জলপথ পরিবহণ কর্মে বিশেষ শুভ। হস্তশিল্পী, হিসাব-শাস্ত্রবিদ প্রমুখের কর্মে উন্নতি ও সুনাম। মানসিক অস্থিরতা থাকবে। ... বিশদ
কিন্তু আজকের কাহিনির নায়ক অথবা নায়িকা সেই সাদা হাতি নয়। আজ কেন্দ্রীয় চরিত্রের নাম মওলা বকশ। রাজকোষে সেরকম অর্থ নেই। পিতামহ, প্রপিতামহদের সেই স্বপ্নের জৌলুস, শক্তি, রৌনক, শখ এবং নিজের ইচ্ছের শোকিন হওয়ার অবকাশ আর নেই আকবর শাহের। তিনি এখন যে সাম্রাজ্যে বসেছেন, তার নাম মুঘল সাম্রাজ্য হলেও আদতে তা দিল্লিতে শুরু, দিল্লিতেই শেষ। অতএব মুঘল বাদশাহ দ্বিতীয় আকবর শাহের সামান্য একটি বাসনা হল খুব বড় আকারে কোনও হাতির পিঠে হাওদা বসিয়ে বৈকালিক ভ্রমণ অথবা জামি মসজিদের নামাজে যাবেন জুম্মায়। কখনও সখনও বেগম আর প্রিয়তম পুত্র আবু জাফরকে নিয়ে এই লালকেল্লার মধ্যেও হাতিসফর হতে পারে। যমুনাতট ধরে সন্ধ্যায় অবকাশযাপনও কম মায়াবী নয়। এক ব্যবসায়ী সত্যিই এক বিশালাকায় হাতি নিয়ে উপস্থিত। সেই হাতি কিনে ফেলা হল। দাম বেশিই পড়ল। সেই ব্যবসায়ীর একটিই শর্ত। এই হাতির নাম যেটা আছে, সেটাই রাখতে হবে। বাদশাহ নতুন কোনও নাম যেন না রাখেন। তাহলে হাতি ক্ষিপ্ত হবে। সে মেজাজি। এমনকী নিজের
নাম নিয়েও।
বাদশাহ আকবর শাহ এই হাতিকে রাজকীয় হাতির সম্মান দিলেন। অর্থাৎ সকলের মধ্যে সেই হাতিই শ্রেষ্ঠ এবং সম্রাটের জন্য সেই হাতি থাকবে সদা প্রস্তুত। অতএব মওলা বকশ হল রাজকীয় হাতি। কিন্তু যতটা সম্রাটের প্রিয়, মওলা বকশ যেন তার থেকে বেশি পছন্দ করে বাদশাহপুত্র আবু জাফরকে। ঠিক একই কারণে আবু জাফরেরও প্রিয়তম খেলার সাথী এখন মওলা বকশ।
মওলা বকশ কতটা প্রিয় ছিল বাদশাহের? এতটাই যে সম্রাট শাহজাহানের নির্মাণ করে যাওয়া লালকেল্লার একটি বিখ্যাত প্রবেশদ্বার লাহোরি দরওয়াজাকে ভেঙে তার উচ্চতা বৃদ্ধি করার নির্দেশ দিয়েছিলেন বাদশাহ। কারণ একটাই। মওলা বকশের পিঠে চেপে লাহোরি দরওয়াজা থেকে বাইরে বেরিয়ে জামি মসজিদে যেতে পছন্দ করতেন বাদশাহ। কিন্তু এতটাই উচ্চতা মওলা বকশের যে লাহোরি দরওয়াজা থেকে সে বেরতেই পারছে না। অগত্যা বাদশাহের নির্দেশ লাহোরি দরওয়াজার উচ্চতা বাড়ানো হোক। সুতরাং লালকেল্লায় প্রবেশের সময় যে লাহোরি দরওয়াজা পেরিয়ে আজকের পর্যটকেরা প্রবেশ করে, সেটি অতটা উঁচু হয়েছে ওই হাতির জন্য!
