কর্ম নিয়ে স্থানান্তর গমনে সাফল্যের যোগ। কর্মে স্থানগত বা সংস্থাগত পরিবর্তন অসম্ভব নয়। পারিবারিক ক্ষেত্রে ... বিশদ
অনিমেষকে থামিয়ে অনুপমা বলে উঠল, ‘তবু দেখুন কী পরিহাসের বিষয়, জীবনের শুরুতে কচি মনগুলো নিয়ে আমরা কতরকমের রঙিন স্বপ্ন দেখি। সেই সব ঝকঝকে স্বপ্নগুলো দেখতে দেখতেই কখন যেন জীবনের প্রান্তে এসে পড়ি। জীবনটা জুড়ে কিছুই করা হয়ে ওঠে না।’
‘ঠিকই বলেছেন আপনি,’ অনিমেষের গলায় হতাশার সুর। জীবনশেষের হাতছানিতে কোথাও যেন প্রকৃতির অদ্ভুত আলোয় মিশে যায় বার্ধক্যের বিষণ্ণতা। পরিবারের বাঁধনগুলো আলগা হতে হতে দু’জন অজানা-অচেনা নরনারী বৃদ্ধাবাসের ঘেরাটোপে বড্ড কাছাকাছি। অনুপমার প্রায় মাস ছয়েক পরেই অনিমেষের এই ‘প্রান্তজন’ বৃদ্ধাবাসে আসা। বৃদ্ধাবাসের আবাসিক হিসেবে তাও প্রায় দু’বছর হতে চলল দু’জনের। একে অপরের পারিবারিক অতীতটুকুর খোঁজখবর নেওয়া হয়ে গিয়েছে। সংসার জীবনের অতৃপ্তি, যৌবনের প্রেম, সংসার জীবনের সহযাত্রীর সঙ্গে বিশ্বাস-অবিশ্বাসের সম্পর্ক, সন্তানসন্ততির স্বার্থপরতা সবকিছু সঙ্গী করে ওরা দু’জনেই কাণ্ডারীহীন একই তরণীর যাত্রী। অনিমেষের ভাষায়, ভাড়াটে সৈনিকদের নিয়ে কাটানো ফেলে আসা জীবনটায় যে সঠিক অর্থে প্রাণটাই ছিল না, সেটা এই বয়সে এসে বেশ বুঝতে পারি। অনুপমাও একসময় কথাগুলোয় সায় দেয়। অনিমেষের মনে হয় প্রকৃতির কী আশ্চর্য এক লীলাখেলায় সারাটা জীবন অতিবাহিত করে দুটো ভগ্ন হৃদয়ের মাঝে যেন আজ এক অদৃশ্য সেতু রচিত হয়েছে। অথচ এমনটা যদি সেই যৌবনের দিনগুলোয় হতো!
অনুপমা অতীতের স্মৃতি খুঁড়ে মাঝেমধ্যেই কান্নাভেজা দিনগুলোর কথা অনিমেষকে বলে। জীবনের দ্বারপ্রান্তে এসে অনিমেষও অনুপমার মনের দোসর হতে চায়। অনুপমা সেদিন বলছিল, ‘জানেন, আমি বাপ-মায়ের একমাত্র আদরের ধন ছিলাম। বাবা ছিলেন কেন্দ্রীয় সরকারের আর মা রাজ্য সরকারের উচ্চপদস্থ অফিসার। মেয়েবেলায় সংসারে অভাব জিনিসটার সিকিভাগও বুঝতে পারিনি। যদিও পরবর্তীকালে ইশকুলের দিদিমণি হয়ে গরিব দেশের হাড়-হাভাতে পরিবারগুলোর ছেলেমেয়েদের কথা জানতে পেরেছিলাম।’ অনুপমার কথার জালে হারিয়ে যায় অনিমেষ। অনুপমার স্মৃতির পথে ভেসে ওঠে ছটফটে দুরন্ত এক কিশোরীর মেয়েবেলা। তখন সবেমাত্র কলেজে পা রেখেছে অনুপমা। সুন্দরীদের মাঝে অন্যতম আকর্ষণ হিসেবে সে তখন ক্লাসের হার্টথ্রব। কলেজের তরুণদল সকলেই অনুপমার মন ছুঁতে চায়। তারই মধ্যে অনিকেতকেই অনুপমার একটু মনে ধরত। ক্লাস অফ করে কফি হাউস, আউট্রাম ঘাট, ভিক্টোরিয়া কিংবা রবীন্দ্র সরোবর আড্ডা মেরে বেড়াত। তবুও অনুপমা অনিকেতের সঙ্গে ভালো বন্ধুত্বের বাইরে বেশিদূর এগিয়ে যাওয়ার কথা কখনওই ভাবেনি। অথচ মাঝেমধ্যেই অনিকেত অনুপমার কাছে বারংবার একটু উষ্ণতার খোঁজে ধরা দিত। অনুপমা বলত, ‘এই হয়েছে তোদের পুরুষমানুষদের এক স্বভাব। মেয়ে দেখলেই খালি গায়ে পড়তে চাস। সুন্দর একটা বন্ধুত্বের মধ্যেই তো আমরা একে অপরকে চিনতে পারি, তাই না?’
