষক আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা অজিত সেন, ধর্মদাস সামন্ত প্রমুখ।
নতুন পালক
বর্তমানে এই বিদ্যালয়ের প্রাতঃকালীন বালিকা বিভাগেও যথেষ্ট উন্নতি পরিলক্ষিত হচ্ছে। সান্ধ্যকালীন রাষ্ট্রীয় মুক্ত বিদ্যালয়ের অন্যতম কেন্দ্র হিসাবে জনশিক্ষা প্রসারে বিদ্যালয়টির ভূমিকাও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সুতানুটি পরিষদ উত্তর কলকাতার ঐতিহ্যময় অধ্যায়ের সার্থক উত্তরসূরি হিসাবে মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউশনকে বিশেষ সম্মানে সম্মানিত করেছে।
ভবিষ্যতের লক্ষ্যে
বিদ্যাসাগর মহাশয়ের ব্যবহৃত টেবিল, ঘড়ি, সিন্দুক বিদ্যালয়েই রয়েছে সযত্নে। বর্তমান ছাত্রসংখ্যা প্রায় ৪০০। শিক্ষার্থীর সংখ্যা ক্রমশ কমছে ইংরেজি বিদ্যালয়ের বাড়বাড়ন্ত ও হিন্দিভাষী এলাকার জন্য। গুরুত্বপূর্ণ বিভাগে শিক্ষকের অভাবও রয়েছে যথেষ্ট। স্পোকেন ইংলিশ ও অঙ্ক বিষয়ে শিক্ষাদানের পৃথক ব্যবস্থা থাকলেও ছাত্র এবং অভিভাবকদের পক্ষ থেকে সদর্থক সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। শিক্ষার্থীদের জন্য তৈরি হচ্ছে অডিটোরিয়াম, ইনডোর গেমস যেমন টেবিল টেনিস, ক্যারাম খেলার ব্যবস্থা। সোলার প্যানেল ও অত্যাধুনিক ল্যাব তৈরি হচ্ছে।
বিদ্যাসাগরের স্বপ্নের প্রতিষ্ঠানের প্রধান পদে যুক্ত হয়ে আমার বিশ্বাস, ভালো শিক্ষার্থী তৈরি করা, যারা সমাজের সর্বক্ষেত্রে তাদের অবদান রাখবে এবং মেয়েদের সম্মান দেবে। বিদ্যাসাগরের আদর্শকে দিকে দিকে ছড়িয়ে দেবে।
সংকলক: শম্পা সরকার
ছবি: সুফল ভট্টাচার্য