হাতির পিঠে তো আর একা একা বাদশাহ অথবা তাঁর নাবালক পুত্রকে বসিয়ে দেওয়া যায় না। মওলা বকশ মেজাজি। সে কখন যে কী করে বসবে তার স্থিরতা নেই। অতএব মওলা বকশের মাহুতও জবরদস্ত। সুদূর বুখারা থেকে মুঘলদের মাহুতরা এসেছে। তারাই বংশানুক্রমে সব বাদশাহদের পোষা হাতির মাহুত হয়েছে। মওলা বকশের মাহুতের নাম মহব্বত খান। তার উপর বাদশাহ এতটাই সন্তুষ্ট যে, চাঁদনিচকের অদূরে এই শাহজাহানাবাদেই দেওয়া হয়েছিল এক জায়গির। সেখানে এক ক্ষুদ্র প্রাসাদ গড়েছিল মহব্বত খান। আজ সেই স্থান ধ্বংসাবশেষ। যার নাম মহব্বত খানের রেইতি। আজ কী কারণে বিখ্যাত? ঘুড়ি ওড়ানোর সর্বশ্রেষ্ঠ স্থান। হঠাৎ একদিন কী যে হল মহব্বত খানকে ছুঁড়ে ফেলে পায়ে পিষে দিল মওলা বকশ! হতচকিত গোটা কেল্লা। মওলা বকশ এরকম কোনওদিন করেনি। মহব্বত খানের বেগম কাঁদতে কাঁদতে হাতে শিশুপুত্রকে ধরে এনে মওলা বকশের সামনে রাখলেন। ক্রন্দনরত হাহাকারে বললেন, এই শিশুর আব্বাকে তুমি মেরেছ। একেও মার। উনি নেই। আমরা বেঁচে থাকব না। আমাদেরও মার। মওলা বকশের যেন গভীর অনুতাপ হল। সে শুঁড় দিয়ে সেই ২ বছরের শিশুকে তুলে নিল। আর চোখ থেকে তার জল পড়ছে।
সেই শুরু। মওলা বকশ একটানা অনেকক্ষণ যদি সেই শিশুসন্তান রহমত আলিকে দেখতে না পায়, তাহলে অস্থির হয়ে যায়। সে যখন বালক তখন তার খেলার সাথীরাই মওলা বকশের সাথী। আর এই ছেলেরা খেলাধুলোর পর মওলার সামনে এলে, নিজের জন্য বরাদ্দ আখ একে একে এইসব বাচ্চাদের হাতে তুলে দেয় মওলা বকশ। একদিকে রহমত আলি ও তার বন্ধুরা এবং অন্যদিকে বাদশাহ পুত্র আবু জাফর! কিন্তু এভাবে বরাদ্দ আখ গরিব বাচ্চাদের বিলি করা হবে কেন? নালিশ গেল বাদশাহের কাছে। ফতোয়া দিলেন তিনি, মওলা বকশের খাওয়ার সময় যেন সে একা থাকে। কোনও বাচ্চা থাকবে না। তাই হল। কিন্তু এ কী? বাচ্চারা নেই। তাই মওলা বকশ খাওয়া ছেড়ে দিল। সে উপবাস করছে! আবু জাফর পিতাকে বলল, ওর কাছে আমাদের যেতে দাও। আমরা ছাড়া ও খাবে না। বাদশাহ বাধ্য হলেন।
ক্রমেই মওলা বকশ বৃদ্ধ হয়। বৃদ্ধ হাতিকে রাজকীয় হাতির মর্যাদা দেওয়া সম্ভব নয়। মওলা একা একা থাকে। সময় অতিবাহিত হয়। আস্তাবলে একা একা দাঁড়িয়ে থাকে মওলা বকশ। এখন সিংহাসনে বসেছে মওলার প্রিয় আবু জাফর। যাকে দিল্লির মানুষ চেনে বাহাদুর শাহ জাফর নামে। আর ইতিহাস বইয়ের পাতায় তিনি দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ।
একদিন মওলা বকশের কানে আসে প্রবল শব্দ। চারদিকে ধোঁয়া। রক্ত। বারুদ। আবার সব থেমে গেল। মওলা বকশ যেন নীরব সময়। যার কাজ শুধুই দেখে যাওয়া। তার শক্তি নেই আর। হঠাৎ একদিন শান্ত সমাহিত এবং নিজের মধ্যে ডুবে থাকা বৃদ্ধ মওলা বকশ আস্তাবল ছেড়ে উন্মাদের মতো কেল্লার বাইরে যাওয়ার চেষ্টা করে। কী ব্যাপার? মওলা এরকম করে কেন? কেউ তো তাকে কিছু বলেনি? সে কি কিছু আন্দাজ করেছে? কী আন্দাজ?
ইংরেজরা বাহাদুর শাহ জাফরকে বন্দি করে নিয়ে গিয়েছে কোথায় যেন! একথা মওলা বকশের জানার কথা নয়! অথচ সে তার প্রিয় আবু জাফরের ওই নির্বাসনের কথা জেনে গেল অলৌকিকভাবে? বাহাদুর শাহ জাফরকে নির্বাসনে নিয়ে যাওয়া হল বার্মায়। তিনি আর ফিরলেন না কেল্লায়। মওলা বকশও আর ফিরল না কেল্লায়। পাগলের মতো খুঁজল আবু জাফরকে। ফিরোজ শাহ কোটলায় একদিন সকালে পাওয়া গেল মওলা বকশের মৃতদেহ! সেখানে যাওয়ার আগে সে শেষবারের মতো এসেছিল লাহোরি দরওয়াজায়! মাথা তুলে তাঁকে দেখা গিয়েছে কাকে যেন ডাকছে সুতীব্র বৃংহণে! সেই হাহাকার ধাক্কা খেয়েছে লাহোরি দরওয়াজায়। মওলা বকশের প্রিয় স্থান!