তবুও সেই বন্ধুত্বের মাঝেই যে পুরুষতন্ত্রের আদিমতায় অনুপমা একদিন নিগ্রহের শিকার হবে সেকথা ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারেনি। এরপর বেশকিছুদিন অনুপমার জীবনে গ্রাস করেছিল অবসাদ। পড়াশোনা থেকে বেশ কয়েকবছর বিরতি নিতে হয়েছিল। অবশেষে মনোবিদ আর কাউন্সেলারদের তত্ত্বাবধানে জীবনটাকে খুঁজে পেয়েছিল অনুপমা।
আবার অনিমেষ সেই পুরুষতন্ত্রের শরিক হয়েও ছিল ভিন্ন মানসিকতার। ওর নরম স্বভাবের জন্য বন্ধুরা অনিমেষকে যেন পুরুষদের দলেই ফেলত না। তবুও জীবনজুড়ে অনিমেষ ডাকাবুকো না হলেও বন্ধুরা ওর নারীভাগ্য দেখে ঈর্ষা করত। কলেজের একের পর এক সুন্দরী অনিমেষের আকর্ষণে ধরা দিত। ওর কথাবলা, জীবনদর্শন, চালচলন, পোশাক আশাক সবেতেই মেয়ের দল ছিল উদ্দাম। এরই মাঝে কঙ্কনার সঙ্গেই গাঁটছড়া বেঁধেছিল অনিমেষ। সরকারি চাকুরে অনিমেষের সঙ্গে কলেজের অন্যতম বান্ধবী কঙ্কনার ঘর বাঁধতে একটিবারের জন্যও ভাবতে হয়নি। কিন্তু সংসার জীবনের মাঝ নদীতেই যে এমন তুফান উঠবে তা কোনওদিনই ভাবতে পারেনি অনিমেষ। জীবনের কোনও স্তরেই একটিবারের জন্য অনিমেষ ঈশান কোণে মেঘের দেখা পায়নি। তাই নিশ্চিন্ত মনেই জীবন তরীটি ভাসিয়ে দিয়েছিল। অথচ নারী-পুরুষের পরস্পর বিশ্বাসের সম্পর্কটা যে সুতোয় বাঁধা থাকে সেটা একবার ছিঁড়ে গেলে যে, তা আর জোড়া লাগতে চায় না, তা বলাইবাহুল্য। চাকুরিরতা স্বাধীনচেতা কঙ্কনা দুই পুত্র-কন্যার মা হয়েও একসময় সংসার সমুদ্রে তৃতীয় ব্যক্তির প্রবেশাধিকার ঘটিয়েছিল। পরকীয়ার আড়ালে অনিমেষের সংসার জীবন ভেঙে টুকরো টুকরো হয়েছিল। সেই অর্থে অনুপমা আপাত দৃষ্টিতে সংসার জীবনে সুখীই ছিল। দিদিমণি হিসেবে ছাত্রছাত্রীদের সাহচর্যে বেশ কাটছিল জীবনটা। বৃহৎ ব্যবসায়ী স্বামী অনির্বাণ বউকে পটের বিবির মতোই সংসারে বসিয়ে রাখতে চেয়েছিল। কিন্তু দিদিমণি হয়ে একজন সমাজ গড়ার কারিগর হিসেবে অনুপমা কোনওদিনই চাকরি ছাড়ার কথা ভাবতে পারেনি। তবুও স্বামীর উচ্ছৃঙ্খল জীবনে রাশ টানতে না পারা অনুপমা একসময় সংসারে একাকী হয়ে পড়েছিল। অনির্বাণ এক একসময় রাতের পর রাত ঘরে আসত না। মদ, জুয়া, বন্ধুবান্ধব এইসব নিয়েই সময় কাটিয়ে দিত। একসময়ের কলেজের হার্টথ্রব অনুপমার মনে হতো তার আকর্ষণের খামতিই হয়তো সংসার জীবনে স্বামীকে বশে আনতে ব্যর্থ হয়েছে। দুই ছেলে বড় হয়ে যাওয়ার পর আরও একাকী হয়ে গিয়েছিল অনুপমা।
বৃদ্ধাশ্রমে অনুপমা আর অনিমেষ ক্রমশই যেন একে অপরের উপর ভরসা রাখতে শুরু করেছিল। বয়সের বাধা অতিক্রম করে দু’টি মন পরস্পর পরস্পরের কাছে ক্রমেই যেন খোলা পাতা হয়ে উঠেছিল। একে অপরের সম্বোধনও আপনি থেকে তুমি-তে রূপান্তরিত হয়েছিল। সেদিন দোল উৎসবের সকালে অনুপমা একমুঠো লাল আবির নিয়ে হাজির হয়েছিল অনিমেষের ঘরে। ফাগুন দিনের উদাসী সকালটায় তখন সবেমাত্র বসন্ত উৎসবের আয়োজনে ব্যস্ত আশ্রমের আবাসিকেরা। একমুঠো আবির অনিমেষের পায়ে ছুঁইয়ে অনুপমা বলেছিল, ‘আজকের দিনে বড়দের পায়ে আবির দিয়ে প্রণাম করতে হয়। সংসার জীবনে অনির্বাণ তো সে সুযোগ কোনওদিনই দেয়নি। প্রতিবার দোলেই ও বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে বাইরে কোথাও চলে যেত ফুর্তি করতে।’
তারপর অনুপমা হিড়হিড় করে টানতে টানতে অনিমেষকে নিয়ে বসিয়েছিল বসন্ত উৎসবের অঙ্গনে। একদল আশ্রমিক তখন যৌবনবেলাকেও ছাপিয়ে উঠেছে। সংসার জীবনের মলিনতাগুলো যেন এই রঙিন দিনে জীবনের প্রান্তবেলায় দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলো এক ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়েছে। ‘আজ সবার রঙে রং মিশাতে হবে...’ রবীন্দ্রসঙ্গীতের আবেগে, নৃত্য-গীতিতে ভেসে উঠেছে আশ্রম প্রাঙ্গণ। অপ্রস্তুত হয়ে অনুপমার পাশটিতেই বসল অনিমেষ। বসন্ত সকালের শেষবেলাকার মৃদুমন্দ শীতের পরশে কোকিলের কুহুতানে মুখরিত প্রকৃতিও যেন একদল পরিবারহীন মানুষের নতুন জীবনের রঙিন আনন্দে মেতে উঠেছে। অনুষ্ঠানের মাঝেই একক নৃত্য পরিবেশনে অনুপমার নাম ঘোষিত হল। ‘বসন্তে ফুল গাঁথল আমার জয়ের মালা...’ গানটায় রবীন্দ্রনৃত্যের সাথী হল অনুপমা। অনিমেষ তখন দর্শকাসনে বসে একের পর এক দৃশ্যকল্প রচনা করেই চলেছেন। অনুষ্ঠান শেষে অনুপমার হাতের পরশ পেতেই অনিমেষের সংবিত ফিরল।
—ওমা কখন যে তোমার নাচ শেষ হল, আর অনুষ্ঠান শেষে সব্বাই আবির খেলায় মেতে উঠল, আমি বুঝতেই পারিনি! তুমি এই বয়সেও এত সুন্দর নাচতে পার অনু!
মুগ্ধ বিস্ময়ে অনিমেষের চোখে মুখে অদ্ভুত ভালোলাগার পরশ। অনুপমা বলতে শুরু করল, ‘জানো, একসময় আমার জীবনে এই নাচই ছিল ধ্যানজ্ঞান। বিয়ের পর সংসার সমুদ্রে আমার জীবনের ভালোলাগার পরশগুলোকে তো কেউ অনুভবের চেষ্টাই করল না। ছেলেপুলেদের মানুষ করতে করতেই জীবনটা কেটে গেল। আর অনির্বাণ ওর ইয়ার দোস্তদের নিয়েই সারাটা জীবন মেতে থাকল। ঘরের মানুষটার কথা শোনা কিংবা মনের খবর নেওয়ারও কোনও চেষ্টাই করল না।’ কথাগুলো বলতে গিয়ে অনুপমার গলাটা বুজে এল। অনিমেষ একমুঠো আবির ওর হাত থেকে নিয়ে অনুপমার মাথায়-কপালে মাখিয়ে দিল। অনুপমার বসন্তমন লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠল। সচকিত হয়ে অনিমেষকে বাধা দিতে গিয়েও কেমন যেন শরীরে মনে অবশ হয়ে গেল। বেলাশেষের শরীরটা এখন আর আগের মতো উদ্দাম হতে না পারলেও অস্তগামী সূর্যের গোধূলি আলোয় মাখা অদ্ভুত পরিমণ্ডল জুড়ে সমগ্র প্রকৃতিতে যে ভালোলাগার আবেশ ছড়িয়ে পড়েছে, তেমনই এক আবেশে দু’টি প্রাপ্তবয়স্ক মন জীবনের এই প্রান্তবেলায় পরস্পর পরস্পরের নিকট যেন এক নৈসর্গিক আলোকবৃত্ত রচনা করল। অনিমেষ মনে মনে বলল, অনু, শেষ জীবনে যেন আমরা একে অপরের মনের মলিনতাটুকু মুছে ফেলতে পারি। তাহলেই দেখবে আমাদের জীবন সার্থক।
অনির্বাণের উচ্ছৃঙ্খলতা সময়ের অনেক আগেই জীবনে দাঁড়ি টানতে বাধ্য করেছিল। বেঁচে থাকতে মানুষটা অনুপমাকে সঙ্গ না দিলেও ঘরে আসত। অনির্বাণহীন অনুপমার জীবনে সেটাও চুকে গেল। তারপর কালের নিয়মে দুই ছেলের বিয়ে। বউমা, নাতি-নাতনিদের নিয়ে সংসার। বেশ কাটছিল অনুপমার। কিন্তু একে একে দুই ছেলেই বিদেশে চলে গেল। তার কিছুদিন পর বউমা, নাতি-নাতনিরাও। একলা বাড়িটা যেন অনুপমাকে গিলে খেতে আসত। শেষে বৃদ্ধাশ্রমে চলে যাওয়ার কথায় ছেলেরা মাকে ওদের কাছে নিয়ে যেতে চাইলেও অনুপমা রাজি হল না। অবশেষে এই ‘প্রান্তজন’-এ আসা।
অনিমেষের ক্ষেত্রে সংসার জীবনের সমাপ্তির গল্পটা ছিল ভিন্ন। কঙ্কনা একসময় ভালোলাগার মানুষটির হাত ধরে বেরিয়ে গেল। অনিমেষের ছেলে-মেয়ে তখন সবেমাত্র ফাইভ আর সেভেন। তারপর কাজের মাসি, আয়াদের হাতেই ছেলেমেয়েরা বড় হয়ে উঠেছে। দু’জনেই আজ প্রতিষ্ঠিত। অনিমেষ বাবা হিসাবে তার সব দায়িত্বই পালন করেছিল। তারপর ছেলে-বউয়ের সংসারে আর থাকতে চায়নি। মেয়ে বাবাকে তার কাছে নিয়ে যেতে চেয়েছিল, কিন্তু অনিমেষ জামাইবাড়ি যেতে রাজি হয়নি। তারপর একদিন ছেলেমেয়েকে বৃদ্ধাশ্রমে পাকাপাকিভাবে যাওয়ার সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছিল অনিমেষ। বৃদ্ধাবাসে এসে জীবনের এই প্রান্তবেলায় এমন অদ্ভুত সম্পর্কের দোসর পাওয়া যাবে সেকথা অনুপমা-অনিমেষ কেউই ভাবতে পারেনি। তবুও জীবন জুড়ে সুখ তো পদ্মপাতার জল। খালি টলমল করতেই থাকে! তাই দীর্ঘ জীবনের অভিজ্ঞতায় ওদের দু’জনের কেউই আর সুখের কাঙাল নয়। বেলাশেষে দাঁড়িয়ে ওরা জানে এ জীবন অনিত্য।
অনুপমা-অনিমেষ দু’জনেই সমাজমাধ্যমে খানিক সচল। অবসরের বেশ কিছুটা সময় ওদের মোবাইল স্ক্রিনে চোখ রেখেই কেটে যায়। অনিমেষ এফবি অ্যাকাউন্ট থেকেই অনুপমার জন্মদিনের তারিখটা জেনেছিল। মনস্থির করেছিল এবারের জন্মদিনে ওকে একটা সারপ্রাইজ দেবে। অনুপমার পছন্দের ফুল গোলাপ আর জারবেরা। জন্মদিনের দিন খুব সকালেই অনিমেষ অনুপমার ঘরে হাজির হল। অনিমেষকে দেখে খুশিতে উচ্ছল হয়ে উঠল অনুপমা।
—তুমি ফেসবুক থেকে আমার জন্মদিনের তারিখটা ঠিক মনে রেখেছ দেখছি!
—বাহ্, মনে না থাকার কী আছে! তুমি তো আমার ফ্রেন্ডলিস্টে আছ। তাই আজ সকালে মোবাইলে তো একটা অ্যালার্ট এসেইছে।
অনিমেষ অনুপমার হাতে গোলাপ আর জারবেরার গুচ্ছটা তুলে দিয়ে ‘হ্যাপি বার্থডে অনু’ লেখা একটা গ্রিটিংস কার্ড এগিয়ে দিল। উচ্ছ্বাসে অনুপমার চোখের কোণটা কেমন যেন চিক্ চিক্ করে উঠল। অনিমেষ বুঝতে পারল অনুপমা আজ বেশ আবেগ বিহ্বল হয়ে পড়েছে। অন্যমনস্ক ভাবে বলতে শুরু করল, ‘জানো অনিমেষ, আমার জন্মদিনটা অনির্বাণ মনেই রাখতে পারত না!’
স্মৃতির সরণী বেয়ে অতীতচারী অনুপমা কথা বলতে বলতে ক্রমশ কেমন যেন ঝিম মেরে আসছিল। হঠাৎই বলল, ‘জানো আমার মাথাটা আজ বেশ ধরেছে। ট্যাবলেট খেলাম। কিন্তু কিছু হচ্ছে না...!’ কথাগুলো বলতে বলতেই অনুপমা হঠাৎই মাথাটা ধরে চেয়ারটায় বসে পড়ল।
—ওহঃ, ওহঃ- অসহ্য যন্ত্রণা অনিমেষ, আহ্-আহ্...
অনুপমার মুখ চোখ দেখে ভয় পেয়ে গেল অনিমেষ। তৎক্ষণাৎ আশ্রম সুপারিন্টেনডেন্টকে ফোন করে ডাক্তারকে ডাকতে বলেই অনুপমার চোখে মুখে জলের ঝাপটা দিল। ততক্ষণে টেবিলের ওপর শরীরটা এলিয়ে দিয়েছে অনুপমা। ডাক্তার আসার আগেই সব শেষ।
জন্মদিন-মৃত্যুদিন একাকার করে বছর কয়েকের মধ্যেই অনিমেষের মনের মানুষ হয়ে ওঠা অনু চিরদিনের জন্য হারিয়ে গেল। মনের নিকটতম তরঙ্গদৈর্ঘ্যের মানুষটা অনিমেষের শেষের বেলাকে কাঙাল করে বিদায় নিল। অনিত্য এ জীবনের দায়ভার বুকে অনিমেষের ক্ষণিক সুখের অনুভূতিটুকুও দীর্ঘায়িত হতে দিল না। দুঃখের পারাবারে ফেলে আসা সংসার জীবন থেকে খানিক নিষ্কৃতি পেতে চেয়েছিল অনিমেষ। অথচ বেলাশেষের মায়ার বাঁধনটুকু ছিন্ন করতে আজ যেন বুকটা ফেটে যাচ্ছে। দু’চোখ শ্রাবণের ধারাপাত হয়ে ভেসে যেতে চাইছে। জ্বরাগ্রস্ত আশ্রমটাকে ঘিরে ধরা এক মায়াময় ভুবন তখন অনিমেষকে বিষণ্ণতার শিখরে তুলে ধরতে মরিয়া।